০৯:১৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৪ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

সম্পদ গড়ার চেয়ে সন্তান গড়া জরুরি

Reporter Name
  • Update Time : ০৭:৩৫:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
  • / ৯১ Time View

সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়ায় সন্তানদের ঘরে ঠাঁই না পেয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে
ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন এক বৃদ্ধ। ভিডিওটি সারা দেশের মানুষ দেখেছে।
কেঁদেছে, ভেবেছে প্রত্যেকের জীবনের পরিণতি। তবে মৃত্যুর আড়ালের গল্পটি
মৃত্যুর চেয়েও করুণ। আট মাস আগে বিপত্নীক হওয়া এই বৃদ্ধ পুত্রদের ঘরে
আশ্রয় হারিয়েছিলেন। সারারাত উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকেও সন্তানের কিংবা
পুত্রবধূদের মন গলাতে পারেননি তিনি। আত্মহত্যার আগের রাতে কোনো পুত্র
দরজা খোলেনি। ক্ষুধার্ত পেট, সারারাতের গ্লানি, বুকভরা অভিমান নিয়ে জীবনের
অভিশাপ মাটিচাপা দেওয়ার এর চেয়ে উত্তম সমাধান হয়ত তাঁর চোখে আর কিছু
ছিল না।

সন্তানদের পাষাণ হৃদয়ে বাবার জন্য ভালোবাসার এক ফোঁটা অনুকম্পা জাগাতে
ব্যর্থ হলে সে জীবনকে সমাজ ব্যর্থই বলবে। বাবা পাগল হলেও কোনো সন্তান
জন্মদাতাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে? বাবা নিঃস্ব হলেও পুত্র
কীভাবে এমন নির্দয় হয়? এই সন্তানদের জন্যই বাবারা কত কিছু করেন। জীবনে
ত্যাগের পিরামিড গড়ে তোলেন। বৈধ-অবৈধের ভেদ ভুলে গিয়ে সম্পদের পাহাড়
তৈরি করেন। সন্তান যেন সুখে-শান্তিতে থাকে, সে নিশ্চয়তা দিতেই আত্মীয়দের
সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। মাছের মাথাটি, মুরগির রানটি, দুধের সরটুকু কিংবা
আস্ত ডিমটি সন্তানের মুখে তুলে দেন। সন্তানের পছন্দ মানেই—জীবনযুদ্ধে
জিতে সেটি তাকে এনে দিতে হবে।

মোটকথা, সন্তানের জন্য বাবা কী করেন না? সাধ্যের মধ্যে সবটুকু, এমনকি
সাধ্যের বাইরে গিয়েও সন্তানের শখ পূরণে বাবা জীবন বাজি রাখেন। সন্তান
পৃথিবীতে আসা মানেই বাবা-মায়ের ভোগের পরিকল্পনা বদলে ত্যাগের তালিকা
তৈরি হয়।

এতক্ষণ যা বললাম, তা ভালো বাবাদের কথা। লেখক মিচ অ্যালবম বলেছিলেন,
“খারাপ পুরুষ থাকতে পারে, কিন্তু একটাও বাজে বাবা নেই।” তবে সমাজ বলে, দু-
একজন খারাপ বাবা থাকলেও তারা দৃষ্টান্তে নগণ্য। সমাজে এখন অনেকেই
সম্পদের পেছনে ছুটছেন। সন্তানের অনৈতিক আবদার পূরণে সমাজবিরোধী পথ
বেছে নিচ্ছেন। এখনও সমাজে ছেলে শিশু জন্ম নেওয়া মানে—আকাশের চাঁদ পাওয়া।
কন্যাদের ব্যাপারে সামাজিক ট্যাবু এখনও কাটেনি।

