০২:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

মুসলিম উম্মাহর অনৈক্য ও অর্জিত আযাব

Reporter Name
  • Update Time : ০২:৫৫:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫
  • / ১৫৪ Time View

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ফরজ হলো একতা এবং হারাম হলো বিভক্তি

 

পবিত্র কুর’আনে যখন কোন নির্দেশ দেয়া হয় -তখন সেটি প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ হয়ে যায়। আর যখন কোন কিছু নিষেধ করার হয় -তখন সেটি হারাম হয়ে যায়। পবিত্র কুর’আন এভাবেই হালাল-হারামের পথ দেখায়। মুসলিমদের মাঝে একতা গড়াকে ফরজ এবং বিভক্তি গড়াকে হারাম করা হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১০৩ আয়াতে। এ প্রসঙ্গে মহান রব’য়ের নির্দেশ হলো:

 

وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟

 

অর্থ: “এবং তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রশিকে শক্ত ভাবে ধরো এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।”

 

এভাবেই বিভক্ত হওয়াকে মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের জন্য হারাম করেছেন। সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে বিভক্তির শাস্তি রূপে প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে ভয়ানক আযাবের। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায়নি, এবং বাঁচছে মহান আল্লাহ তায়ালা নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে। সে বিদ্রোহের বিদ্রোহের মাত্রা এতটাই প্রবল যে, তারা দল গড়ে, রাজনীতি করে এবং যুদ্ধ করে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ও গোত্রের নামে  বিভক্তির দেয়াল গড়ার লক্ষ্যে। ফলে মুসলিমগণ বিভক্তির দেয়াল গড়েছে ৫৭টি দেশের মানচিত্রের নামে। এরূপ বিভক্তির কারণে মুসলিমদের শক্তি বাড়েনি। বরং বেড়েছে পরাজয়, অপমান ও জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে হারিয়েছে গুরুত্ব ও ইজ্জত। বিভক্তি নিয়ে বাঁচার কারণে ১৫০ কোটির বেশী এতোটাই তুচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাদের কথা জাতিসংঘসহ কোন মহলেই গুরুত্ব পায়না। অপর দিকে মহান রব’য়ের হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে বাঁচার  জন্য প্রতিশ্রুত শাস্তি অপেক্ষা করেছে আখেরাতে।

 

বুঝতে হবে, প্রতিটি হারামের পথই সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুতির পথ তথা জাহান্নামের পথ। তাই যারা ভাষা, গোত্র, এলাকা, ফেরকা ও দলের নামে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তির দেয়াল গড়ে -তারা বস্তুত জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার রাস্তা নির্মাণ করে। শয়তান ও ইসলামের শত্রুপক্ষ তো সেটাই চায়। বিভক্তি যে ভয়ানক আযাব ডেকে আনে -তা নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণাটি হলো:

 

وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ

 

অর্থ: “এবং তাদের মত হয়োনা যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে বিভক্ত হলো এবং বিবাদে লিপ্ত হলো; এরাই হলো তারা যাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)।

 

