১০:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

নোয়াখালী বিভাগ চাই: যেখানে নারী ও মানুষের মর্যাদা পাবে নতুন আলো

Reporter Name
  • Update Time : ১২:২৭:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫
  • / ৬৫ Time View
মোহাম্মদ হানিফ নোয়াখালী  প্রতিনিধি :বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে অবস্থিত নোয়াখালী। এই নাম শুধু একটি জেলার নাম নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, যা হাজার বছরের গৌরব ও সংস্কৃতির গল্প বয়ে আনে। প্রতিটি ধূলিকণায় লুকিয়ে আছে বীরত্বের দীপ, বিদ্রোহের সুর আর আত্মমর্যাদার এক অদম্য আত্মা।
নোয়াখালী জন্ম দিয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মতো মহান সন্তান, যারা দেশের মাটিকে রক্তের সিংহাসনে বসিয়েছেন। আবার একই জনপদ থেকে উঠে এসেছে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মনীষী, যিনি বাংলার ভাষা ও ইতিহাসকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করেছেন।
কিন্তু আজ, এই অমুল্য জনপদটি এক অবহেলার ঘন ছায়ায় ঢাকা পড়েছে। যখন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী অন্যান্য অঞ্চলগুলো বিভাগ পেয়ে উন্নতির নতুন অধ্যায় শুরু করছে, নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর মানুষ যেন সরকারি দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলে যাওয়া জনপদে পরিণত হয়েছে।
নোয়াখালীর এক সাধারণ নারী, আসমা খাতুনের জীবন কাহিনী যেন পুরো অঞ্চলের অবহেলার নিদর্শন। পল্লীর ছোট একটি গ্রামে বাস করা আসমা, যিনি দিনের পর দিন শস্যক্ষেত্রে কাজ করেন, কিন্তু প্রশাসনিক কাজের জন্য তাকে চট্টগ্রামে যেতে হয় দেড়শো কিলোমিটার পথ। অস্থির রাস্তা, দীর্ঘ লাইনের যন্ত্রণা সবই তার দৈনন্দিন জীবনের অম্লান বেদনা।
কখনো পেনশন পেতে না পারার কারণে সে এবং তার অসুস্থ শ্বশুর একটি অপরিকল্পিত আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রশাসনিক দুরত্ব তাদের জীবনকে কাঁদিয়ে তোলে, সুযোগ-সুবিধার বাইরে ফেলে দেয়। এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আসমার মতো হাজারো নারীর স্বপ্ন নষ্ট হচ্ছে, আশা পুড়ছে।
নারীরা এই দূরত্ব ও অবহেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যখন সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ কমে যায়, স্বাস্থ্যসেবা দূরে থাকে, তখন গ্রামের নারী-পুরুষদের জীবন মানে বোঝা আর কঠোর সংগ্রাম। এই দুঃখের মাঝে নোয়াখালী বিভাগ গঠনের দাবি যেন তাদের মুক্তির এক রশ্মি।
নোয়াখালীর ভাষা শুধু কথার সেতুবন্ধন নয়, এটি নারীর দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির এক অমলিন অংশ। এই ভাষার ধীর ও টানযুক্ত সুরে মিশে আছে নারীর বলিষ্ঠতা ও ধৈর্য্যের মধুর প্রতিধ্বনি। গ্রামের মায়েরা শিশুদের নানান কাহিনী শুনান এই ভাষায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।
এই ভাষা হারিয়ে গেলে শুধু শব্দ হারাবে না, হারাবে হাজার বছরের নারীর সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস। তাই নারীরাও আজ প্রশাসনিক স্বীকৃতির পক্ষে মুখ খুলেছেন, কারণ এটি তাদের জীবনমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
একজন নবজাতক শিশুর মায়ের কষ্ট কল্পনা করুন, যাকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেড়শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম যেতে হয়। সেই যাত্রার ঝুঁকি, খরচ ও মানসিক চাপ জীবনের জন্য সংকট। অনেক সময় সে বাধ্য হয় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে, যা তাদের জন্য হতে পারে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ।
এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে, যখন জন্ম সনদ সংশোধন কিংবা অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ করার জন্য নারীরা বারবার দূরপাল্লার ভ্রমণ করেন, তখন তাদের সময় ও অর্থের অপচয় হয়। এই দূরত্ব শুধু ভৌগোলিক নয়, এটি নারীর অধিকার ও মর্যাদার বিরাট বাধা।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নোয়াখালীর নারী প্রবাসীরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে পাঠান রেমিট্যান্স। তারা কেবল অর্থ পাঠান না, পাঠান উন্নয়নের স্বপ্ন, আধুনিক জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা এবং নতুন সম্ভাবনার বার্তা।
কিন্তু যখন দেশের নিজের জন্মভূমি তাদের স্বপ্ন ও চেষ্টাকে সম্মান দেয় না, তখন তাদের হৃদয় ভেঙে পড়ে। রেমিট্যান্সের এই অর্থ যেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের দরজা খুলতে পারছে না, কারণ প্রশাসনিক স্বীকৃতি নেই।
নোয়াখালী বিভাগ গঠনের দাবি তাই তাদের স্বপ্ন পূরণের মূল চাবিকাঠি। তারা জানে, নতুন বিভাগ মানে নতুন অবকাঠামো, নতুন কর্মসংস্থান, এবং তাদের পরিশ্রমের সঠিক স্বীকৃতি।
সোনাইমুড়ীর বাইপাস অবরোধ ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে নারী থেকে যুবক সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ স্লোগানের পেছনে। তারা জানেন, এটি কোনো অস্থায়ী দাবী নয়; এটি তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
তারা বোঝেন, প্রশাসনিক স্বীকৃতি মানে শুধু অফিসের নতুন ভবন নয়, তা মানে উন্নয়নের সোনালী আলো, নিরাপদ শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীর জীবন মানের উন্নতি।
নোয়াখালী বিভাগ গঠন এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি লক্ষ মানুষের বিশেষ করে নারীর আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। একটি নতুন বিভাগ তাদের স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে দেবে, যেখানে তারা থাকবে অধিকারসম্পন্ন নাগরিক।
যখন আমরা নোয়াখালী বিভাগের জন্য এগিয়ে যাব, তখন শুধু একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো নয়, গড়ে উঠবে এক নতুন মানবিক সমাজ, যেখানে নারীরাও পাবে যথাযথ সুযোগ ও মর্যাদা।
আমাদের সকলের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই দাবিকে শক্তিশালী করা, যেন নোয়াখালী শুধু একটি জেলা নয়, বরং দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের আলোর দীপ হয়ে ওঠে একটি দীপ, যা নারীর আশা, মানুষের অধিকার ও জাতির স্বপ্নের পথপ্রদর্শক হবে।
লেখক ও সাংবাদিক
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

নোয়াখালী বিভাগ চাই: যেখানে নারী ও মানুষের মর্যাদা পাবে নতুন আলো

Update Time : ১২:২৭:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫
মোহাম্মদ হানিফ নোয়াখালী  প্রতিনিধি :বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে অবস্থিত নোয়াখালী। এই নাম শুধু একটি জেলার নাম নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, যা হাজার বছরের গৌরব ও সংস্কৃতির গল্প বয়ে আনে। প্রতিটি ধূলিকণায় লুকিয়ে আছে বীরত্বের দীপ, বিদ্রোহের সুর আর আত্মমর্যাদার এক অদম্য আত্মা।
নোয়াখালী জন্ম দিয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মতো মহান সন্তান, যারা দেশের মাটিকে রক্তের সিংহাসনে বসিয়েছেন। আবার একই জনপদ থেকে উঠে এসেছে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মনীষী, যিনি বাংলার ভাষা ও ইতিহাসকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করেছেন।
কিন্তু আজ, এই অমুল্য জনপদটি এক অবহেলার ঘন ছায়ায় ঢাকা পড়েছে। যখন চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী অন্যান্য অঞ্চলগুলো বিভাগ পেয়ে উন্নতির নতুন অধ্যায় শুরু করছে, নোয়াখালী লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর মানুষ যেন সরকারি দৃষ্টিকোণ থেকে ভুলে যাওয়া জনপদে পরিণত হয়েছে।
নোয়াখালীর এক সাধারণ নারী, আসমা খাতুনের জীবন কাহিনী যেন পুরো অঞ্চলের অবহেলার নিদর্শন। পল্লীর ছোট একটি গ্রামে বাস করা আসমা, যিনি দিনের পর দিন শস্যক্ষেত্রে কাজ করেন, কিন্তু প্রশাসনিক কাজের জন্য তাকে চট্টগ্রামে যেতে হয় দেড়শো কিলোমিটার পথ। অস্থির রাস্তা, দীর্ঘ লাইনের যন্ত্রণা সবই তার দৈনন্দিন জীবনের অম্লান বেদনা।
কখনো পেনশন পেতে না পারার কারণে সে এবং তার অসুস্থ শ্বশুর একটি অপরিকল্পিত আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রশাসনিক দুরত্ব তাদের জীবনকে কাঁদিয়ে তোলে, সুযোগ-সুবিধার বাইরে ফেলে দেয়। এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আসমার মতো হাজারো নারীর স্বপ্ন নষ্ট হচ্ছে, আশা পুড়ছে।
নারীরা এই দূরত্ব ও অবহেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যখন সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ কমে যায়, স্বাস্থ্যসেবা দূরে থাকে, তখন গ্রামের নারী-পুরুষদের জীবন মানে বোঝা আর কঠোর সংগ্রাম। এই দুঃখের মাঝে নোয়াখালী বিভাগ গঠনের দাবি যেন তাদের মুক্তির এক রশ্মি।
নোয়াখালীর ভাষা শুধু কথার সেতুবন্ধন নয়, এটি নারীর দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির এক অমলিন অংশ। এই ভাষার ধীর ও টানযুক্ত সুরে মিশে আছে নারীর বলিষ্ঠতা ও ধৈর্য্যের মধুর প্রতিধ্বনি। গ্রামের মায়েরা শিশুদের নানান কাহিনী শুনান এই ভাষায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।
এই ভাষা হারিয়ে গেলে শুধু শব্দ হারাবে না, হারাবে হাজার বছরের নারীর সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও ইতিহাস। তাই নারীরাও আজ প্রশাসনিক স্বীকৃতির পক্ষে মুখ খুলেছেন, কারণ এটি তাদের জীবনমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
একজন নবজাতক শিশুর মায়ের কষ্ট কল্পনা করুন, যাকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেড়শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রাম যেতে হয়। সেই যাত্রার ঝুঁকি, খরচ ও মানসিক চাপ জীবনের জন্য সংকট। অনেক সময় সে বাধ্য হয় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে, যা তাদের জন্য হতে পারে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ।
এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে, যখন জন্ম সনদ সংশোধন কিংবা অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ করার জন্য নারীরা বারবার দূরপাল্লার ভ্রমণ করেন, তখন তাদের সময় ও অর্থের অপচয় হয়। এই দূরত্ব শুধু ভৌগোলিক নয়, এটি নারীর অধিকার ও মর্যাদার বিরাট বাধা।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নোয়াখালীর নারী প্রবাসীরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে পাঠান রেমিট্যান্স। তারা কেবল অর্থ পাঠান না, পাঠান উন্নয়নের স্বপ্ন, আধুনিক জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা এবং নতুন সম্ভাবনার বার্তা।
কিন্তু যখন দেশের নিজের জন্মভূমি তাদের স্বপ্ন ও চেষ্টাকে সম্মান দেয় না, তখন তাদের হৃদয় ভেঙে পড়ে। রেমিট্যান্সের এই অর্থ যেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের দরজা খুলতে পারছে না, কারণ প্রশাসনিক স্বীকৃতি নেই।
নোয়াখালী বিভাগ গঠনের দাবি তাই তাদের স্বপ্ন পূরণের মূল চাবিকাঠি। তারা জানে, নতুন বিভাগ মানে নতুন অবকাঠামো, নতুন কর্মসংস্থান, এবং তাদের পরিশ্রমের সঠিক স্বীকৃতি।
সোনাইমুড়ীর বাইপাস অবরোধ ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে নারী থেকে যুবক সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’ স্লোগানের পেছনে। তারা জানেন, এটি কোনো অস্থায়ী দাবী নয়; এটি তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
তারা বোঝেন, প্রশাসনিক স্বীকৃতি মানে শুধু অফিসের নতুন ভবন নয়, তা মানে উন্নয়নের সোনালী আলো, নিরাপদ শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীর জীবন মানের উন্নতি।
নোয়াখালী বিভাগ গঠন এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি লক্ষ মানুষের বিশেষ করে নারীর আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। একটি নতুন বিভাগ তাদের স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে দেবে, যেখানে তারা থাকবে অধিকারসম্পন্ন নাগরিক।
যখন আমরা নোয়াখালী বিভাগের জন্য এগিয়ে যাব, তখন শুধু একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো নয়, গড়ে উঠবে এক নতুন মানবিক সমাজ, যেখানে নারীরাও পাবে যথাযথ সুযোগ ও মর্যাদা।
আমাদের সকলের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই দাবিকে শক্তিশালী করা, যেন নোয়াখালী শুধু একটি জেলা নয়, বরং দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের আলোর দীপ হয়ে ওঠে একটি দীপ, যা নারীর আশা, মানুষের অধিকার ও জাতির স্বপ্নের পথপ্রদর্শক হবে।
লেখক ও সাংবাদিক