০২:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

কৃত্রিম রং, স্যাকারিন ও ক্যামিকেল মিশ্রিত আইসক্রিম: নোয়াখালী জুড়ে অর্ধশতাধিক অবৈধ কারখানা!

Reporter Name
  • Update Time : ০৫:৪৬:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
  • / ২৫ Time View

মোহাম্মদ হানিফ,  নোয়াখালী প্রতিনিধি :

তপ্ত সূর্যের তীব্র তাপে স্বস্তি পেতে অনেকের প্রথম পছন্দ আইসক্রিম। লোভনীয় খাবারটি কিন্ডারগার্টেনের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষই খেয়ে থাকেন। তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ক্ষতিকর উপাদানে তৈরী হলে এই খাবারটি বিষ হিসেবে প্রবেশ করে মানবদেহে। যা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাড়ায়। নোয়াখালীতে বিভিন্ন বরফ তৈরীর কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ক্ষতিকারক এমন আইসক্রিম। যা তৈরী হচ্ছে কৃত্তিম রং, বিভিন্ন ফ্লেভার, কাপড়ে ব্যবহৃত এ্যারারোট পাউডার, স্যাকারিন বা গাঢ় চিনি, নিম্নমানের গুড় দুধ ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণে। আর এসব আইসক্রিম হকারের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে জেলার উপজেলা ও পৌর শহরের ভিন্ন। যার সিংহভাগ ক্রেতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুরা।
তথ্য বলছে, জেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক আইসক্রিম তৈরীর অবৈধ কারখানা রয়েছে। যেগুলোর নেই বিএসটিআই সনদ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। বিভিন্ন বাজারের অলিগলিতে শার্টার বদ্ধ দোকান ঘরের মধ্যে তৈরী করা হচ্ছে এসব আইসক্রিম।
সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানা গুলিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনিরাপদ পানি, ঘন চিনি (স্যাকারিন), নানা ফ্লেভার, কৃত্রিম রং ও বিভিন্ন ক্যামিক্যাল দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে আইসক্রিম। অরেন্জ ললি, মিল্ক মালাই, স্টবেরী বার, কোকোনাট আইস, চকোবার, স্পীড ললি, আইসবার সহ বিভিন্ন নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। আর সেগুলোর অনেক প্যাকেটে ব্যবহার করা হচ্ছে বিএসটিআইয়ের লোগো। দু’একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতার বালাই না থাকলেও রয়েছে নোয়াখালী সিভিলসার্জন অফিসের অনুমতি পত্র।
চৌমুহনী হকার্স মার্কেটের পিপাসা আইসক্রিম নামের কারখানার মালিক খাজা নাসিম। মার্কেটের গলির ভেতরে সার্টারবদ্ধ আইসক্রিম কারখানা। তার চারপাশে ময়লা-কাদার স্তুপ। অপরিচ্ছন্ন কারখানার ভেতরে মরিচাধরা বড় বড় ডিপফ্রিজে সংরক্ষিত আছে নানা ফ্লেভারের আইসক্রিম। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আইসক্রিম তৈরীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সিভিলসার্জন অফিসের লাইসেন্স বের করে দেখালেন। জানালেন নোয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসের জেলা স্যানিটারী পরিদর্শক এস.এম সওকত আলী তাকে লাইসেন্স করে দিয়েছেন। তবে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি এখন নোয়াখালীতে কর্মরত নেই জানিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
বেগমগঞ্জের মাইজদি রোড সংলগ্ন রমজান বিবি বাজার এলাকায় রয়েছে পপুলার সুপার আইসক্রিম ফ্যাক্টরি। যার প্রোপাইটর মো: হারুনুর রশিদ।    বাহ্যিক ভাবে পরিচ্ছন্ন থাকলেও আইসক্রিম তৈরীতে ব্যবহার করছেন ক্যামিক্যাল, রং ও ঘন চিনি। সেখানকার কর্মীরা জানান, প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ হাজার আইসক্রিম তৈরী করেন। যেগুলো হকারের মাধ্যমে চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ এলাকায় বিক্রি করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কলা বা আপেলের ফ্লেভার দিতে ব্যবহার করা হয় অ্যামাইল এসিটেট। যা পেইন্ট ওয়ার্কশপে রং তরলীভূত করতে ব্যবহার হয়। মিষ্টি এবং চনমনে গন্ধ তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় বেনজাইল এসিটেট। ভ্যানিলা, চকলেট বা স্ট্রবেরি ফ্লেভারে যে আইসক্রিম বিক্রি হয় তা আসলে কারখানায় তৈরি হরেক রকমের রাসায়নিক উপাদানের একটি যৌগ। অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত আইসক্রিম খাওয়া ছোট ছেলেমেয়ের কোলান, স্টমাক ও লিভার ক্যানসারের পরিমাণ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ।
এসকল আইসক্রিমের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ডাঃ মজিবুল হক রুবেল বলেন, আইসক্রিমে থাকা মোটা চিনি ও চর্বি ডায়াবেটিস ও স্থূলতার আক্রান্তদের জন্য ক্ষতিকর। সড়ক ও ফুটপাতে বিক্রি হওয়া আইসক্রিম অশোধিত পানি দিয়ে তৈরি হয়। আইসক্রিমের চিনি ভেঙে মুখের ভেতরে পাইরুভিক ও ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই দুটি উপাদান দাঁতের এনামেলের জন্য ক্ষতিকর। এর বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান চর্মরোগের এমনকি ক্যান্সারের কারন হতে পারে।
বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই নোয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয় এর উপপরিচালক শেখ মাসুম বিল্লাহ জানান, জেলার কোন আইসক্রিম কারখানায় বিএসটিআই অনুমোদিত নয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন চালানো এসব আইসক্রিম কারখানার বিরুদ্ধে অতিসত্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সচেতন মহলের অভিমত, কারখানা গুলির পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও আইসক্রিম তৈরীতে নিরাপদ খাদ্য উপাদানের ব্যবহার নিশ্চিত না করা গেলে এর ক্ষতিকর প্রভাব হবে ভয়াবহ। নান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে নিম্নবিত্ত শিশুরা সহ নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