উপরিউক্ত আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুত আযাবের মুখে পড়তে মূর্তিপূজারী, নাস্তিক, খুনি বা চোর-ডাকাত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সে জন্য বিভক্তি ও বিবাদে লিপ্ত হওয়াটাই যথেষ্ট। তাই যারা বিভক্তির পথ বেছে নিল অথচ আযাবে পতিত পড়লে না -সেটি বিরল। নিজেদের মাঝে বিবাদ ও বিভক্তির কারণেই স্পেন থেকে মুসলিমদের প্রায় ৭ শত বছরের শাসন বিলুপ্ত হয়েছে। সে দেশে নিহত হয়েছে লাখ লাখ মুসলিম এবং ধর্ষিতা হয়েছে হাজার হাজার মুসলিম রমনী। অথচ সে সময় স্পেনের মুসলিমগণ দরিদ্র ছিল না। বরং বিপুল প্রাচুর্য ছিল সম্পদের, এবং বিশাল ভাণ্ডার ছিল অস্ত্রের। তারা নির্মাণ করেছিল বড় বড় প্রাসাদ এবং দুর্গ। কিন্তু অভাব ছিল একতার। রাজপরিবারের ক্ষমতালিপ্সু সদস্যদের মাঝে প্রায়ই ষড়যন্ত্র ও গৃহ যুদ্ধ লেগে থাকতো। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন কি পার্শ্ববর্তী খৃষ্টান রাজার  কাছে তারা সাহায্য ভিক্ষা করতো এবং সাহায্য নিয়ে রাজার আসনে বসে পুত্র তার নিজের পিতাকে এবং ভাই তার নিজ ভাইকে হত্যা করতো। অথচ শত্রুগণ ছিল একতাবদ্ধ। এক খৃষ্টান রাজ্যের রানী ইসাবেলা অন্য খৃষ্টান রাজ্যের রাজা ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করে নিজেদের রাজ্যকে বড় করেছে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালার সূন্নত হলো, তিনি কখনোই বিভক্ত ও বিবাদমান জাতিকে বিজয়ী করেন না। অথচ একতাবদ্ধ হলে এমন কি কাফিরদেরও বিজয় দেন।

 

 

বাঙালি মুসলিমের কদর্য ইতিহাস ও শিক্ষণীয় বিষয়

 

একাত্তরে বাঙালি মুসলিমগণ শুধু দেশ বিভক্তির পথ বেছে নেয়নি, বেছে নিয়েছে অতি নৃশংস কদর্যতার পথও।  বস্তুত বিভক্তি-পাগল বাঙালি মুসলিমের ঈমানশূণ্যতা, বিবেকশূণ্যতা ও মানবতাশূণ্যতা তীব্র ভাবে দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, বিগত ৫৪ বছর ধরে সে কদর্যতা সরকারি ও বেসরকারি ভাবে গোপন করার চেষ্টা হয়েছে। এবং একাত্তরের সকল রক্তপাত ও বর্বরতার জন্য পরিকল্পিত ভাবে অবাঙালিদের দায়ী করা হয়েছে। বাঙালিদের হাজির করা হয়েছে স্রেফ ভিকটিম রূপে। তাই ইতিহাসের বইয়ে কোথাও বাঙালি চরিত্রের কদর্যতা নিয়ে সামান্যতম আলোচনা নেই। অথচ বাঙালিগণ একাত্তরের পর দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়েছে। তারা জোয়ার এনেছে গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, আয়না ঘর এবং বার বার গণহত্যার। ১৯৭১’য়েও তারা পুতঃপবিত্র ছিল না। তাদের অপরাধের কাহিনী সামনে আসা উচিত। রোগ গোপন করলে তো চিকিৎসা হয়না। তাই সেগুলি মানুষের সামনে প্রকাশ করা উচিত। এতে অন্ততঃ বিবেকবান মানুষগুলি ভাবতে আগ্রহী হবে। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণে সে ভাবনার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, সকল সভ্য কর্মের শুরু তো ভাবনা থেকে।

 

তীব্র ঝড় আসলে অনেকের গায়ের কাপড় উড়িয়ে উলঙ্গ করে দেয়। তেমনি রাজনৈতিক দুর্যোগ আসলে অনেকের মানবতার মেকি মুখোশ উড়ে যায়। তখন তার আসল রূপটি দেখা যায়। বহু বাঙালির সে আসল রূপটি দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। স্রেফ ভাষা ও বর্ণ ভিন্ন হওয়ার কারণে বিহারী নারী, শিশু ও পুরুষেরা সে জংলী বাঙালি হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচিনি। এক লাখের বেশী বিহারীকে একাত্তরে হত্যা করা হয়েছে। তাদের ঘরে আগুন দিয়ে অনেককে সে আগুনে ফেলা হয়েছে। ঘরবাড়ি ও দোকান পাট কেড়ে নিয়ে বিহারীদের বস্তিতে পাঠানো হয়েছে। বিগত ৫৪ বছর যাবত তারা বস্তিতেই অবস্থান করছে। তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে সামান্যতম নাগরিক সুবিধা থেকে। হাজার হাজার বিহারী রমনি হয়েছে বাঙালি দুর্বৃত্তদের নিয়মিত ধর্ষণের শিকার। যারা পতিতা পল্লীতে যেত, তারা তাদের যৌন ক্ষুধা মিটিয়েছে অসহায় বিহারী রমনিদের নিয়মিত ধর্ষণ করে। পুরুষাঙ্গে ব্যাথা শুরু না পর্যন্ত এ দুর্বৃত্তরা ধর্ষণ থামায়নি -অনেক দুর্বৃত্ত তা নিয়ে গর্ব করতো। যাদের হাতে সেদিন অস্ত্র ছিল -তারা সে অস্ত্রকে দুর্বৃত্তিতে ব্যবহার করেছে।

