প্রসঙ্গ একাত্তরের ফিতনা এবং ফিতনা কেন মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ?
- Update Time : ০২:২৮:৪০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ৮৬ Time View

ফিরোজ মাহবুব কামাল
ফিতনার নাশকতা
প্রশ্ন হলো, ফিতনা কি? ফিতনা একটি আরবী শব্দ; শব্দটির উৎপত্তি আরবী ক্রিয়াপদ ফাতানা থেকে। “ফাতানা” শব্দের অভিধানিক অর্থ: কাউকে বিদ্রোহে উস্কানি দেয়া, ক্ষতিকর কিছুতে প্রলুব্ধ করা, প্রতারণা করা বা কাউকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলা। এবং “ফিতনা” শব্দটির অর্থ হলো: বিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা, মতবিরোধ, বেঈমানী, অধর্ম, পাপ, পাগলামী, দুশ্চরিত্র, প্রতারণা, প্রলুব্ধকরণ। ফিতনা এক বচন, বহু বচনে ফিতান। -(সূত্র: Arabic English Dictionary for Advanced Learners by J. G. Hava)।
কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলে সে প্রাণ হারায়। কিন্তু খুনি তাকে জাহান্নামে পাঠায় না। সেটি তার নিয়তও নয়। জাহান্নামে নেয়ার কাজটি করে শয়তান। আর ফিতনা হলো সে কাজে শয়তানের হাতিয়ার। ফিতনার সাহায্যে শয়তান মানুষকে প্রলুব্ধ ও প্রতারণা করে, পাপের পথে নেয় এবং অনুগত সৈনিকে পরিণত করে। মানুষ তখন নিজেই দৃশ্যমান শয়তানে পরিণত হয়। ফিতনা তো তাই -যা ব্যক্তির চেতনা থেকে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে ভুলিয়ে দেয় এবং বাঁচতে বাধ্য করে শয়তানের এজেন্ডা নিয়ে। ফিতনা অসম্ভব করে পূর্ণ ইসলাম পালন।
ফিতনা আনে বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা, পথভ্রষ্টতা এবং ভাতৃঘাতী সংঘাত -যা মুসলিম উম্মাহকে খণ্ডিত করে এবং গৃহযুদ্ধের মধ্যে ফেলে। কোন দেশে ফেতনা শুরু হলে সে দেশে অসম্ভব হয় আল্লাহ তায়ালার পথে চলা ও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করা। তখন ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা অঞ্চল ভিত্তিক এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। ফিতনা বিপন্ন করে দেশবাসীর স্বাধীনতা, সংহতি এবং জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা। তখন দেশ শত্রুশক্তির হাতে পরাজিত ও পরাধীন হয়। একাত্তরে অবিকল সেটিই হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। সে ফিতনার নায়ক ছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা ফ্যাসিস্ট মুজিব ও তার অনুসারী বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, ফ্যাসিস্ট ও বামপন্থীগণ। সে সময় জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, আঞ্চলিকতাবাদের ন্যায় মতবাদগুলি ফেতনা সৃষ্টির হাতিয়ার রূপে কাজ করেছিল। একটি দেশে ইসলামের পরাজয় এবং ইসলামের শক্তি শক্তির বিজয় দেখে নিশ্চিত বলা যায় সেদেশে বিজয়টি ফিতনার।

ফিতনার নাশকতা বহুমুখী। তবে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ফিতনার সবচেয়ে বড় নাশকতাটি ঘটে একটি মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে। মুসলিম বিশ্ব আজ ৫০টি বেশী টুকরোয় বিভক্ত। এ বিভক্তির কারণ নানা ভাষা, নানা ফিরকা ও নানা মতবাদভিত্তিক ফিতনার বিজয়। দেশ ভাঙলে সে দেশ অধিকৃত হয় শত্রু শক্তির হাতে। তখন বিলুপ্ত হয় পূর্ণ দ্বীন পালনের স্বাধীনতা এবং সে সাথে জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা। হাসিনার আমলে জিহাদে যোগ দেয়া দূরে থাক, জিহাদ বিষয়ক পুস্তক পাঠও অপরাধ গণ্য হত। মুসলিম নামধারী বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও কম্যুনিস্টগণ একাত্তরে ভারতীয় পৌত্তলিকদের সাথে মিলে সেরূপ একটি ফিতনা সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। সে ফিতনা থেকেই শুরু একাত্তরের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ শেষে জন্ম নেয় ভারতের অধিনত এক আশ্রিত বাংলাদেশ। একাত্তরের ফিতনাটি ছিল মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এক ভয়ানক নাশকতা। তাতে খণ্ডিত হয় পাকিস্তান। অথচ বিশ্বের সর্ববৃহৎ সে মুসলিম রাষ্ট্রটি তার অখণ্ডতা নিয়ে বেঁচে থাকলে সেটি হতো ৪৪ কোটি মানুষের বিশাল দেশ;যা হতো চীন ও ভারতের পর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। একটি পারমাণবিক মুসলিম ন্যাটেো গড়ে তোলায় অখণ্ড পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো। কিন্তু শয়তান ও তার পৌত্তলিক খলিফা ভারত তা চায়নি। আর ভারতীয় সে প্রজেক্টের অংশীদার হয় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও কম্যুনিস্টগণ।
ফিতনা হত্যার চেয়েও কেন গুরুতর?
মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনের সুরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতে ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। বলা হয়েছে:
وَٱلْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ ٱلْقَتْلِ
অর্থ: “এবং ফিতনা হলো হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ।”
মহা আল্লাহতায়ালার মূল এজেন্ডা হলো মানুষকে জান্নাতে নেয়া। সে এজেন্ডাকে সফল করতেই তিনি লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নাযিল করেছেন অনেকগুলি আসমানী কিতাব। এবং পবিত্র কুর’আন হলো সর্বশেষ কিতাব। মহান রব তাঁর প্রকল্পের প্রতিটি শত্রুকে চিনেন। মহান রব’য়ের মূল প্রতিপক্ষ হলো শয়তান। আর শয়তান যে প্রকল্প নিয়ে হাজির হয় সেটিই হলো ফিতনা। তাই যারা জান্নাতে যেতে চায় তাদের জন্য জরুরি হলো শয়তানের সৃষ্ট ফিতনা থেকে বাঁচা। শয়তানের ফিতনাগুলি নাম রূপে ও নানা নামে হাজির হয়। প্রতিট ফিতনা হলো শয়তানের ফাঁদ। সে ফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে ফিতনাগুলি চিনতে হয়। সে ফেতনা যেমন জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও কম্যুনিজম হতে পারে; তেমনি হতে পারে নানা রূপ ফিরকা ও নানা দলবাদের ফিরকা।
অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, ধর্ষণ বা চুরি-ডাকাতির জন্য নয়। বরং ফিতনার ফাঁদে আটা পড়ায় এবং ফিতনা সৃষ্টিতে সৈনিক হওয়াতে। কারণ ফিতনায় জড়িত হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতিপক্ষ হয়ে খাড়া হওয়। তারা তখন ভোট দিয়ে, অর্থ দিয়ে, মিটিং-মিছিলে স্লোগান দিয়ে এবং রণাঙ্গণে যুদ্ধ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে প্রতিহত করে। ১৯৭১’য়ে তো সেটিই দেখা গেছে। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ এবং ছাত্র-অছাত্র আটকা পড়েছে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও কম্যুনিজম নামক ফিতনার ফাঁদে। অনেকে মুক্তি বাহনীতে যোগ দিয়ে পৌত্তলিক কাফিরদের শিবিরে গিয়ে উঠেছে
মহান রব চান মুসলিম উম্মাহর একতা, শক্তি ও বিজয়। এজন্যই তিনি দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের জন্য নিয়ামত স্বরূপ দান করেছিলেন বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। শত্রুর হাত থেকে মুসলিমদের জান, মাল, ইজ্জত ও স্বাধীনতার নিরাপত্ত দিতে এমন একটি বৃহৎ রাষ্ট্র অপরিহার্য ছিল। এমন একটি রাষ্ট্র গড়া নবীজী (সা:)’র সূন্নত। কিন্তু দেশটির জন্মের পর পরই শয়তানি শক্তির ফিতনা শুরু হয় পাকিস্তানকে খণ্ডিত করায়। পাকিস্তান ভাঙার সে ভারতীয় প্রকল্পের সাথে মুজিব জড়িত হয় ষাটের দশক থেকেই। মুজিবের সাথে ১৯৭১’য়ে জড়িত হয় বাঙালি ফাসিস্ট, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট ও বাঙালি বামপন্থীগণ। তাদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের ফলে পাকিস্তান খণ্ডিত হয়। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারত পরিবেষ্ঠিত এক অরক্ষিত রাষ্ট্রে। আর অরক্ষিত রাষ্ট্রের অর্থই তো পরাধীন রাষ্ট্র। বস্তুত এটিই হলো একাত্তরের অর্জন।
স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ভাবনা ছিল না ফিতনাকারীদের
