০১:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

একাত্তরের বয়ান নির্মূলে ব্যর্থ হলে বিপন্ন হবে স্বাধীনতা

মতামত
  • Update Time : ১১:৪৬:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫
  • / ১৪২ Time View

                                                                                                                   

 

বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা  

আজ ১৪ আগস্ট। বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে এ দিনটিই হলো প্রথম স্বাধীনতা দিবস। ৭৭ বছর আগে এদিনে স্বাধীনতা মিলেছিল ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের গোলামী থেকে। সেদিন নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান -যা আজ অখণ্ডতা নিয়ে বেঁচে থাকলে চীন ও ভারতের পর হতো জনসংখ্যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের নির্মাণ ছিল বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙালি মুসলিম পেয়েছিল সে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসার সুযোগ। অখণ্ড পাকিস্তানের ২৪ বছরে ৪ জন প্রধানমন্ত্রী ২ জন রাষ্ট্রপ্রধান, ৩ জন স্পীকার এবং বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন বাঙালি মুসলিম। প্রচুর সুযোগ এসেছিল বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার। এর আগে বাঙালি মুসলিমগণ নিজ দেশ শাসন করার সুযোগও পায়নি।

কিন্তু শত্রুদের কাছে বাঙালি মুসলিমের সে বিশাল মর্যাদা ভাল লাগেনি। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি ছিল যেহেতু বাঙালি মুসলিমের, ফলে অখণ্ড ভারতের চেতনাধারীদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল এই বাঙালি মুসলিম। ফলে প্রতিশোধ নেয়ায় শত্রু পক্ষের আগ্রহটিও ছিল প্রকট। শুরু হয় পাকিস্তানের বিনাশে পৌত্তলিক শক্তির ষড়যন্ত্র। ১৯৭১’য়ে শত্রুর সে ষড়যন্ত্র বিজয়ী হয়। বাঙালি মুসলিম বিরুদ্ধে এটিই হলো ইতিহাসের দ্বিতীয় বড় নাশকতা। প্রথম নাশকতাটি ঘটেছিল ইংরেজদের হাতে ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে। তখন অস্তমিত হয়েছিল স্বাধীনতা।

এ পৃথিবী পৃষ্ঠে শয়তানের সবচেয়ে বৃহৎ ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত বাহিনী হলো ভারতের হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিকগণ। মুসলিমদের প্রায় ৭ শত বছরের শাসনও তাদেরকে সনাতন জাহিলিয়াতকে হটাতে পারিনি। এরা যেমন আল্লাহর শত্রু, তেমনি মুসলিমদের শত্রু। তাই তারা আল্লাহর ঘর মসজিদ যেমন গুড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি মুসলিম নির্মূলে গণহত্যা চালাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে বিশাল ইসরাইল হলো আজকের ভারত। ইহুদীরা যেমন বৃহৎ ইসরাইল চায়, ভারত তেমনি অখণ্ড ভারত চায়। ভারতীয় হিন্দুগণ পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, দেশটি বেঁচে থাকুক -সেটিও চায়নি। শুরু থেকেই ভারতের এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা। ভারত তার এজেন্ডা পূরণে বাংলার বুকে বিপুল সংখ্যক সহযোদ্ধাও পেয়ে যায়। তারা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফাসিস্টদের দল আওয়ামী লীগ, বামপন্থীদের দল ন্যাপ এবং কম্যুনিস্টদের অনেকগুলি গুপ্ত সংগঠন। কোন ইসলামী দল, কোন পীর, কোন আলেম, মসজিদের কোন ইমাম এ শিবিরে যোগ দেয়নি। কারণ পৌত্তলিকদের প্রকল্প যে কখনোই মুসলিমদের স্বার্থে হতে পারে না -সে সত্যটি মুসলিম মাত্রই জানতো।  

১৯৪৭’য়ে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া চেয়ে অধিক। অথচ ভারতে তখন প্রতি বছর দুর্ভিক্ষ লেগে থাকতো। আয়োতনে বিশাল হলেও সামরিক দিক দিয়ে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে শক্তশালী ছিলনা। ফলে ১৯৪৮ ও  ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ বিশাল ভারত তাই পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারিনি। কিন্তু পাকিস্তান খণ্ডিত করার নেশা ভারত কখনোই ছাড়েনি। সে স্নায়ু যুদ্ধের যুগে ভারত সহযোগী পায় আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও। পাকিস্তান ছিল মার্কিন বলয়ের দেশ। ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পকে বিজয়ী করতে প্রবল আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় এক বিশ্বশক্তি। বিপুল অস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান দিয়ে ভারতকে সাহয্য করে সোভিয়েত রাশিয়া।       

১৪ আগস্টের আগে বাঙালি মুসলিমের প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার মহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের ফলে। তখন বাঙালি মুসলিম মুক্তি পেয়েছিল রাজা লক্ষণ সেনের পৌত্তলিক অধিকৃতি থেকে।  ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বর হলো ভারতের বিজয় দিবস এবং এই দিন থেকে শুরু হয় বাঙালি মুসলিম ভূমির উপর হিন্দুত্ববাদীদের দ্বিতীয় অধিকৃতি। তখন থেকে বাঙালি মুসলিম জীবনে শুরু হয় দ্বিতীয় পরাধীনতা। প্রথম পরাধীনতা এসেছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর। ভারতীয় পৌত্তলিক অধিকৃতি থেকে মুক্তি মেলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। তাই ২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট হলো বাঙালি মুসলিমদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস।

 

স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস নিয়ে মিথ্যাচার

২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস -এটি এক মিথ্যা ভারতীয় বয়ান। ঐদিন বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। তখনও এ দেশটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। একটি ভূ-খণ্ডকে তো একমাত্র তখনই স্বাধীন রাষ্ট্র বলা যায় যখন তার স্বাধীন ভূমি থাকে, সরকার থাকে, প্রশাসনিক ও রাজধানী থাকে এবং দেশের উপর আইনের শাসন প্রয়োগের ক্ষমতা থাকে। ২৬ শে মার্চ একটি ঘোষণা ছিল মাত্র, কিন্তু কোথাও স্বাধীনতা ঘোষণা দানকারীদের অফিস করার মত জায়গা ছিল না। আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ শুরু আগে মুক্তি বাহিনী কোন জেলা বা মহাকুমা দূরে থাক, একটি থানাও দখলে নিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশে বিশাল মিথ্যাচার হয় ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস নিয়ে।  