 

কিন্তু সে অসহায় বিহারী নারী, পুরুষ ও শিশুদের রক্ষায় কোন বাঙালি এগিয়ে আসেনি। এগিয়ে এসেছে মুষ্টিমেয় কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। মুজিব সরকার, জিয়ার সরকার, এরশাদের সরকার -কোন সরকারই তাদের দুঃখ লাঘবে এগিয়ে আসেনি। রাষ্ট্রের সে কর্ণধারগণ সামান্যতম বিবেকের পরিচয় দেয়নি। তারা ব্যস্ত থেকেছে নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে। বিহারীদের বিরুদ্ধে সংঘটতি বর্বর অপরাধগুলি তাদের কাছে আদৌ অপরাধ গণ্য হয়নি। বরং সে অপরাধীদের তারা পুরস্কৃত করেছে বিহারীদের গৃহ, দোকানপাট তাদের নামে লিখে দিয়ে। কোন সভ্য সরকার কি কখনো এরূপ অসভ্য কাজ করে? কোন সুশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও মিডিয়া কর্মীর মাঝেও কোন দৃশ্যমান বিবেকের লক্ষণ দেখা যায়নি। জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও স্বার্থবাদ মানুষকে কতটা ঈমানশূণ্য ও বিবেকশূণ্য করতে পারে -এ হলো তারই নমুনা। এজন্যই ইসলামে এগুলি হারাম। অথচ সে হারাম তাড়না জেঁকে বাঙালি মুসলিমদের ঘাড়ে।

 

 

নবীজী (সা)‌’র পথ এবং শয়তানের পথ

 

অথচ নবীজী (সা:) রাষ্ট্র গড়েছেন নানা ভাষা, নানা গোত্র ও নানা এলাকার মানুষের এক অখণ্ড ভূগোলে বসবাসের অবাধ সুযোগ দিতে। মুসলিমগণ যতদিন সে একতাকে ধরে রাখতে পেরেছিল ততদিন তারা বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছিল। খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের আমলে মুসলিমদের নবীজী (সা:)’র সে সূন্নত বেঁচে ছিল। তখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর একটি মাত্র দেশ ছিল। সে দেশে আরব, ইরানী,তুর্কি, কুর্দি, হাবসী, মিশরীয়, মুর একত্রে বসবাস করেছে। কোন এক এলাকা বা শহর থেকে হাজার মাইল দূরের অন্য শহরে গিয়ে ঘর বাঁধতে আজকের ন্যায় কোন ভিসা লাগতো না। তাদের সে একতা মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত নামিয়ে এনেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের একতা চান; শয়তান চায় বিভক্তি। বিস্ময়ের বিষয় হলো, মুসলিমগণ শয়তানকে খুশি করাব পথ বেছে নিয়েছে।  বিভক্তি বাঁচাতে ৫০টির বেশী দেশ গড়েছে। প্রায় ৪০ কোটি আরব ২২টি আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে ১৯৪৭’য়ের অখণ্ড পাকিস্তান।

 

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান উন্নয়নে অর্থের বিকট অভাব দেখ দিলে কি হবে, বিভক্তির দেয়াল বাঁচাতে প্রতিটি  মুসলিম দেশেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়া তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল সেনাবাহিনী। মহান আল্লাহ তায়ালা গড়াকে ভাল বাসেন, ভাঙ্গাকে নয়।  অথচ মুসলিমগণ ভালবাসে ভাঙ্গাকে -সেটি ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে। মুসলিম বিশ্বের বিভক্তি মানচিত্র তারই প্রমাণ। বিভক্তি গড়ার অপরাধে প্রতিশ্রুত আযাবও তাই মুসলিমদের ঘিরে ধরেছে। নিছক নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করে এবং লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে কি সে শাস্তি থেকে মুক্তি মিলে? বুঝতে হবে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একতার বিকল্প নয়; ঐক্যের বিকল্প একমাত্র ঐক্য।

 

ঈমানদারীর পথ এবং বেঈমানীর পথ

 

একতার তাড়না হলো ঈমানের দৃশ্যমান রূপ; আর বিভক্তি হলো বেঈমানীর। মুসলিম উম্মাহর বিভক্ত মানচিত্র প্রমাণ করে তারা বেছে নিয়েছে বেঈমানীর পথ; এবং বেঈমানীর পথটি হলো আযাবের পথ। সে আযাব হাজির হয়েছে মুসলিম বিশ্বের কোণে কোণে। এবং সবচেয়ে বড় আযাব অপেক্ষা করছে আখেরাতে। কারণ, মহান আল্লাহ তায়ালা কখনোই তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। আর বিভক্তির প্রতিশ্রুত শাস্তি তো ভয়ানক আযাব -যা ঘোষিত হয়েছে সুরা আল ইমরানের উপরিউক্ত আয়াতে। তবে জীবিতদের জন্য তাওবা করার ও সংশোধনের এখনো সময় আছে। বিভক্তির আযাব থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি ঈমানদারের সর্ব সামর্থ্যের বিনিয়োগ হওয়া উচিত মুসলিম উম্মাহর একতা প্রতিষ্ঠায়। প্রতিশ্রুত আযাব থেকে বাঁচার এ ছাড়া ভিন্ন পথ নাই।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

মুসলিম উম্মাহর অনৈক্য ও অর্জিত আযাব

Update Time : ০২:৫৫:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ফরজ হলো একতা এবং হারাম হলো বিভক্তি

 

পবিত্র কুর’আনে যখন কোন নির্দেশ দেয়া হয় -তখন সেটি প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ হয়ে যায়। আর যখন কোন কিছু নিষেধ করার হয় -তখন সেটি হারাম হয়ে যায়। পবিত্র কুর’আন এভাবেই হালাল-হারামের পথ দেখায়। মুসলিমদের মাঝে একতা গড়াকে ফরজ এবং বিভক্তি গড়াকে হারাম করা হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ১০৩ আয়াতে। এ প্রসঙ্গে মহান রব’য়ের নির্দেশ হলো:

 

وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟

 

অর্থ: “এবং তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রশিকে শক্ত ভাবে ধরো এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।”

 

এভাবেই বিভক্ত হওয়াকে মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের জন্য হারাম করেছেন। সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে বিভক্তির শাস্তি রূপে প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে ভয়ানক আযাবের। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায়নি, এবং বাঁচছে মহান আল্লাহ তায়ালা নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে। সে বিদ্রোহের বিদ্রোহের মাত্রা এতটাই প্রবল যে, তারা দল গড়ে, রাজনীতি করে এবং যুদ্ধ করে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ও গোত্রের নামে  বিভক্তির দেয়াল গড়ার লক্ষ্যে। ফলে মুসলিমগণ বিভক্তির দেয়াল গড়েছে ৫৭টি দেশের মানচিত্রের নামে। এরূপ বিভক্তির কারণে মুসলিমদের শক্তি বাড়েনি। বরং বেড়েছে পরাজয়, অপমান ও জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে হারিয়েছে গুরুত্ব ও ইজ্জত। বিভক্তি নিয়ে বাঁচার কারণে ১৫০ কোটির বেশী এতোটাই তুচ্ছ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাদের কথা জাতিসংঘসহ কোন মহলেই গুরুত্ব পায়না। অপর দিকে মহান রব’য়ের হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে বাঁচার  জন্য প্রতিশ্রুত শাস্তি অপেক্ষা করেছে আখেরাতে।