পুত্র বাবার বৃদ্ধ বয়সে ভরসা হবে, বংশের মুখে আলো জ্বালাবে, অসহায় সময়ে
দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে—এই আশাতেই হয়ত উল্লাপাড়ার বাবাও বাঁচছিলেন। যে সাহসী,
সে হয়ত আত্মহত্যা করে বেঁচে গেছেন। কিন্তু বিপত্নীক বৃদ্ধ বাবারা, অসহায়
বৃদ্ধরা—পরিবারে, পুত্রদের সংসারে কেমন আছেন? তাঁরা যদি অন্যের বোঝা হয়ে
না থাকেন, সে সংখ্যা কত? পহেলা বৈশাখে একজন পুত্রবধূর মুখে স্বৈরাচারের
মোটিফের সঙ্গে তার শাশুড়ির চেহারার তুলনা করতে শুনেছি—অবলীলায়। মানুষ
মানুষকে সহ্য করা, আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষা করা এবং সম্মান প্রদর্শন
করা—এসব সমাজ থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সন্তানরা তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানির প্রতি বাবা-মায়ের ব্যবহার
যেভাবে দেখছে, সেই ব্যবহারেরই প্রতিচ্ছবি একদিন তাদের আচরণে ফুটে উঠবে।
যদি বাবারা সন্তানের সংসারে বোঝা হন, যদি সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ে,
যদি বৃদ্ধদের মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়—তবে এই নিপীড়নের সংস্কৃতি
ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও পুনরাবৃত্তি হবে। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ
সন্তানকে মানুষ করতে ভুলে যাচ্ছে। সন্তানকে সময় দেওয়া, আন্তরিক সম্পর্ক
গড়ে তোলা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা শোনা এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো—এসবই
সন্তানের মনোজগৎ গঠনে অপরিহার্য। সন্তানের মনে মায়ার টান সৃষ্টি করতে
হবে। মানবিকতা চর্চার পাঠ দিতে হবে তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। বড়দের
সম্মান ও ছোটদের প্রতি স্নেহ—এগুলি হাতে-কলমে শেখাতে হবে।

সন্তান ক্ষমতায় থাকলে, তাকে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দূরে রাখতে
হবে। সবাইকে সম্মান করার বোধ জন্মালে বাবা-মা সংসারে অলংকার হয়ে
উঠবেন। সংসারে যেমন নানা সীমাবদ্ধতা থাকবে, তেমনি রাগ-অভিমানও হবে।
কিন্তু ভালোবাসাই হবে তাদের বন্ধন। বাবা ছেলেকে বুঝবে, ছেলে বাবাকে না দেখে
কিছুক্ষণ গেলে পাগলের মতো খুঁজবে—এটাই হোক মানদণ্ড। সন্তানকে মানুষের
মতো মানুষ করতে হলে তাকে নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিবেকবোধের
টনিক দিতে হবে। অমানুষ একশ সন্তানের চেয়ে একজন সুসন্তান হাজার কোটি গুণ
শ্রেয়।

সম্পদ জমা করতে গিয়ে সন্তানের খবর না রাখলে সে সম্পদ মৃত্যুর তিন দিনের
মধ্যেই অপচয় হয়ে যাবে। বাবার লাশ রেখে সম্পদের ভাগাভাগিতে ব্যস্ত সন্তান,
বা ভাগ বুঝে না পেলে দাফন না দেওয়া সন্তান—এই সমাজই দেখেছে। সন্তান যদি
মানুষ না হয়, তবে সেই দুঃখ একজীবনে শেষ হবে না। অর্থবিত্ত কম থাকুক, তবু
সন্তান মানুষ হোক—এই আমাদের প্রত্যাশা। সন্তান মানুষ না হলে, তাকে
মানুষরূপে গড়ে তুলতে না পারলে, শেষ জীবনে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই যাবে।
মা-বাবাকে আগলে রাখতে হবে ঠিক তেমনি, যেমন করে তাঁরা সন্তানকে আগলে
রেখেছিলেন একসময়।

আর তাঁদের প্রতি যেন না বলতে হয়—“উঁফ” পর্যন্তও।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

