রাজাকারের চেতনা বনাম শাহবাগীদের চেতনা
- Update Time : ১০:৪০:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৭১ Time View

ফিরোজ মাহবুব কামাল
কোনটি রাজকারের চেতনা এবং কোনটি শাহবাগীদের চেতনা?
প্রতিটি যুদ্ধই বস্তুত দুটি বিপরীত চেতনা ও দুটি ভিন্ন বয়ানের যুদ্ধ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের অঙ্গণে দুটি মুখোমুখী চেতনার একটি হলো রাজকারদের চেতনা; অপরটি শাহবাগীদের চেতনা। শাহবাগীদের চেতনাটি হলো মূলত একাত্তরের মুক্তিবাহিনীর চেতনার অতি নৃশংস ফ্যাসিবাদী রূপ। এ চেতনাটি হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সেক্যুলারিজমের মিশ্রিত যুদ্ধাংদেহী রূপ। এ চেতনায় বিরোধীদের জন্য থাকে গুম, খুন, ফাঁসি, আয়না ঘর, পুলিশী রিম্যান্ড এবং শাপলা চত্বরের গণহত্যা। এ চেতনা উৎপাদন করে আজ্ঞাবহ আদালত, লাঠিয়াল পুলিশ, সন্ত্রাসী DGFI ও RAB বাহিনী, ছাত্র লীগের হেলমেট বাহিনী এবং নৃশংস ফ্যাসিস্ট হাসিনা। এ চেতনায় পাকিস্তানের ন্যায় মুসলিম দেশ ভাঙা ও ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক শক্তির কোলে আশ্রয় নেয়া অতি গর্ব ও উৎসবের বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ শাহবাগী চেতনার নৃশংস প্রয়োগ দেখেছে ফ্যাসিস্ট মুজিব ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে।

অপর দিকে রাজাকারের চেতনাটি জন্ম দেয় লড়াকু মুজাহিদের। এ চেতনাটি হলো মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতার সুরক্ষায় রক্তদান ও আত্মদানের চেতনা। এ চেতনায় থাকে মহান রব’য়ের এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার প্রবল তাড়না। থাকে, নিজ ভাষা, নিজ ভূগোল ও নিজ বর্ণের পরিচয়কে ডিঙ্গিয় অন্য ভাষা, অন্য ভূগোল ও অন্য বর্ণের মুসলিম ভাইয়ের সাথে একতাবদ্ধ হওয়ার ঈমানী তাড়না। বাঙালি মুসলিমদের জীবনে এ এচেতনার বিশাল সৃষ্টিশীলতা ও বিজয় দেখা গেছে ১৯৪৭’য়ে। এ চেতনাটাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। রাজাকারের এ চেতনা হাজার হাজার শহীদ উৎপাদন করে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চেতনার জোয়ার এসেছিল। সে জোয়ারে ভাসা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী স্লোগান তুলেছিল “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার” বলে। এ স্লোগান কোন সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী বা শাহবাগীর মুখে উচ্চারিত হবে -সেটি কখনোই ভাবা যায়। সে জন্য চাই চেতনায় ঈমানের জাগরণ। সে জাগরণ এসেছিল ২০২৪’য়ের জুলাই আগস্টে। রাজাকার সুলভ সে ঈমানী প্রত্যয় ও দেশপ্রেম জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মোড়ই পাল্টে দেয়। বিপ্লব তখন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নয়, সারা দেশব্যাপী অপ্রতিরোধ্য গতি সঞ্চার করে। রাজাকারের চেতনার এই হলো ঈমানী শক্তি। শাহবাগী চেতনার ধারকগণ তখন ভয়ে হয় গর্তে ঢুকেছে, অথবা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। বস্তুত ঈমানদীপ্ত এ চেতনাই আগামী দিনে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতাকে বাঁচাতে পারে।
রাজাকারের ভাবনা, তাড়না ও কীর্তি
রাজাকার একটি ফার্সি শব্দ। এর অর্থ, স্বেচ্ছাসেবী। রাজাকার তো তারাই যারা নিজ দেশের উপর শত্রু শক্তির হামলার প্রতিরোধে স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগে হাজির হয়। পৌত্তলিক ভারত হলো মুসলিমদের জন্য সব সময়ই একটি শত্রু শক্তি। এটি এক বৃহৎ ইসরাইল। হায়দারাবাদের উপর ভারতীয় আগ্রাসন রূখতে যে মুসলিম যুবকগণ প্রতিরোধে খাড়া হয়েছিল তাদেরও রাজাকার বলা হতো। একাত্তরে বাঙালি রাজাকারগণ যুদ্ধে নেমেছিল ভারত ও তার সেবাদাসদের প্রতিরোধে। এরা এসেছিল বিভিন্ন ইসলামী ছাত্র সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী ও পাকিস্তানপন্থী পরিবারগুলি থেকে। তাদের অনেকের বাপ-দাদা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সরাসরি জড়িত ছিল। তারা ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র।
রাজাকারদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণেই মুক্তিবাহিনী কোন জেলা বা মহকুমা দূরে থাক, একটি থানাও দখল করতে পারিনি। রাজাকারদের হাতে ভারী অস্ত্র ছিল না; ফল তাদের সামর্থ্য ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত আড়াই লাখ ভারতী সেনাদের পরাজিত করার। ফলে সেদিন তারা সামরিক ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বহু হাজার রাজাকার সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। কিন্তু যারা আদর্শবাদী, তাদের জীবনে সামরিক পরাজয় আসলেও কখনো আদর্শিক পরাজয় আসে না। কারণ, তাদের চেতনাটি অমর। তাই আজ ইসলামের লেবাসধারী যেসব দল ও ব্যক্তি একাত্তরে বয়ানের কাছে আত্মসমর্পণ করছে এবং ১৬ ডিসেম্বর এলে পাকিস্তান ভাঙা নিয়ে বিজয় উৎসব করে, বুঝতে হবে তারা ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরেছে। তারা ইসলামের মুখোশধারী মাত্র, কুর’আনের চেতনাধারী নয়। তাদের রাজনীতিতে ইসলামের সাথে গাদ্দারীটি এভাবেই দিন দিন সুস্পষ্ট হচ্ছে এবং খুলে যাচ্ছে তাদের মুখোশ। মনে রাখতে হবে মুখোশধারী মুনাফিকদের মুনাফিকি প্রকাশ করে দেয়াই মহান রব’য়ের প্রতিশ্রুত নীতি। আর মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নে কখনো ব্যর্থ হননা। মহান রব’য়ের সে নীতির ঘোষণা এসেছে নিচের আয়াতে:
وَلَيَعْلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَلَيَعْلَمَنَّ ٱلْمُنَـٰفِقِينَ
অর্থ: “এবং আল্লাহ নিশ্চয় জানিয়ে দিবেন তথা প্রকাশ করে দিবেন কারা ঈমানদার এবং কারা মুনাফিক।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ১১) ।
রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেন?
রাজাকরগণ ২০১৩’য়ের শাহবাগীদের কাছে অতি ঘৃণার পাত্র। রাজাকারদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধটি স্রেফ ১৯৭১ সাল থেকে নয়; ১৯৪৭ সাল থেকেই। কারণ, বাংলাদেশের মাটিতে রাজাকারের চেতনাধারীরাই তাদের চেতনার একমাত্র শত্রু। শাহবাগীদের কাছে পাকিস্তান হলো এক অনাসৃষ্টি; ফলে তাদের কাছে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করাটিই অপরাধ। অথচ এই পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানই আজ মুসলিম বিশ্বের ভূ-রাজনীতি পাল্টে দিতে যাচ্ছে। নির্মিত হতে যাচ্ছে মুসলিম ন্যাটো। সম্প্রতি সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মাঝে যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো তা কাঁপন ধরিয়েছে ভারত ও ইসরাইলে। অথচ মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল বাঙালি মুসলিমগণ। মুসলিম লীগে জন্ম ও ঘাঁটি ছিল এই বাংলায়; পাঞ্জাব, খায়বার পখতুন খা বা সিন্ধে নয়। অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির ন্যায় বাঙালি মুসলিমে সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম এই শাহবাগীদের কাছে সবচেয়ে নিন্দিত কর্ম। এবং পাকিস্তান ভাঙার ন্যায় বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কর্মটি গণ্য হয় গর্বের কর্ম রূপে। এথেকে বুঝা যায় এই শাহবাগীরা মুসলিম উম্মাহর কতবড় জঘনই শত্রু। এরা মিত্র ভারতের ন্যায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর শত্রুদের। এ শাহবাগীরা সৃষ্টি হয়েছে বাকশালী ফ্যাসিস্ট, জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে। এরা আবার সবাই একাত্তরের চেতনাধারী।
শাহবাগীদের কাছে তারাও অপরাধী যারা ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নির্মাণ করেছিল। কারণ, তারাও তাদের কাছে রাজাকার। এজন্যই একাত্তরের চেতনাধারীদের রচিত ইতিহাসের শুরু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে, সে ইতিহাসে নবাব সলিমুল্লাহ,মাওলানা আকরাম খাঁ, সহরোওয়ার্দী, নুরূল আমিন, মৌলভী তমিজুদ্দীন খান, ফজলুল কাদের চৌধুরীর মত ১৯০৬ ও ১৯৪৭’য়ের নায়কদের কোন স্থান নাই। তাদের কথা, ইসলামের ও পাকিস্তানের পক্ষের যারা সৈনিক তাদের জন্ম যদি ১৯৭১’য়ের পরেও হয়, তবুও তারা রাজাকর। কারণ, তারা রাজাকারের চেতনাধারী। এদিক দিয়ে শাহবাগীদের বক্তব্য সঠিক। কারণ, শয়তান ও শয়তানের অনুসারীগণ প্রকৃত ঈমানদারদের ঈমানী চেতনাটি বুঝতে ভুল করে না। একাত্তরে যারা রাজাকার ছিল তাদের চেতনাটি ছিল ঈমানসমৃদ্ধ সৈনিকের চেতনা। সেটি ছিল পৌত্তলিক ভারতের হামলা থেকে মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে বাঁচানোর চেতনা। সে চেতনা অমর। রাজাকার তাই ইসলামের শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিকের প্রতীক। রাজাকর মাত্রই তাই শাহবাগী চেতনাধারীদের চক্ষুশূল।
বাঙালি মুসলিমের চরিত্র ও চেতনার ইসলামী রূপটি একমাত্র তখনই স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে যখন তারা একাত্তরের চেতনাধারী শাহবাগীদের ঘৃণা করতে শেখে এবং শ্রদ্ধাভরে করে স্মরণ করে একাত্তরের রাজাকারদের। নামাজ রোজা তো লক্ষ লক্ষ ঘুষখোর, সূদখোর, প্রতারক ও বাকশালীরাও পালন করে। কিন্তু ঈমান তো তখন ধরা পড়ে যখন তাদের মাঝে ইসলামের শত্রুদের ঘৃণা এবং জিহাদী চেতনার মুজাহিদের ভালবাসার সামর্থ্য দৃশ্যমান হয়। মানুষের ঈমান ও চরিত্রের বিশ্লেষণে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কেন শাহবাগী চেতনার নির্মূল জরুরি?
একাত্তরে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ন্যায় পাকিস্তান বিরোধী দলগুলির রাজনীতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাকিস্তান বিরোধী চেতনার রাজনীতি। তাতে ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ; এবং তাতে ছিল রাজাকারদের নৃশংস ভাবে হত্যা এবং সে সাথে ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করার নীতি। এগুলি নিয়ে কখনোই কোন মুসলিমের রাজনীতি হতে পারে। কারণ, এগুলির মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ বেঈমানীর উপাদান। একাত্তরের চেতনাধারীদের দলীয় মেনিফেস্টোতে ইসলামের ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের কোন বাণী ছিল না। একাত্তরে তাদের যা এজেন্ডা ছিল, সে অভিন্ন এজেন্ডাটি ছিল ভারতীয় পৌত্তলিকদেরও। আদর্শিক দিক দিয়ে তারা তাই সহোদর। এজন্যই ভারতীয় পৌত্তলিক কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান ভাঙাকে তারা উৎসবের বিষয় মনে করে।
ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা ১৯৪৭’য়ে যেমন যেমন চায়নি। তেমনি ১৯৭১’য়েও চায়নি। এখনো চায়না। ভারত যা চায় তা হলো, বাংলাদেশের উপর হাসিনার ন্যায় নিজ দাস-দাসীদের শাসন। সেখানে ইসলামপন্থীদের কোন স্থান। ইসলামপন্থীদের জন্য স্থানটি হবে ফাঁসির মঞ্চ, আয়না ঘর বা কারাগর। এটিই ছিল যেমন একাত্তরের চেতনা, সে অভিন্ন চেতনাটি ছিল ২০১৩’য়ের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চেরও। এ চেতনাটি নিরপরাধ ইসলামপন্থিদের ফাঁসিতে ঝুলানো যেমন জায়েজ করেছিল, তেমনি জায়েজ করেছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরের গণহত্যাকে। তাই এ চেতনার মধ্য রয়েছে মুসলিমদের পরাধীন করার এজেন্ডা। তাই স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে ভারতসেবী এ বিষাক্ত সেক্যুলার চেতনাকে অবশ্যই নির্মূল করতেই হবে। এখানে আপোষের কোন জায়গা নেই। বিষাক্ত চেতনা শুধু একাকী বাঁচেনা, কোভিড ভাইরাসের মত এটি জীবননাশী রোগ উৎপাদন করে। সে বিষাক্ত সেক্যুলার চেতনার কারণে উসমানিয়া খেলাফত ও পাকিস্তান যেমন বাঁচেনি, বাঁচবে না বাংলাদেশও। তাই এ বিষাক্ত চেতনাটির নির্মূলের কাজে ব্যর্থ হলে বিপন্ন হবে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা। তখন আবার ফিরে আসবে ভারতের গোলামদের শাসন -যেমন এসেছিল ১৯৭১’য়ে।
—


