মিথ্যাচার হয় ১৬ ডিসেম্বর নিয়েও। এ দিনটিকে বলা হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির বিজয় দিবস রূপে। অথচ বিজয়টি বাঙালির বা বাংলাদেশীদের ছিল না, বিজয়টি ছিল একান্তই ভারতের। যে মুক্তিবাহিনী নিজ শক্তিতে একটি থানা  স্বাধীন করতে পারলো না, সে বিজয় নিয়ে উৎসব করে কোন কিরূপে? আসলে ১৬ই ডিসেম্বর হলো পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা দিবস – শরীয়তের দৃষ্টিতে যা শতভাগ হারাম। যে কোন ঈমানদারের কাছে এ দিনটি গভীর বেদনা ও শোকের দিবস। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলিমদের সাথে ভারত, কাশ্মীর ও আরাকানের মুসলিমগণ সেদিন কেঁদেছে। শোকাহত হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম। পৌত্তলিক কাফিরদের হাতে একটি মুসলিম দেশ ভেঙ্গে গেল, অথচ দুঃখ পেল না -সেটি অভাবনীয়। সেটি কেবল ঈমানের মৃত্যুতেই সম্ভব। এটিই হলো ২০১৩ সালের  শাহবাগীদের সাংস্কৃতিক চেতনা। এমন চেতনাধারীরা হিন্দুদের দুর্গা পূজা উৎসবকে সকল বাঙালির উৎসব মনে করে।

শেখ ‌মুজিব ভারতের ১৬ ডিসেম্বরের সামরিক বিজয় নিয়ে উৎসব করতে বাংলাদেশীদের বাধ্য করেছিল। সেটি ছিল নিরেট ভারতীয় বিজয়কে বাঙালি মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার অপচেষ্টা। কারণ, ভারতীয় নীতি নির্ধারকগণ নিশ্চিত জানতো, ভারতীয় পৌত্তলিকদের এ বিজয় ইসলাম থেকে দূরে সরা বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট, নাস্তিক ও সেক্যুলারিস্টদের কাছে যতই গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, তা কখনোই কোন ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পৌত্তলিকদের এ সামরিক বিজয় মুসলিমদের কাছে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তাই ভারতের সে বিজয়ে বাঙালি মুসলিমের ভাগীদার বানানোর ষড়যন্ত্র রূপে হাজির করা হয় ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের উৎসব।  

 

মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের নাশকতা

মুসলিম উম্মাহর বড় বড় ক্ষতি গুলি শুধু কাফিরদের হাতে হয়নি, বরং হয়েছে মুনাফিকদের হাতেও। ১৯১৭’য়ে খেলাফত ভাঙ্গা এবং ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙার জন্য মুসলিমের মুখোশ নিয়ে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধ করেছিল এরা সবাই ছিল ইসলামের শত্রু। এমন কাজ কখনোই কোন মুসলিমের হতে পারে না। এরা খেলাফত ভেঙ্গেছে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। এভাবে বিভক্তি ও দুর্বলতা বাড়িয়েছে মুসলিম উম্মাহর। তারা নামে মুসলিম হলেও কাজটি ছিল কাফিরদের ন্যায়। তাদের মনে মুসলিমের স্বার্থ বা ইসলামের গৌরববৃদ্ধির বিষয়টি আদৌ স্থান পায়নি। তাদের যুদ্ধ ছিল মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে বেঈমানীর দৃশ্যমান রূপ। মুসলিমের মুখোশধারী এমন শত্রুদের ইসলামে মুনাফিক বলা হয়।

একটি মুসলিম দেশে বৈষম্য, দুঃশাসন, জুলুম, গণহত্যা, অবিচার থাকতেই পারে। সেগুলি উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানিয়া আমলেও ছিল। তবে সেগুলি কখনোই মুসলিম দেশভাঙ্গার ন্যায় বিশাল নাশকতাকে জায়েজ করেনা। জায়েজ করা হলে খেলাফত শত শত বছর বাঁচতো না। বস্তুত যে নাশকতাগুলি মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে -সেগুলিকে ইসলামে ফিতনা বলা হয়। পবিত্র কুর’আনে ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলা হয়েছে। কারণ ফেতনার নাশকতা গণহত্যার চেয়েও ভয়ানক। তাই ২৫শে মার্চ ঢাকায় যে গণহত্যা হয়েছে সেটি কখনোই পাকিস্তান ভাঙ্গার দলিল হতে পারে না। যারা সেটিকে দলিল বানিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে জায়েজ করে -তারা নিশ্চিত কুর’আনী জ্ঞানে অজ্ঞ। সে সাথে তারা অক্ষম মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের বিষয়টি বুঝতে। এজন্যই একাত্তরে কোন আলেম ২৫শে মার্চের গণহত্যাকে দলিল বানিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে ফতোয়া দেননি। বরং পাকিস্তান ভাঙ্গাকে হারাম বলেছেন এবং পাকিস্তান বাঁচানোর যুদ্ধকে পবিত্র জিহাদ বলেছেন। ইসলামে ফরজ হলো যেমন বৈষম্য, দুঃশাসন, জুলুম, অবিচারের বিরুদ্ধে জিহাদ, তেমনি ফরজ হলো মুসলিম দেশের অখণ্ডতা বাঁচানোর জিহাদ।

 

রাজাকারের চেতনা ও শাহবাগী চেতনা

প্রতিটি যুদ্ধই দুটি চেতনা ও দুটি বয়ানের যুদ্ধ। বাংলাদেশের একটি বিরাজমান চেতনা হলো রাজকারদের চেতনা; অপরটি শাহবাগী চেতনা। শাহবাগী চেতনাটি মূলত একাত্তরের চেতনার অতি নৃশংস ফ্যাসিবাদী রূপ। এ চেতনায় বিরোধীদের জন্য থাকে গুম, খুন, ফাঁসি, আয়না ঘর, পুলিশী রিম্যান্ড এবং শাপলা চত্বরের গণহত্যা। এ চেতনা উৎপাদন করে আজ্ঞাবহ আদালত, লাঠিয়াল পুলিশ, সন্ত্রাসী DGFI ও RAB বাহিনী, ছাত্র লীগের হেলমেট বাহিনী এবং নৃশংস ফ্যাসিস্ট হাসিনা।