সম্পদ গড়ার চেয়ে সন্তান গড়া জরুরি

Update Time : ০৭:৩৫:২৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়ায় সন্তানদের ঘরে ঠাঁই না পেয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে
ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন এক বৃদ্ধ। ভিডিওটি সারা দেশের মানুষ দেখেছে।
কেঁদেছে, ভেবেছে প্রত্যেকের জীবনের পরিণতি। তবে মৃত্যুর আড়ালের গল্পটি
মৃত্যুর চেয়েও করুণ। আট মাস আগে বিপত্নীক হওয়া এই বৃদ্ধ পুত্রদের ঘরে
আশ্রয় হারিয়েছিলেন। সারারাত উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকেও সন্তানের কিংবা
পুত্রবধূদের মন গলাতে পারেননি তিনি। আত্মহত্যার আগের রাতে কোনো পুত্র
দরজা খোলেনি। ক্ষুধার্ত পেট, সারারাতের গ্লানি, বুকভরা অভিমান নিয়ে জীবনের
অভিশাপ মাটিচাপা দেওয়ার এর চেয়ে উত্তম সমাধান হয়ত তাঁর চোখে আর কিছু
ছিল না।

সন্তানদের পাষাণ হৃদয়ে বাবার জন্য ভালোবাসার এক ফোঁটা অনুকম্পা জাগাতে
ব্যর্থ হলে সে জীবনকে সমাজ ব্যর্থই বলবে। বাবা পাগল হলেও কোনো সন্তান
জন্মদাতাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে? বাবা নিঃস্ব হলেও পুত্র
কীভাবে এমন নির্দয় হয়? এই সন্তানদের জন্যই বাবারা কত কিছু করেন। জীবনে
ত্যাগের পিরামিড গড়ে তোলেন। বৈধ-অবৈধের ভেদ ভুলে গিয়ে সম্পদের পাহাড়
তৈরি করেন। সন্তান যেন সুখে-শান্তিতে থাকে, সে নিশ্চয়তা দিতেই আত্মীয়দের
সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। মাছের মাথাটি, মুরগির রানটি, দুধের সরটুকু কিংবা
আস্ত ডিমটি সন্তানের মুখে তুলে দেন। সন্তানের পছন্দ মানেই—জীবনযুদ্ধে
জিতে সেটি তাকে এনে দিতে হবে।

মোটকথা, সন্তানের জন্য বাবা কী করেন না? সাধ্যের মধ্যে সবটুকু, এমনকি
সাধ্যের বাইরে গিয়েও সন্তানের শখ পূরণে বাবা জীবন বাজি রাখেন। সন্তান
পৃথিবীতে আসা মানেই বাবা-মায়ের ভোগের পরিকল্পনা বদলে ত্যাগের তালিকা
তৈরি হয়।

এতক্ষণ যা বললাম, তা ভালো বাবাদের কথা। লেখক মিচ অ্যালবম বলেছিলেন,
“খারাপ পুরুষ থাকতে পারে, কিন্তু একটাও বাজে বাবা নেই।” তবে সমাজ বলে, দু-
একজন খারাপ বাবা থাকলেও তারা দৃষ্টান্তে নগণ্য। সমাজে এখন অনেকেই
সম্পদের পেছনে ছুটছেন। সন্তানের অনৈতিক আবদার পূরণে সমাজবিরোধী পথ
বেছে নিচ্ছেন। এখনও সমাজে ছেলে শিশু জন্ম নেওয়া মানে—আকাশের চাঁদ পাওয়া।
কন্যাদের ব্যাপারে সামাজিক ট্যাবু এখনও কাটেনি।