কোন নারী অরক্ষিত হলে দুর্বৃত্তদের হাতে তাকে বার বার ধর্ষিতা হতে হয়। কারণ, বাঘ-ভালুক না থাকলেও প্রতি জনপদে প্রচুর লোভাতুর দুর্বৃত্ত থাকে। তাই নিজকে সুরক্ষিত রাখার কৌশল থাকতে হয় প্রতিটি নারীর। তেমনি প্রতিরক্ষার সামর্থ্য থাকতে হয় প্রতিটি রাষ্ট্রের। নইলে শত্রুর হাতে পরাজিত ও অধিকৃত হতে হয়। নবাব সিরাজুদ্দৌলার আমলে বাংলা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ। সম্পদ থাকলে ডাকাতেরা ছুটে আসবে সেটিই তো স্বাভাবিক। তাই বাংলার সে অঢেলে সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে বহু সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলার বুকে ছুটে এসেছিল ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ ও পর্তুগিজ ডাকাতগণ। কিন্তু সে ডাকাতদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার সামর্থ্য ছিল না বাংলার শাসকের। ফলে পলাশীর ময়দানে ১৭৫৭ সালে ইংরেজ ডাকাত বাহিনীর হাতে নবাবের বাহিনী পরাজিত হয় এবং ১৯০ বছরের জন্য ব্রিটিশের গোলাম হতে হয়। তাই ইতিহাসের শিক্ষা হলো, শুধু সমৃদ্ধ চাষাবাদ, শিল্প ও সম্পদ থাকলে চলে না, স্বাধীনতার সুরক্ষার সামর্থ্য থাকতে হয়। কিন্তু সে হুশ না থাকলে পরাধীনতা থেকে বাঁচা যায় না।
ইসলামে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার সামর্থ্য বৃদ্ধির কাজটি ফরজ – সে বিষয় মহান রব’য়ের নির্দেশ এসেছে নিচের আয়াতে:
وَأَعِدُّوا۟ لَهُم مَّا ٱسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍۢ وَمِن رِّبَاطِ ٱلْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَءَاخَرِينَ مِن دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ ٱللَّهُ يَعْلَمُهُمْ
অর্থ: “এবং শত্রুদের মোকাবেলায় তোমরা সর্বসামর্থ্য ও অশ্ববাহিনী দিয়ে প্রস্তুত হও এবং তা দিয়ে সন্ত্রস্ত করো আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের এবং এদের ছাড়া সন্ত্রস্ত করো তাদেরকেও যাদের তোমরা জান না, অথচ আল্লাহ তাদের জানেন।” –( সুরা আনফাল, আয়াত ৬০।
উপরিউক্ত আয়াত অনুযায়ী শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি না থাকাটি মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এটি হারাম। ফরজ হলো সে সামর্থ্য বাড়াতে সর্বশক্তি বিনিয়োগ করা। প্রতিরক্ষার সামর্থ্য বৃদ্ধির ফরজ পালনে ব্যর্থ হলে গোলামী নিয়ে বাঁচতে হয়। সে ফরজ পালনে তথা প্রতিরক্ষার সামর্থ্য বাড়াতে তাবুক যুদ্ধের সময় হযররত আবু বকর (রা:) তার সমূদয় সঞ্চয় নবীজী (সা:)’র সামনে পেশ করেছিলেন। হযররত উমর (রা:) তার অর্ধেক সঞ্চয় পেশ করেছিলেন। ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে ভারতের হাতে পরাজয়ের পর পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, “ঘাস খেয়ে হলেও আমরা পারমানবিক অস্ত্র বানাবো।” তার সে নিয়ত ও বিনিয়োগ কাজ দিয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে সে বিনিয়োগের কারণেই সাহাবাদের আমলে মুসলিমগণ রোমান ও পারসিক -এ দুটো বিশ্বশক্তিকে হারিয়ে সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
ভারতের পাকিস্তানীতি এবং বাংলাদেশের ভারতভীতি
পাকিস্তান আজ মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। বিশ্বমাঝে ৬ষ্ঠতম পারমানবিক শক্তি। প্রতিরক্ষার সামর্থ্য বাড়াতে পাকিস্তান শুধু পারমাণবিক বোমা নয়, সে সাথে উন্নত যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, ড্রোন ও দূরপাল্লার মিজাইল বানিয়েছে। গড়ে তুলেছে বিশাল সেনাবাহিনী। পরিণত হয়েছে অস্ত্র রফতানি কারক দেশে। সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের ধনি রাষ্ট্রগুলি আজ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানের দ্বারস্থ হচ্ছে। সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার কাছেও পাকিস্তানের কদর বেড়েছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন না হলে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে সে সম্মানের ভাগীদার পূর্ব পাকিস্তানীরাও হতো। পাকিস্তানের ৪ জন প্রধানমন্ত্রী তো বাঙালি হয়েছে। কিন্তু ভারতের সেবাদাস মুজিব ও তার অনুসারীরা সে সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশীদের আজ প্রতিক্ষণ বাঁচতে হচ্ছে ভারত ভীতি নিয়ে। অথচ খোদ ভারত বাঁচছে পাকিস্তান ভীতি নিয়ে।
প্রতিরক্ষার সামর্থ্য বাড়াতেই ১৯৪৭’য়ের বাংলার প্রজ্ঞাবান ও দেশপ্রেমিক মুসলিম নেতাগণ নিজ গরজে পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলেন। সেটি না করলে সেদিন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা বাঁচতো না। কিন্তু ১৯৭১’য়ে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার সুরক্ষা নিয়ে সামান্যতম ভাবনা ছিল না শেখ মুজিব, মেজর জিয়া, কর্নেল ওসমানী, মাওলানা ভাসানীর ন্যায় নেতাদের। পাকিস্তান ভেঙে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ তৈরীর মধ্যে তারা বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেখেছিল। তারা আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় এজেন্ডার কাছে। তাই তারা ১৯৭১’য়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার চির শত্রু ভারতের কোলে গিয়ে এবং ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতীয় কাফির সেনাবাহিনীর সহযোগী রূপে যুদ্ধ করেছিল এবং ভারতকে বিজয়ী করেছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল; এবং সে বিচ্ছিন্নতাকে স্বাধীনতা মনে করেছিল। অথচ বিচ্ছিন্নতা কোন দেশের স্বাধীনতা বাড়ায় না, বরং পরাধীনতা বাড়ায়। স্বাধীনতা বাড়াতে হলে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়তে হয়। এবং শক্তিশালী মিত্র খুঁজতে হয়। অথচ সেদিকে মুজিবের কোন হুশ ছিল। মুজিব ও হাসিনা বন্ধু বলতে বুঝতো একমাত্র ভারতকে। এভাবে বিচ্ছিন্ন ও বন্ধুহীন বাংলাদেশকে মুজিব এক অরক্ষিত বাংলাদেশে পরিণত করেছিল। অথচ অরক্ষিত দেশ মানেই তো পরাধীন দেশ।
একাত্তরের অর্জিত পরাধীনতা
স্বাধীনতার অর্থ শুধু পশুপাখীর ন্যায় পানাহারে বাঁচা নয়। সেটি হলো পূর্ণ মানবিক অধিকার নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা না থাকার অর্থই তো পরাধীনতা। ১৯৭১’য়ে যুদ্ধে ভারত বিজয়ী হওয়াতে আবারো বিপন্ন হয়েছে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা এবং জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা -যেমনটি হয়েছিল ১৭৫৭ সালে পলাশীতে পরাজয়ের পর। পরাধীন এ দেশটিতে বার বার নেমে এসেছে গণহত্যা। জনগণের পরাধীনতা বাড়াতে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো হয়েছে। সকল মানবাধিকার কেড়ে নিতে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে একদলীয় ফ্যাসিবাদের। প্রতি বছর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলীতে এক হাজারের বেশী বাংলাদেশীদের নিহত হতে হয়। নিহতের মৃত দেহকে তারকাঁটার বেড়ায় ঝুলতে হয়। পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে এমনটি কি কখনো হয়েছে? হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাচার হয়েছে মুজিবের আমলে -যা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্ম দেয়। ভারতীয় ডাকাতির শিকার হয়েছে পদ্মা, তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানি। মুজিব ও হাসিনা -উভয়ের আমলেই শুরু হয়েছিল বিচার বহির্ভুত হত্যা।
১৯৭১’য়ের পর থেকে বাংলাদেশের সরকার নিজেই পরিণত হয় সন্ত্রাসের হাতিয়ারে। মুজিব আমলে সেটি ছিল রক্ষি বাহিনীর সন্ত্রাস। হাসিনার আমলে সেটি পরিণত হয় RAB, ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সন্ত্রাসে। স্বাধীনতা পেয়েছিল শুধু মুজিব-হাসিনা ও তার অনুগত খুনিরা। ১৯৭১’য়ের ২৫ শে মার্চের রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে যত মানুষ নিহত হয়েছে তার চেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে হাসিনা এবং মুজিব আমলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। ৩০ হাজারের বেশী খুন হয়েছে রক্ষিবাহিনীর হাতে। ২০০৯ সালে সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলেছে পিলখানায়; নিহত হয়েছে ৫৭ জন অফিসার। ২০১৩ সালে হিফাজতে ইসলামীর কর্মীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা হয়েছে শাপলা চত্বরে; নিহত হয়েছে শত শত। ২০২৪ সালে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছে ছাত্রদের বিরুদ্ধে। নিহত ও আহতদের সংখ্যা ২৩ হাজারের বেশী। এসবই একাত্তরের ফিতনার ফসল।
চাই বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ অবধি ২৩ বছরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে একজন পূর্ব পাকিস্তানীও নিহত হয়নি। কোন দুর্ভিক্ষ আসেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে সময় যারা নিহত হয়েছিল তারা নিহত হয়েছিল বাঙালি পুলিশের হাতে। অথচ তখনও পূর্ব পাকিস্তানের সেনানীবাসগুলিতে বহু হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের অবস্থান ছিল। অথচ ভারতীয় মিডিয়ার সাথে একাত্ম হয়ে বিগত ৫৪ বছর প্রচার চালানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের এজেন্ডা ছিল বাঙালি নির্মূলের গণহত্যা! এবং চেয়েছিল বাঙালি মুখের ভাষা কেড়ে নিতে। সে প্রচার বাংলাদেশীদের মাঝে বিশাল বাজারও পেয়েছিল। এরাই রাজাকারদের ঘৃণার চোখে দেখে। এরাই পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ঘোরতর বিরোধী। এ থেকে বুঝা যায়, একাত্তরের ফিতনা ভারতকে শুধু বাংলাদেশের উপর ভূ-রাজনৈতিক দখলদারিই দেয়নি, দখলদারি দিয়েছিল বাংলাদেশীদের চেতনার ভূবনেও।
হাসিনার পলায়নের পর ভারতের রাজনৈতিক দখলদারি আপাতত শেষ মনে হলেও বাংলাদেশীদর উপর বুদ্ধিবৃত্তিক দখলদারি এখনও প্রকট ভাবে রয়েছে। সেটি বুঝা যায় প্যান-ইসলামী চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতা দেখে। এরা খুনি মুজিবের ন্যায় অপরাধীকে এখনো বঙ্গবন্ধুকে বলে। এ ভারতমুখী চেতনার দাফন করা জরুরি। একাত্তরকে ঘিরে ভারতীয় ফিতনার এ বিষাক্ত বয়ান দাফন করতে না পারলে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় আধিপত্য দাফন করা অসম্ভব হবে। তাই যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঁচাতে চায় তাদের লড়াইটি শুধু রাজনৈতিক হলে চলবে না, প্রবল ভাবে হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণেও।


