 

বুঝতে হবে, প্রতিটি হারামের পথই সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুতির পথ তথা জাহান্নামের পথ। তাই যারা ভাষা, গোত্র, এলাকা, ফেরকা ও দলের নামে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তির দেয়াল গড়ে -তারা বস্তুত জনগণকে জাহান্নামে নেয়ার রাস্তা নির্মাণ করে। শয়তান ও ইসলামের শত্রুপক্ষ তো সেটাই চায়। বিভক্তি যে ভয়ানক আযাব ডেকে আনে -তা নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণাটি হলো:

 

وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ

 

অর্থ: “এবং তাদের মত হয়োনা যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে বিভক্ত হলো এবং বিবাদে লিপ্ত হলো; এরাই হলো তারা যাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)।

 

উপরিউক্ত আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুত আযাবের মুখে পড়তে মূর্তিপূজারী, নাস্তিক, খুনি বা চোর-ডাকাত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সে জন্য বিভক্তি ও বিবাদে লিপ্ত হওয়াটাই যথেষ্ট। তাই যারা বিভক্তির পথ বেছে নিল অথচ আযাবে পতিত পড়লে না -সেটি বিরল। নিজেদের মাঝে বিবাদ ও বিভক্তির কারণেই স্পেন থেকে মুসলিমদের প্রায় ৭ শত বছরের শাসন বিলুপ্ত হয়েছে। সে দেশে নিহত হয়েছে লাখ লাখ মুসলিম এবং ধর্ষিতা হয়েছে হাজার হাজার মুসলিম রমনী। অথচ সে সময় স্পেনের মুসলিমগণ দরিদ্র ছিল না। বরং বিপুল প্রাচুর্য ছিল সম্পদের, এবং বিশাল ভাণ্ডার ছিল অস্ত্রের। তারা নির্মাণ করেছিল বড় বড় প্রাসাদ এবং দুর্গ। কিন্তু অভাব ছিল একতার। রাজপরিবারের ক্ষমতালিপ্সু সদস্যদের মাঝে প্রায়ই ষড়যন্ত্র ও গৃহ যুদ্ধ লেগে থাকতো। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন কি পার্শ্ববর্তী খৃষ্টান রাজার  কাছে তারা সাহায্য ভিক্ষা করতো এবং সাহায্য নিয়ে রাজার আসনে বসে পুত্র তার নিজের পিতাকে এবং ভাই তার নিজ ভাইকে হত্যা করতো। অথচ শত্রুগণ ছিল একতাবদ্ধ। এক খৃষ্টান রাজ্যের রানী ইসাবেলা অন্য খৃষ্টান রাজ্যের রাজা ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করে নিজেদের রাজ্যকে বড় করেছে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালার সূন্নত হলো, তিনি কখনোই বিভক্ত ও বিবাদমান জাতিকে বিজয়ী করেন না। অথচ একতাবদ্ধ হলে এমন কি কাফিরদেরও বিজয় দেন।

 

 

বাঙালি মুসলিমের কদর্য ইতিহাস ও শিক্ষণীয় বিষয়

 