পুত্র বাবার বৃদ্ধ বয়সে ভরসা হবে, বংশের মুখে আলো জ্বালাবে, অসহায় সময়ে
দেয়াল হয়ে দাঁড়াবে—এই আশাতেই হয়ত উল্লাপাড়ার বাবাও বাঁচছিলেন। যে সাহসী,
সে হয়ত আত্মহত্যা করে বেঁচে গেছেন। কিন্তু বিপত্নীক বৃদ্ধ বাবারা, অসহায়
বৃদ্ধরা—পরিবারে, পুত্রদের সংসারে কেমন আছেন? তাঁরা যদি অন্যের বোঝা হয়ে
না থাকেন, সে সংখ্যা কত? পহেলা বৈশাখে একজন পুত্রবধূর মুখে স্বৈরাচারের
মোটিফের সঙ্গে তার শাশুড়ির চেহারার তুলনা করতে শুনেছি—অবলীলায়। মানুষ
মানুষকে সহ্য করা, আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষা করা এবং সম্মান প্রদর্শন
করা—এসব সমাজ থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সন্তানরা তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানির প্রতি বাবা-মায়ের ব্যবহার
যেভাবে দেখছে, সেই ব্যবহারেরই প্রতিচ্ছবি একদিন তাদের আচরণে ফুটে উঠবে।
যদি বাবারা সন্তানের সংসারে বোঝা হন, যদি সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ে,
যদি বৃদ্ধদের মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয়—তবে এই নিপীড়নের সংস্কৃতি
ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও পুনরাবৃত্তি হবে। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ
সন্তানকে মানুষ করতে ভুলে যাচ্ছে। সন্তানকে সময় দেওয়া, আন্তরিক সম্পর্ক
গড়ে তোলা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা শোনা এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো—এসবই
সন্তানের মনোজগৎ গঠনে অপরিহার্য। সন্তানের মনে মায়ার টান সৃষ্টি করতে
হবে। মানবিকতা চর্চার পাঠ দিতে হবে তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। বড়দের
সম্মান ও ছোটদের প্রতি স্নেহ—এগুলি হাতে-কলমে শেখাতে হবে।

সন্তান ক্ষমতায় থাকলে, তাকে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দূরে রাখতে
হবে। সবাইকে সম্মান করার বোধ জন্মালে বাবা-মা সংসারে অলংকার হয়ে
উঠবেন। সংসারে যেমন নানা সীমাবদ্ধতা থাকবে, তেমনি রাগ-অভিমানও হবে।
কিন্তু ভালোবাসাই হবে তাদের বন্ধন। বাবা ছেলেকে বুঝবে, ছেলে বাবাকে না দেখে
কিছুক্ষণ গেলে পাগলের মতো খুঁজবে—এটাই হোক মানদণ্ড। সন্তানকে মানুষের
মতো মানুষ করতে হলে তাকে নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিবেকবোধের
টনিক দিতে হবে। অমানুষ একশ সন্তানের চেয়ে একজন সুসন্তান হাজার কোটি গুণ
শ্রেয়।

সম্পদ জমা করতে গিয়ে সন্তানের খবর না রাখলে সে সম্পদ মৃত্যুর তিন দিনের
মধ্যেই অপচয় হয়ে যাবে। বাবার লাশ রেখে সম্পদের ভাগাভাগিতে ব্যস্ত সন্তান,
বা ভাগ বুঝে না পেলে দাফন না দেওয়া সন্তান—এই সমাজই দেখেছে। সন্তান যদি
মানুষ না হয়, তবে সেই দুঃখ একজীবনে শেষ হবে না। অর্থবিত্ত কম থাকুক, তবু
সন্তান মানুষ হোক—এই আমাদের প্রত্যাশা। সন্তান মানুষ না হলে, তাকে
মানুষরূপে গড়ে তুলতে না পারলে, শেষ জীবনে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই যাবে।
মা-বাবাকে আগলে রাখতে হবে ঠিক তেমনি, যেমন করে তাঁরা সন্তানকে আগলে
রেখেছিলেন একসময়।

আর তাঁদের প্রতি যেন না বলতে হয়—“উঁফ” পর্যন্তও।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com