অপর দিকে রাজাকারের চেতনাটি জন্ম দেয় মর্দে মুজাহিদের। এ চেতনাটি মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতার সুরক্ষায় রক্তদান ও আত্মদানের চেতনা। এ চেতনা হাজার হাজার শহীদ উৎপাদন করে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চেতনার জোয়ার এসেছিল। সে জোয়ারে ভাসা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী স্লোগান তুলেছিল “আমি কে তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার” বলে। রাজাকারের ঈমানী প্রত্যয় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মোড়ই পাল্টে দেয়। বিপ্লব তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস  নয়, সারা দেশব্যাপী অপ্রতিরোধ্য গতি সঞ্চার করে। রাজাকারের চেতনার এই হলো ঈমানী শক্তি। শাহবাগী চেতনার ধারকগণ তখন ভয়ে হয় গর্তে ঢুকে, অথবা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। বস্তুত এ চেতনাই আগামী দিনে বাঁচাতে পারে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতাকে।         

রাজাকার তো তারাই যারা নিজ দেশের উপর কাফির দেশের হামলার প্রতিরোধে স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগে হাজির হয়। হায়দারাবাদের উপর ভারতীয় আগ্রাসন রূখতে যে মুসলিম যুবকগণ প্রতিরোধে খাড়া হয়েছিল তাদেরও বলা হত রাজাকার। রাজাকার ফার্সি শব্দ; অর্থ; স্বেচ্ছাসেবী। একাত্তরে বাঙালি রাজাকারগণ যুদ্ধে নেমেছিল ভারত ও তার সেবাদাসদের প্রতিরোধে। এরা এসেছিল বিভিন্ন ইসলামী ছাত্র সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন এবং পাকিস্তানপন্থী পরিবারগুলি থেকে। তাদের অনেকের বপা-দাদা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত ছিল। তারা ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণেই মুক্তিবাহিনী কোন জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাও দখল করতে পারিনি। কিন্তু রাজাকারদের হাতে ভারী অস্ত্র ছিল না অত্যাধিক অস্ত্রে সজ্জিত আড়াই লাখ ভারতী সেনাদের পরাজিত করার। ফলে সেদিন তারা সামরিক ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বহু হাজার রাজাকার সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল।

রাজাকরগণ ২০১৩’য়ের শাহবাগীদের কাছে অতি ঘৃণার পাত্র; কারণ তারা তাদের চেতনার শত্রু। শাহবাগীদের কাছে পাকিস্তান হলো এক অনাসৃষ্টি; ফলে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করাটিই অপরাধ। তাদের কাছে তারাও অপরাধী যারা ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নির্মাণ করেছিল। এজন্যই একাত্তরের চেতনাধারীদের রচিত ইতিহাসের শুরু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে, সে ইতিহাসে নবাব সলিমুল্লাহ,মাওলানা আকরাম খাঁ, নুরূল আমিন, মৌলভী তমিজুদ্দীন, সহরোওয়ার্দীর মত  ১৯০৬ ও ১৯৪৭ য়ের নায়কদের স্থান নাই।  তাদের কথা,  ইসলামের ও পাকিস্তানের পক্ষের যারা সৈনিক তাদের জন্ম যদি ১৯৭১’য়ের পরেও হয়, তবুও তারা রাজাকর। কারণ, তারা রাজাকারের চেতনাধারী। রাজাকার তাই একটি প্রতীকের নাম। প্রতীকটি ইসলামের শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিকের। রাজাকর মাত্রই তাই তাদের চক্ষুশূল।

বাঙালি মুসলিমের চরিত্র ও চেতনার ইসলামী রূপটি একমাত্র তখনই স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে যখন তারা একাত্তরের চেতনাধারী শাহবাগীদের ঘৃণা করে এবং শ্রদ্ধাভরে করে স্মরণ করে একাত্তরের রাজাকারদের। নামাজ রোজা তো লক্ষ লক্ষ ঘুষখোর, সূদখোর, প্রতারক ও বাকশালীরাও পালন করে। কিন্তু ঈমান তো তখন ধরা পড়ে যখন তাদের মাঝে ইসলামের শত্রুদের ঘৃণা এবং জিহাদী চেতনার মুজাহিদের ভালবাসার সামর্থ্য দৃশ্যমান হয়। ঈমান ও চরিত্রের বিশ্লেষণে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

মুক্তি বাহিনীর অজ্ঞতা ও অপরাধ কর্ম

মুক্তি বাহিনীর লোকেরা ছিল ইসলাম বিষয়ে প্রচণ্ড অজ্ঞ। তারা বেড়ে উঠেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ও বামপন্থী মহলে। নাচ, গান, যাত্রা, নাটক, সিনেমা ও সিনেমার চটুল গান নিয়ে ছিল তাদের সাংস্কৃতিক জগত। কুর’আন-হাদীসের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না। কোন মকতব বা মাদ্রাসায় তারা লেখাপড়া। করেনি। ফলে তাদের ছিল না ইসলামের মৌলিক জ্ঞান। নারায়ে তাকবির ও আল্লাহু আকবর তাদের মুখে আসতো না। তারা কখনোই ইসলামের বিজয় ও মুসলিমের গৌরব চাইতো না, স্লোগান তুলতো “জয় বাংলা‍” বলে। তারা বাঙালির বিজয় চাইতো, মুসলিমের নয়। ফলে পৌত্তলিক ভারতে গিয়ে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নেয়া এবং ভারতের এজেন্ডা পূরণে নিজ দেশের ভিতরে এসে নিরস্ত্র পাকিস্তানপন্থীদের হত্যা করা, রেলের ব্রিজ ও বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া, শান্তি কমিটির নিরস্ত্র সদস্যদের হত্যা করার ন্যায় অপরাধ কর্ম তাদের কাছে অতি সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এবং ১৬ ডিসেম্বরের পর তারা নামে বিহারী ও রাজাকার হত্যায় এবং লুটপাটে।   

কারো মনে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে সে কি কখনো কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গতে যুদ্ধ করতে পারে না। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের একতাকে ফরজ করেছেন এবং বিভক্তিকে হারাম করেছেন। এবং হারাম করেছেন পৌত্তলিক কাফের শক্তিকে বন্ধু রুপে গ্রহণ করা। পবিত্র কুরআনে এ নিয়ে সুস্পষ্ট হুকুম এসেছে সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর এবং সুরা মুমতেহানার ১ নম্বর আয়াতে।  কিন্তু শেখ মুজিব ইসলামের এই মৌল কথাটি নিজেও শেখেনি এবং অনুসারীদের কোন দিনই শেখায়নি। বরং আবাদ বাড়িয়েছে অজ্ঞতার। ফলে মুজিবের অনুসারীগণ হিন্দুত্ববাদী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের থেকে প্রতিপালন নিয়েছে এবং তাদের অস্ত্র ও অর্থ নিয়ে মুসলিম দেশভাঙ্গায় লক্ষ্যে একটি হারাম যুদ্ধ করেছে। এরূপ একটি ইসলামশূণ্য যুদ্ধে নিহত হলে কেউ যে শহীদ হয় না বরং নিশ্চিত জাহান্নামে যেতে হয় -সে প্রাথমিক জ্ঞনটুকুও তাদের ছিলনা। সে অজ্ঞতার কারণে এ মুর্খরা হিন্দুদেরও শহীদ বলে।

 

মুনাফিকি ও বেঈমানীর নাশকতা

 ১৯৭১’য়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি ছিল শতভাগ বেঈমানীর চেতনা। বেঈমানীটি ইসলামের মূল দর্শন ও চেতনার সাথে। এটি কোন ঈমানদারের দর্শন ও চেতনা হতে পারে না। ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধবিগ্রহে ইসলামকে বিজয়ী করার ভাবনা ও তাড়না নিয়ে বাঁচা। সেখানে জাতি, গোত্র, ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক চেতনা নিয়ে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধের কোন সুযোগ থাকে না। ইসলামে সেটি হারাম। অথচ সেক্যুলারিজম সেরূপ বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনাকে কখনো অনুমতি দেয়না; সেটিকে বরং সাম্প্রদায়িকতা বলা হয়। সেক্যুলারিজম ধর্মে অঙ্গীকারশূণ্য ও নিরপেক্ষ হতে বলে। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো প্রতি মুহুর্তে ইসলামের পক্ষ নেয়া এবং ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদে আত্মনিয়োগ নিয়ে বাঁচা। ফলে সেক্যুলার হওয়াতে অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া। তাই রাজনীতির অঙ্গণে ইসলাম থেকে দূরে সরা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী ধারায় ধাবিত হওয়া।

অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভারতমুখীতা নিয়ে হলো একাত্তরের চেতনা। ইসলামের পক্ষে জিহাদ করা এ চেতনায় নিষিদ্ধ। ‌তাই কোন মুসলিম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে পারেনা, সেটি হারাম। সে হারাম চেতনা ধারণ করে কেউ যদি নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করে তবে বুঝতে হবে সে মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতায়  কাফির ও মুনাফিকের মাঝে কোন পার্থক্য নাই। পার্থক্য শুধু এটুকু যে, কাফিরের কোন মুখোশ থাকে না; কিন্তু মুনাফিকের থাকে মুসলিমের মুখোশ। তাই একাত্তরের যুদ্ধে হিন্দু অফিসারগণ মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি করেছে, সে অভিন্ন ক্ষতিটি করেছে মুক্তিবাহিনীর মুসলিম নামধারী অফিসারটিও। কিন্তু হিন্দু অফিসারটি মুসলিম নামধারণ করে প্রতারণা করেনি। এজন্যই মুনাফিকগণ কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট। এজন্যই নিরস্ত্র বিহারী হত্যায় ও ধর্ষণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যে বীভৎস ও নৃশংস নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তা ভারতীয় কাফির সেনারা দেখায়নি।

 

নির্মূল করতে হবে শাহবাগী চেতনাকে 

একাত্তরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ন্যায় পাকিস্তান বিরোধী দলগুলির রাজনীতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাকিস্তান বিরোধী চেতনার রাজনীতি। তাতে ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ছিল রাজাকারদের নৃশংস ভাবে হত্যা এবং সে সাথে ছিল ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করার নীতি। এগুলি নিয়ে কখনোই কোন ঈমানদারের রাজনীতি হতে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ বেঈমানীর উপাদান। একাত্তরের চেতনাধারীদের দলীয় মেনিফেস্টোতে ইসলামের ও মুসলিম উম্মার কল্যাণের কোন বাণী ছিল না। একাত্তরে তাদের যা এজেন্ডা ছিল, সে অভিন্ন এজেন্ডাটি ছিল ভারতীয় পৌত্তলিকদেরও। আদর্শিক দিক দিয়ে তারা সহোদর। তাই ভারতীয় পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে তারা উৎসবের বিষয় মনে করে।

ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা ১৯৪৭’য়ে যেমন যেমন চায়নি। তেমনি ১৯৭১’য়েও চায়নি। এখনো চায়না। ভারত যা চায় তা হলো, বাংলাদেশের উপর  হাসিনার ন্যায় তার নিজ দাস-দাসীদের শাসন। সেখানে ইসলামপন্থীদের কোন স্বাধীনতা থাকবে না। ইসলামপন্থীদের জন্য স্থানটি হবে ফাঁসির মঞ্চ, আয়না ঘর বা কারাগর।  এটিই ছিল যেমন একাত্তরের চেতনা, সে অভিন্ন চেতনাটি ছিল  ২০১৩’য়ের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চেরও। এ চেতনাটি নিরপরাধ ইসলামপন্থিদের ফাঁসিতে ঝুলানো যেমন জায়েজ করেছিল, তেমনি জায়েজ করেছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরের গণহত্যাকে।

স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে ভারতসেবী এ বিষাক্ত সেক্যুলার চেতনাকে অবশ্যই নির্মূল করতেই হবে। এখানে আপোষের স্থান নেই। বিষাক্ত চেতনা শুধু একাকী বাঁচেনা, কোভিড ভাইরাসের মত এটি জীবননাশী রোগ উৎপাদন করে। সে বিষাক্ত সেক্যুলার চেতনার কারণে উসমানিয়া খেলাফত ও পাকিস্তান যেমন বাঁচেনি, বাঁচবে না বাংলাদেশও। এ চেতনার নির্মূলের কাজে ব্যর্থ হলে আবার ফিরে আসবে ভারতের গোলামদের শাসন -যেমন এসেছিল একাত্তরে।

             

———– ফিরোজ মাহবুব কামাল  ১৪/০৮/২০২৫

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

একাত্তরের বয়ান নির্মূলে ব্যর্থ হলে বিপন্ন হবে স্বাধীনতা

Update Time : ১১:৪৬:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫

                                                                                                                   

 

বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা  

আজ ১৪ আগস্ট। বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসে এ দিনটিই হলো প্রথম স্বাধীনতা দিবস। ৭৭ বছর আগে এদিনে স্বাধীনতা মিলেছিল ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের গোলামী থেকে। সেদিন নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান -যা আজ অখণ্ডতা নিয়ে বেঁচে থাকলে চীন ও ভারতের পর হতো জনসংখ্যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের নির্মাণ ছিল বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাঙালি মুসলিম পেয়েছিল সে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসার সুযোগ। অখণ্ড পাকিস্তানের ২৪ বছরে ৪ জন প্রধানমন্ত্রী ২ জন রাষ্ট্রপ্রধান, ৩ জন স্পীকার এবং বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন বাঙালি মুসলিম। প্রচুর সুযোগ এসেছিল বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার। এর আগে বাঙালি মুসলিমগণ নিজ দেশ শাসন করার সুযোগও পায়নি।

কিন্তু শত্রুদের কাছে বাঙালি মুসলিমের সে বিশাল মর্যাদা ভাল লাগেনি। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি ছিল যেহেতু বাঙালি মুসলিমের, ফলে অখণ্ড ভারতের চেতনাধারীদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল এই বাঙালি মুসলিম। ফলে প্রতিশোধ নেয়ায় শত্রু পক্ষের আগ্রহটিও ছিল প্রকট। শুরু হয় পাকিস্তানের বিনাশে পৌত্তলিক শক্তির ষড়যন্ত্র। ১৯৭১’য়ে শত্রুর সে ষড়যন্ত্র বিজয়ী হয়। বাঙালি মুসলিম বিরুদ্ধে এটিই হলো ইতিহাসের দ্বিতীয় বড় নাশকতা। প্রথম নাশকতাটি ঘটেছিল ইংরেজদের হাতে ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে। তখন অস্তমিত হয়েছিল স্বাধীনতা।

এ পৃথিবী পৃষ্ঠে শয়তানের সবচেয়ে বৃহৎ ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত বাহিনী হলো ভারতের হিন্দুত্ববাদী পৌত্তলিকগণ। মুসলিমদের প্রায় ৭ শত বছরের শাসনও তাদেরকে সনাতন জাহিলিয়াতকে হটাতে পারিনি। এরা যেমন আল্লাহর শত্রু, তেমনি মুসলিমদের শত্রু। তাই তারা আল্লাহর ঘর মসজিদ যেমন গুড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি মুসলিম নির্মূলে গণহত্যা চালাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে বিশাল ইসরাইল হলো আজকের ভারত। ইহুদীরা যেমন বৃহৎ ইসরাইল চায়, ভারত তেমনি অখণ্ড ভারত চায়। ভারতীয় হিন্দুগণ পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, দেশটি বেঁচে থাকুক -সেটিও চায়নি। শুরু থেকেই ভারতের এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা। ভারত তার এজেন্ডা পূরণে বাংলার বুকে বিপুল সংখ্যক সহযোদ্ধাও পেয়ে যায়। তারা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফাসিস্টদের দল আওয়ামী লীগ, বামপন্থীদের দল ন্যাপ এবং কম্যুনিস্টদের অনেকগুলি গুপ্ত সংগঠন। কোন ইসলামী দল, কোন পীর, কোন আলেম, মসজিদের কোন ইমাম এ শিবিরে যোগ দেয়নি। কারণ পৌত্তলিকদের প্রকল্প যে কখনোই মুসলিমদের স্বার্থে হতে পারে না -সে সত্যটি মুসলিম মাত্রই জানতো।  

১৯৪৭’য়ে প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া চেয়ে অধিক। অথচ ভারতে তখন প্রতি বছর দুর্ভিক্ষ লেগে থাকতো। আয়োতনে বিশাল হলেও সামরিক দিক দিয়ে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে শক্তশালী ছিলনা। ফলে ১৯৪৮ ও  ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ বিশাল ভারত তাই পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারিনি। কিন্তু পাকিস্তান খণ্ডিত করার নেশা ভারত কখনোই ছাড়েনি। সে স্নায়ু যুদ্ধের যুগে ভারত সহযোগী পায় আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও। পাকিস্তান ছিল মার্কিন বলয়ের দেশ। ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পকে বিজয়ী করতে প্রবল আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় এক বিশ্বশক্তি। বিপুল অস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান দিয়ে ভারতকে সাহয্য করে সোভিয়েত রাশিয়া।       

১৪ আগস্টের আগে বাঙালি মুসলিমের প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার মহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের ফলে। তখন বাঙালি মুসলিম মুক্তি পেয়েছিল রাজা লক্ষণ সেনের পৌত্তলিক অধিকৃতি থেকে।  ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বর হলো ভারতের বিজয় দিবস এবং এই দিন থেকে শুরু হয় বাঙালি মুসলিম ভূমির উপর হিন্দুত্ববাদীদের দ্বিতীয় অধিকৃতি। তখন থেকে বাঙালি মুসলিম জীবনে শুরু হয় দ্বিতীয় পরাধীনতা। প্রথম পরাধীনতা এসেছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর। ভারতীয় পৌত্তলিক অধিকৃতি থেকে মুক্তি মেলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। তাই ২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট হলো বাঙালি মুসলিমদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস।

 

স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস নিয়ে মিথ্যাচার

২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস -এটি এক মিথ্যা ভারতীয় বয়ান। ঐদিন বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। তখনও এ দেশটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। একটি ভূ-খণ্ডকে তো একমাত্র তখনই স্বাধীন রাষ্ট্র বলা যায় যখন তার স্বাধীন ভূমি থাকে, সরকার থাকে, প্রশাসনিক ও রাজধানী থাকে এবং দেশের উপর আইনের শাসন প্রয়োগের ক্ষমতা থাকে। ২৬ শে মার্চ একটি ঘোষণা ছিল মাত্র, কিন্তু কোথাও স্বাধীনতা ঘোষণা দানকারীদের অফিস করার মত জায়গা ছিল না। আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ শুরু আগে মুক্তি বাহিনী কোন জেলা বা মহাকুমা দূরে থাক, একটি থানাও দখলে নিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশে বিশাল মিথ্যাচার হয় ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস নিয়ে।  

মিথ্যাচার হয় ১৬ ডিসেম্বর নিয়েও। এ দিনটিকে বলা হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির বিজয় দিবস রূপে। অথচ বিজয়টি বাঙালির বা বাংলাদেশীদের ছিল না, বিজয়টি ছিল একান্তই ভারতের। যে মুক্তিবাহিনী নিজ শক্তিতে একটি থানা  স্বাধীন করতে পারলো না, সে বিজয় নিয়ে উৎসব করে কোন কিরূপে? আসলে ১৬ই ডিসেম্বর হলো পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা দিবস – শরীয়তের দৃষ্টিতে যা শতভাগ হারাম। যে কোন ঈমানদারের কাছে এ দিনটি গভীর বেদনা ও শোকের দিবস। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলিমদের সাথে ভারত, কাশ্মীর ও আরাকানের মুসলিমগণ সেদিন কেঁদেছে। শোকাহত হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম। পৌত্তলিক কাফিরদের হাতে একটি মুসলিম দেশ ভেঙ্গে গেল, অথচ দুঃখ পেল না -সেটি অভাবনীয়। সেটি কেবল ঈমানের মৃত্যুতেই সম্ভব। এটিই হলো ২০১৩ সালের  শাহবাগীদের সাংস্কৃতিক চেতনা। এমন চেতনাধারীরা হিন্দুদের দুর্গা পূজা উৎসবকে সকল বাঙালির উৎসব মনে করে।

শেখ ‌মুজিব ভারতের ১৬ ডিসেম্বরের সামরিক বিজয় নিয়ে উৎসব করতে বাংলাদেশীদের বাধ্য করেছিল। সেটি ছিল নিরেট ভারতীয় বিজয়কে বাঙালি মুসলিমদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার অপচেষ্টা। কারণ, ভারতীয় নীতি নির্ধারকগণ নিশ্চিত জানতো, ভারতীয় পৌত্তলিকদের এ বিজয় ইসলাম থেকে দূরে সরা বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট, নাস্তিক ও সেক্যুলারিস্টদের কাছে যতই গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, তা কখনোই কোন ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পৌত্তলিকদের এ সামরিক বিজয় মুসলিমদের কাছে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তাই ভারতের সে বিজয়ে বাঙালি মুসলিমের ভাগীদার বানানোর ষড়যন্ত্র রূপে হাজির করা হয় ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের উৎসব।  

 

মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের নাশকতা

মুসলিম উম্মাহর বড় বড় ক্ষতি গুলি শুধু কাফিরদের হাতে হয়নি, বরং হয়েছে মুনাফিকদের হাতেও। ১৯১৭’য়ে খেলাফত ভাঙ্গা এবং ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙার জন্য মুসলিমের মুখোশ নিয়ে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধ করেছিল এরা সবাই ছিল ইসলামের শত্রু। এমন কাজ কখনোই কোন মুসলিমের হতে পারে না। এরা খেলাফত ভেঙ্গেছে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। এভাবে বিভক্তি ও দুর্বলতা বাড়িয়েছে মুসলিম উম্মাহর। তারা নামে মুসলিম হলেও কাজটি ছিল কাফিরদের ন্যায়। তাদের মনে মুসলিমের স্বার্থ বা ইসলামের গৌরববৃদ্ধির বিষয়টি আদৌ স্থান পায়নি। তাদের যুদ্ধ ছিল মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে বেঈমানীর দৃশ্যমান রূপ। মুসলিমের মুখোশধারী এমন শত্রুদের ইসলামে মুনাফিক বলা হয়।

একটি মুসলিম দেশে বৈষম্য, দুঃশাসন, জুলুম, গণহত্যা, অবিচার থাকতেই পারে। সেগুলি উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানিয়া আমলেও ছিল। তবে সেগুলি কখনোই মুসলিম দেশভাঙ্গার ন্যায় বিশাল নাশকতাকে জায়েজ করেনা। জায়েজ করা হলে খেলাফত শত শত বছর বাঁচতো না। বস্তুত যে নাশকতাগুলি মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে -সেগুলিকে ইসলামে ফিতনা বলা হয়। পবিত্র কুর’আনে ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলা হয়েছে। কারণ ফেতনার নাশকতা গণহত্যার চেয়েও ভয়ানক। তাই ২৫শে মার্চ ঢাকায় যে গণহত্যা হয়েছে সেটি কখনোই পাকিস্তান ভাঙ্গার দলিল হতে পারে না। যারা সেটিকে দলিল বানিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে জায়েজ করে -তারা নিশ্চিত কুর’আনী জ্ঞানে অজ্ঞ। সে সাথে তারা অক্ষম মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের বিষয়টি বুঝতে। এজন্যই একাত্তরে কোন আলেম ২৫শে মার্চের গণহত্যাকে দলিল বানিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে ফতোয়া দেননি। বরং পাকিস্তান ভাঙ্গাকে হারাম বলেছেন এবং পাকিস্তান বাঁচানোর যুদ্ধকে পবিত্র জিহাদ বলেছেন। ইসলামে ফরজ হলো যেমন বৈষম্য, দুঃশাসন, জুলুম, অবিচারের বিরুদ্ধে জিহাদ, তেমনি ফরজ হলো মুসলিম দেশের অখণ্ডতা বাঁচানোর জিহাদ।

 

রাজাকারের চেতনা ও শাহবাগী চেতনা

প্রতিটি যুদ্ধই দুটি চেতনা ও দুটি বয়ানের যুদ্ধ। বাংলাদেশের একটি বিরাজমান চেতনা হলো রাজকারদের চেতনা; অপরটি শাহবাগী চেতনা। শাহবাগী চেতনাটি মূলত একাত্তরের চেতনার অতি নৃশংস ফ্যাসিবাদী রূপ। এ চেতনায় বিরোধীদের জন্য থাকে গুম, খুন, ফাঁসি, আয়না ঘর, পুলিশী রিম্যান্ড এবং শাপলা চত্বরের গণহত্যা। এ চেতনা উৎপাদন করে আজ্ঞাবহ আদালত, লাঠিয়াল পুলিশ, সন্ত্রাসী DGFI ও RAB বাহিনী, ছাত্র লীগের হেলমেট বাহিনী এবং নৃশংস ফ্যাসিস্ট হাসিনা।