একাত্তরে বাঙালি মুসলিমগণ শুধু দেশ বিভক্তির পথ বেছে নেয়নি, বেছে নিয়েছে অতি নৃশংস কদর্যতার পথও।  বস্তুত বিভক্তি-পাগল বাঙালি মুসলিমের ঈমানশূণ্যতা, বিবেকশূণ্যতা ও মানবতাশূণ্যতা তীব্র ভাবে দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, বিগত ৫৪ বছর ধরে সে কদর্যতা সরকারি ও বেসরকারি ভাবে গোপন করার চেষ্টা হয়েছে। এবং একাত্তরের সকল রক্তপাত ও বর্বরতার জন্য পরিকল্পিত ভাবে অবাঙালিদের দায়ী করা হয়েছে। বাঙালিদের হাজির করা হয়েছে স্রেফ ভিকটিম রূপে। তাই ইতিহাসের বইয়ে কোথাও বাঙালি চরিত্রের কদর্যতা নিয়ে সামান্যতম আলোচনা নেই। অথচ বাঙালিগণ একাত্তরের পর দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়েছে। তারা জোয়ার এনেছে গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, আয়না ঘর এবং বার বার গণহত্যার। ১৯৭১’য়েও তারা পুতঃপবিত্র ছিল না। তাদের অপরাধের কাহিনী সামনে আসা উচিত। রোগ গোপন করলে তো চিকিৎসা হয়না। তাই সেগুলি মানুষের সামনে প্রকাশ করা উচিত। এতে অন্ততঃ বিবেকবান মানুষগুলি ভাবতে আগ্রহী হবে। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণে সে ভাবনার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, সকল সভ্য কর্মের শুরু তো ভাবনা থেকে।

 

তীব্র ঝড় আসলে অনেকের গায়ের কাপড় উড়িয়ে উলঙ্গ করে দেয়। তেমনি রাজনৈতিক দুর্যোগ আসলে অনেকের মানবতার মেকি মুখোশ উড়ে যায়। তখন তার আসল রূপটি দেখা যায়। বহু বাঙালির সে আসল রূপটি দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। স্রেফ ভাষা ও বর্ণ ভিন্ন হওয়ার কারণে বিহারী নারী, শিশু ও পুরুষেরা সে জংলী বাঙালি হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচিনি। এক লাখের বেশী বিহারীকে একাত্তরে হত্যা করা হয়েছে। তাদের ঘরে আগুন দিয়ে অনেককে সে আগুনে ফেলা হয়েছে। ঘরবাড়ি ও দোকান পাট কেড়ে নিয়ে বিহারীদের বস্তিতে পাঠানো হয়েছে। বিগত ৫৪ বছর যাবত তারা বস্তিতেই অবস্থান করছে। তাদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে সামান্যতম নাগরিক সুবিধা থেকে। হাজার হাজার বিহারী রমনি হয়েছে বাঙালি দুর্বৃত্তদের নিয়মিত ধর্ষণের শিকার। যারা পতিতা পল্লীতে যেত, তারা তাদের যৌন ক্ষুধা মিটিয়েছে অসহায় বিহারী রমনিদের নিয়মিত ধর্ষণ করে। পুরুষাঙ্গে ব্যাথা শুরু না পর্যন্ত এ দুর্বৃত্তরা ধর্ষণ থামায়নি -অনেক দুর্বৃত্ত তা নিয়ে গর্ব করতো। যাদের হাতে সেদিন অস্ত্র ছিল -তারা সে অস্ত্রকে দুর্বৃত্তিতে ব্যবহার করেছে।

 

কিন্তু সে অসহায় বিহারী নারী, পুরুষ ও শিশুদের রক্ষায় কোন বাঙালি এগিয়ে আসেনি। এগিয়ে এসেছে মুষ্টিমেয় কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। মুজিব সরকার, জিয়ার সরকার, এরশাদের সরকার -কোন সরকারই তাদের দুঃখ লাঘবে এগিয়ে আসেনি। রাষ্ট্রের সে কর্ণধারগণ সামান্যতম বিবেকের পরিচয় দেয়নি। তারা ব্যস্ত থেকেছে নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে। বিহারীদের বিরুদ্ধে সংঘটতি বর্বর অপরাধগুলি তাদের কাছে আদৌ অপরাধ গণ্য হয়নি। বরং সে অপরাধীদের তারা পুরস্কৃত করেছে বিহারীদের গৃহ, দোকানপাট তাদের নামে লিখে দিয়ে। কোন সভ্য সরকার কি কখনো এরূপ অসভ্য কাজ করে? কোন সুশীল বাঙালি বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও মিডিয়া কর্মীর মাঝেও কোন দৃশ্যমান বিবেকের লক্ষণ দেখা যায়নি। জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও স্বার্থবাদ মানুষকে কতটা ঈমানশূণ্য ও বিবেকশূণ্য করতে পারে -এ হলো তারই নমুনা। এজন্যই ইসলামে এগুলি হারাম। অথচ সে হারাম তাড়না জেঁকে বাঙালি মুসলিমদের ঘাড়ে।

 

 

নবীজী (সা)‌’র পথ এবং শয়তানের পথ

 

অথচ নবীজী (সা:) রাষ্ট্র গড়েছেন নানা ভাষা, নানা গোত্র ও নানা এলাকার মানুষের এক অখণ্ড ভূগোলে বসবাসের অবাধ সুযোগ দিতে। মুসলিমগণ যতদিন সে একতাকে ধরে রাখতে পেরেছিল ততদিন তারা বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছিল। খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের আমলে মুসলিমদের নবীজী (সা:)’র সে সূন্নত বেঁচে ছিল। তখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর একটি মাত্র দেশ ছিল। সে দেশে আরব, ইরানী,তুর্কি, কুর্দি, হাবসী, মিশরীয়, মুর একত্রে বসবাস করেছে। কোন এক এলাকা বা শহর থেকে হাজার মাইল দূরের অন্য শহরে গিয়ে ঘর বাঁধতে আজকের ন্যায় কোন ভিসা লাগতো না। তাদের সে একতা মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত নামিয়ে এনেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের একতা চান; শয়তান চায় বিভক্তি। বিস্ময়ের বিষয় হলো, মুসলিমগণ শয়তানকে খুশি করাব পথ বেছে নিয়েছে।  বিভক্তি বাঁচাতে ৫০টির বেশী দেশ গড়েছে। প্রায় ৪০ কোটি আরব ২২টি আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে ১৯৪৭’য়ের অখণ্ড পাকিস্তান।

 

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান উন্নয়নে অর্থের বিকট অভাব দেখ দিলে কি হবে, বিভক্তির দেয়াল বাঁচাতে প্রতিটি  মুসলিম দেশেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়া তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল সেনাবাহিনী। মহান আল্লাহ তায়ালা গড়াকে ভাল বাসেন, ভাঙ্গাকে নয়।  অথচ মুসলিমগণ ভালবাসে ভাঙ্গাকে -সেটি ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে। মুসলিম বিশ্বের বিভক্তি মানচিত্র তারই প্রমাণ। বিভক্তি গড়ার অপরাধে প্রতিশ্রুত আযাবও তাই মুসলিমদের ঘিরে ধরেছে। নিছক নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করে এবং লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে কি সে শাস্তি থেকে মুক্তি মিলে? বুঝতে হবে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একতার বিকল্প নয়; ঐক্যের বিকল্প একমাত্র ঐক্য।

 

ঈমানদারীর পথ এবং বেঈমানীর পথ

 

একতার তাড়না হলো ঈমানের দৃশ্যমান রূপ; আর বিভক্তি হলো বেঈমানীর। মুসলিম উম্মাহর বিভক্ত মানচিত্র প্রমাণ করে তারা বেছে নিয়েছে বেঈমানীর পথ; এবং বেঈমানীর পথটি হলো আযাবের পথ। সে আযাব হাজির হয়েছে মুসলিম বিশ্বের কোণে কোণে। এবং সবচেয়ে বড় আযাব অপেক্ষা করছে আখেরাতে। কারণ, মহান আল্লাহ তায়ালা কখনোই তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। আর বিভক্তির প্রতিশ্রুত শাস্তি তো ভয়ানক আযাব -যা ঘোষিত হয়েছে সুরা আল ইমরানের উপরিউক্ত আয়াতে। তবে জীবিতদের জন্য তাওবা করার ও সংশোধনের এখনো সময় আছে। বিভক্তির আযাব থেকে মুক্তি পেতে প্রতিটি ঈমানদারের সর্ব সামর্থ্যের বিনিয়োগ হওয়া উচিত মুসলিম উম্মাহর একতা প্রতিষ্ঠায়। প্রতিশ্রুত আযাব থেকে বাঁচার এ ছাড়া ভিন্ন পথ নাই।