কৃত্রিম রং, স্যাকারিন ও ক্যামিকেল মিশ্রিত আইসক্রিম: নোয়াখালী জুড়ে অর্ধশতাধিক অবৈধ কারখানা!

Update Time : ০৫:৪৬:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

মোহাম্মদ হানিফ,  নোয়াখালী প্রতিনিধি :

তপ্ত সূর্যের তীব্র তাপে স্বস্তি পেতে অনেকের প্রথম পছন্দ আইসক্রিম। লোভনীয় খাবারটি কিন্ডারগার্টেনের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষই খেয়ে থাকেন। তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ক্ষতিকর উপাদানে তৈরী হলে এই খাবারটি বিষ হিসেবে প্রবেশ করে মানবদেহে। যা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাড়ায়। নোয়াখালীতে বিভিন্ন বরফ তৈরীর কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ক্ষতিকারক এমন আইসক্রিম। যা তৈরী হচ্ছে কৃত্তিম রং, বিভিন্ন ফ্লেভার, কাপড়ে ব্যবহৃত এ্যারারোট পাউডার, স্যাকারিন বা গাঢ় চিনি, নিম্নমানের গুড় দুধ ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণে। আর এসব আইসক্রিম হকারের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে জেলার উপজেলা ও পৌর শহরের ভিন্ন। যার সিংহভাগ ক্রেতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুরা।
তথ্য বলছে, জেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক আইসক্রিম তৈরীর অবৈধ কারখানা রয়েছে। যেগুলোর নেই বিএসটিআই সনদ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। বিভিন্ন বাজারের অলিগলিতে শার্টার বদ্ধ দোকান ঘরের মধ্যে তৈরী করা হচ্ছে এসব আইসক্রিম।
সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানা গুলিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনিরাপদ পানি, ঘন চিনি (স্যাকারিন), নানা ফ্লেভার, কৃত্রিম রং ও বিভিন্ন ক্যামিক্যাল দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে আইসক্রিম। অরেন্জ ললি, মিল্ক মালাই, স্টবেরী বার, কোকোনাট আইস, চকোবার, স্পীড ললি, আইসবার সহ বিভিন্ন নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। আর সেগুলোর অনেক প্যাকেটে ব্যবহার করা হচ্ছে বিএসটিআইয়ের লোগো। দু’একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতার বালাই না থাকলেও রয়েছে নোয়াখালী সিভিলসার্জন অফিসের অনুমতি পত্র।
চৌমুহনী হকার্স মার্কেটের পিপাসা আইসক্রিম নামের কারখানার মালিক খাজা নাসিম। মার্কেটের গলির ভেতরে সার্টারবদ্ধ আইসক্রিম কারখানা। তার চারপাশে ময়লা-কাদার স্তুপ। অপরিচ্ছন্ন কারখানার ভেতরে মরিচাধরা বড় বড় ডিপফ্রিজে সংরক্ষিত আছে নানা ফ্লেভারের আইসক্রিম। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আইসক্রিম তৈরীর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সিভিলসার্জন অফিসের লাইসেন্স বের করে দেখালেন। জানালেন নোয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসের জেলা স্যানিটারী পরিদর্শক এস.এম সওকত আলী তাকে লাইসেন্স করে দিয়েছেন। তবে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি এখন নোয়াখালীতে কর্মরত নেই জানিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