অপর দিকে রাজাকারের চেতনাটি জন্ম দেয় মর্দে মুজাহিদের। এ চেতনাটি মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতার সুরক্ষায় রক্তদান ও আত্মদানের চেতনা। এ চেতনা হাজার হাজার শহীদ উৎপাদন করে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চেতনার জোয়ার এসেছিল। সে জোয়ারে ভাসা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী স্লোগান তুলেছিল “আমি কে তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার” বলে। রাজাকারের ঈমানী প্রত্যয় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মোড়ই পাল্টে দেয়। বিপ্লব তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস  নয়, সারা দেশব্যাপী অপ্রতিরোধ্য গতি সঞ্চার করে। রাজাকারের চেতনার এই হলো ঈমানী শক্তি। শাহবাগী চেতনার ধারকগণ তখন ভয়ে হয় গর্তে ঢুকে, অথবা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। বস্তুত এ চেতনাই আগামী দিনে বাঁচাতে পারে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতাকে।         

রাজাকার তো তারাই যারা নিজ দেশের উপর কাফির দেশের হামলার প্রতিরোধে স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগে হাজির হয়। হায়দারাবাদের উপর ভারতীয় আগ্রাসন রূখতে যে মুসলিম যুবকগণ প্রতিরোধে খাড়া হয়েছিল তাদেরও বলা হত রাজাকার। রাজাকার ফার্সি শব্দ; অর্থ; স্বেচ্ছাসেবী। একাত্তরে বাঙালি রাজাকারগণ যুদ্ধে নেমেছিল ভারত ও তার সেবাদাসদের প্রতিরোধে। এরা এসেছিল বিভিন্ন ইসলামী ছাত্র সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন এবং পাকিস্তানপন্থী পরিবারগুলি থেকে। তাদের অনেকের বপা-দাদা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত ছিল। তারা ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণেই মুক্তিবাহিনী কোন জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাও দখল করতে পারিনি। কিন্তু রাজাকারদের হাতে ভারী অস্ত্র ছিল না অত্যাধিক অস্ত্রে সজ্জিত আড়াই লাখ ভারতী সেনাদের পরাজিত করার। ফলে সেদিন তারা সামরিক ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বহু হাজার রাজাকার সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল।

রাজাকরগণ ২০১৩’য়ের শাহবাগীদের কাছে অতি ঘৃণার পাত্র; কারণ তারা তাদের চেতনার শত্রু। শাহবাগীদের কাছে পাকিস্তান হলো এক অনাসৃষ্টি; ফলে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করাটিই অপরাধ। তাদের কাছে তারাও অপরাধী যারা ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নির্মাণ করেছিল। এজন্যই একাত্তরের চেতনাধারীদের রচিত ইতিহাসের শুরু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে, সে ইতিহাসে নবাব সলিমুল্লাহ,মাওলানা আকরাম খাঁ, নুরূল আমিন, মৌলভী তমিজুদ্দীন, সহরোওয়ার্দীর মত  ১৯০৬ ও ১৯৪৭ য়ের নায়কদের স্থান নাই।  তাদের কথা,  ইসলামের ও পাকিস্তানের পক্ষের যারা সৈনিক তাদের জন্ম যদি ১৯৭১’য়ের পরেও হয়, তবুও তারা রাজাকর। কারণ, তারা রাজাকারের চেতনাধারী। রাজাকার তাই একটি প্রতীকের নাম। প্রতীকটি ইসলামের শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিকের। রাজাকর মাত্রই তাই তাদের চক্ষুশূল।

বাঙালি মুসলিমের চরিত্র ও চেতনার ইসলামী রূপটি একমাত্র তখনই স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে যখন তারা একাত্তরের চেতনাধারী শাহবাগীদের ঘৃণা করে এবং শ্রদ্ধাভরে করে স্মরণ করে একাত্তরের রাজাকারদের। নামাজ রোজা তো লক্ষ লক্ষ ঘুষখোর, সূদখোর, প্রতারক ও বাকশালীরাও পালন করে। কিন্তু ঈমান তো তখন ধরা পড়ে যখন তাদের মাঝে ইসলামের শত্রুদের ঘৃণা এবং জিহাদী চেতনার মুজাহিদের ভালবাসার সামর্থ্য দৃশ্যমান হয়। ঈমান ও চরিত্রের বিশ্লেষণে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

মুক্তি বাহিনীর অজ্ঞতা ও অপরাধ কর্ম

মুক্তি বাহিনীর লোকেরা ছিল ইসলাম বিষয়ে প্রচণ্ড অজ্ঞ। তারা বেড়ে উঠেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ও বামপন্থী মহলে। নাচ, গান, যাত্রা, নাটক, সিনেমা ও সিনেমার চটুল গান নিয়ে ছিল তাদের সাংস্কৃতিক জগত। কুর’আন-হাদীসের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না। কোন মকতব বা মাদ্রাসায় তারা লেখাপড়া। করেনি। ফলে তাদের ছিল না ইসলামের মৌলিক জ্ঞান। নারায়ে তাকবির ও আল্লাহু আকবর তাদের মুখে আসতো না। তারা কখনোই ইসলামের বিজয় ও মুসলিমের গৌরব চাইতো না, স্লোগান তুলতো “জয় বাংলা‍” বলে। তারা বাঙালির বিজয় চাইতো, মুসলিমের নয়। ফলে পৌত্তলিক ভারতে গিয়ে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নেয়া এবং ভারতের এজেন্ডা পূরণে নিজ দেশের ভিতরে এসে নিরস্ত্র পাকিস্তানপন্থীদের হত্যা করা, রেলের ব্রিজ ও বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া, শান্তি কমিটির নিরস্ত্র সদস্যদের হত্যা করার ন্যায় অপরাধ কর্ম তাদের কাছে অতি সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এবং ১৬ ডিসেম্বরের পর তারা নামে বিহারী ও রাজাকার হত্যায় এবং লুটপাটে।   

কারো মনে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে সে কি কখনো কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গতে যুদ্ধ করতে পারে না। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের একতাকে ফরজ করেছেন এবং বিভক্তিকে হারাম করেছেন। এবং হারাম করেছেন পৌত্তলিক কাফের শক্তিকে বন্ধু রুপে গ্রহণ করা। পবিত্র কুরআনে এ নিয়ে সুস্পষ্ট হুকুম এসেছে সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর এবং সুরা মুমতেহানার ১ নম্বর আয়াতে।  কিন্তু শেখ মুজিব ইসলামের এই মৌল কথাটি নিজেও শেখেনি এবং অনুসারীদের কোন দিনই শেখায়নি। বরং আবাদ বাড়িয়েছে অজ্ঞতার। ফলে মুজিবের অনুসারীগণ হিন্দুত্ববাদী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের থেকে প্রতিপালন নিয়েছে এবং তাদের অস্ত্র ও অর্থ নিয়ে মুসলিম দেশভাঙ্গায় লক্ষ্যে একটি হারাম যুদ্ধ করেছে। এরূপ একটি ইসলামশূণ্য যুদ্ধে নিহত হলে কেউ যে শহীদ হয় না বরং নিশ্চিত জাহান্নামে যেতে হয় -সে প্রাথমিক জ্ঞনটুকুও তাদের ছিলনা। সে অজ্ঞতার কারণে এ মুর্খরা হিন্দুদেরও শহীদ বলে।

 

মুনাফিকি ও বেঈমানীর নাশকতা

 ১৯৭১’য়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি ছিল শতভাগ বেঈমানীর চেতনা। বেঈমানীটি ইসলামের মূল দর্শন ও চেতনার সাথে। এটি কোন ঈমানদারের দর্শন ও চেতনা হতে পারে না। ঈমানদার হওয়ার অর্থই হলো রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধবিগ্রহে ইসলামকে বিজয়ী করার ভাবনা ও তাড়না নিয়ে বাঁচা। সেখানে জাতি, গোত্র, ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক চেতনা নিয়ে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধের কোন সুযোগ থাকে না। ইসলামে সেটি হারাম। অথচ সেক্যুলারিজম সেরূপ বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনাকে কখনো অনুমতি দেয়না; সেটিকে বরং সাম্প্রদায়িকতা বলা হয়। সেক্যুলারিজম ধর্মে অঙ্গীকারশূণ্য ও নিরপেক্ষ হতে বলে। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো প্রতি মুহুর্তে ইসলামের পক্ষ নেয়া এবং ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদে আত্মনিয়োগ নিয়ে বাঁচা। ফলে সেক্যুলার হওয়াতে অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া। তাই রাজনীতির অঙ্গণে ইসলাম থেকে দূরে সরা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী ধারায় ধাবিত হওয়া।

অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভারতমুখীতা নিয়ে হলো একাত্তরের চেতনা। ইসলামের পক্ষে জিহাদ করা এ চেতনায় নিষিদ্ধ। ‌তাই কোন মুসলিম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে পারেনা, সেটি হারাম। সে হারাম চেতনা ধারণ করে কেউ যদি নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করে তবে বুঝতে হবে সে মুনাফিক। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতায়  কাফির ও মুনাফিকের মাঝে কোন পার্থক্য নাই। পার্থক্য শুধু এটুকু যে, কাফিরের কোন মুখোশ থাকে না; কিন্তু মুনাফিকের থাকে মুসলিমের মুখোশ। তাই একাত্তরের যুদ্ধে হিন্দু অফিসারগণ মুসলিম উম্মাহর যে ক্ষতি করেছে, সে অভিন্ন ক্ষতিটি করেছে মুক্তিবাহিনীর মুসলিম নামধারী অফিসারটিও। কিন্তু হিন্দু অফিসারটি মুসলিম নামধারণ করে প্রতারণা করেনি। এজন্যই মুনাফিকগণ কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট। এজন্যই নিরস্ত্র বিহারী হত্যায় ও ধর্ষণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যে বীভৎস ও নৃশংস নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তা ভারতীয় কাফির সেনারা দেখায়নি।

 

নির্মূল করতে হবে শাহবাগী চেতনাকে 

একাত্তরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ন্যায় পাকিস্তান বিরোধী দলগুলির রাজনীতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাকিস্তান বিরোধী চেতনার রাজনীতি। তাতে ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ছিল রাজাকারদের নৃশংস ভাবে হত্যা এবং সে সাথে ছিল ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করার নীতি। এগুলি নিয়ে কখনোই কোন ঈমানদারের রাজনীতি হতে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ বেঈমানীর উপাদান। একাত্তরের চেতনাধারীদের দলীয় মেনিফেস্টোতে ইসলামের ও মুসলিম উম্মার কল্যাণের কোন বাণী ছিল না। একাত্তরে তাদের যা এজেন্ডা ছিল, সে অভিন্ন এজেন্ডাটি ছিল ভারতীয় পৌত্তলিকদেরও। আদর্শিক দিক দিয়ে তারা সহোদর। তাই ভারতীয় পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে তারা উৎসবের বিষয় মনে করে।

ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা ১৯৪৭’য়ে যেমন যেমন চায়নি। তেমনি ১৯৭১’য়েও চায়নি। এখনো চায়না। ভারত যা চায় তা হলো, বাংলাদেশের উপর  হাসিনার ন্যায় তার নিজ দাস-দাসীদের শাসন। সেখানে ইসলামপন্থীদের কোন স্বাধীনতা থাকবে না। ইসলামপন্থীদের জন্য স্থানটি হবে ফাঁসির মঞ্চ, আয়না ঘর বা কারাগর।  এটিই ছিল যেমন একাত্তরের চেতনা, সে অভিন্ন চেতনাটি ছিল  ২০১৩’য়ের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চেরও। এ চেতনাটি নিরপরাধ ইসলামপন্থিদের ফাঁসিতে ঝুলানো যেমন জায়েজ করেছিল, তেমনি জায়েজ করেছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরের গণহত্যাকে।

স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে ভারতসেবী এ বিষাক্ত সেক্যুলার চেতনাকে অবশ্যই নির্মূল করতেই হবে। এখানে আপোষের স্থান নেই। বিষাক্ত চেতনা শুধু একাকী বাঁচেনা, কোভিড ভাইরাসের মত এটি জীবননাশী রোগ উৎপাদন করে। সে বিষাক্ত সেক্যুলার চেতনার কারণে উসমানিয়া খেলাফত ও পাকিস্তান যেমন বাঁচেনি, বাঁচবে না বাংলাদেশও। এ চেতনার নির্মূলের কাজে ব্যর্থ হলে আবার ফিরে আসবে ভারতের গোলামদের শাসন -যেমন এসেছিল একাত্তরে।

             

———– ফিরোজ মাহবুব কামাল  ১৪/০৮/২০২৫