বেগমগঞ্জের মাইজদি রোড সংলগ্ন রমজান বিবি বাজার এলাকায় রয়েছে পপুলার সুপার আইসক্রিম ফ্যাক্টরি। যার প্রোপাইটর মো: হারুনুর রশিদ।    বাহ্যিক ভাবে পরিচ্ছন্ন থাকলেও আইসক্রিম তৈরীতে ব্যবহার করছেন ক্যামিক্যাল, রং ও ঘন চিনি। সেখানকার কর্মীরা জানান, প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ হাজার আইসক্রিম তৈরী করেন। যেগুলো হকারের মাধ্যমে চৌমুহনী, বেগমগঞ্জ এলাকায় বিক্রি করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কলা বা আপেলের ফ্লেভার দিতে ব্যবহার করা হয় অ্যামাইল এসিটেট। যা পেইন্ট ওয়ার্কশপে রং তরলীভূত করতে ব্যবহার হয়। মিষ্টি এবং চনমনে গন্ধ তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় বেনজাইল এসিটেট। ভ্যানিলা, চকলেট বা স্ট্রবেরি ফ্লেভারে যে আইসক্রিম বিক্রি হয় তা আসলে কারখানায় তৈরি হরেক রকমের রাসায়নিক উপাদানের একটি যৌগ। অতিরিক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত আইসক্রিম খাওয়া ছোট ছেলেমেয়ের কোলান, স্টমাক ও লিভার ক্যানসারের পরিমাণ বৃদ্ধির অন্যতম বড় কারণ।
এসকল আইসক্রিমের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ডাঃ মজিবুল হক রুবেল বলেন, আইসক্রিমে থাকা মোটা চিনি ও চর্বি ডায়াবেটিস ও স্থূলতার আক্রান্তদের জন্য ক্ষতিকর। সড়ক ও ফুটপাতে বিক্রি হওয়া আইসক্রিম অশোধিত পানি দিয়ে তৈরি হয়। আইসক্রিমের চিনি ভেঙে মুখের ভেতরে পাইরুভিক ও ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই দুটি উপাদান দাঁতের এনামেলের জন্য ক্ষতিকর। এর বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান চর্মরোগের এমনকি ক্যান্সারের কারন হতে পারে।
বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই নোয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয় এর উপপরিচালক শেখ মাসুম বিল্লাহ জানান, জেলার কোন আইসক্রিম কারখানায় বিএসটিআই অনুমোদিত নয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন চালানো এসব আইসক্রিম কারখানার বিরুদ্ধে অতিসত্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সচেতন মহলের অভিমত, কারখানা গুলির পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও আইসক্রিম তৈরীতে নিরাপদ খাদ্য উপাদানের ব্যবহার নিশ্চিত না করা গেলে এর ক্ষতিকর প্রভাব হবে ভয়াবহ। নান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে নিম্নবিত্ত শিশুরা সহ নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ।