প্রসঙ্গ – কিস্তি টুপি ও কিছু কথা ——— মোশারফ হোসেন

- Update Time : ০২:২৫:১৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
- / ২৮৩ Time View
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও সভ্যতায় টুপির নিদর্শন রয়েছে। একেক দেশের টুপির সংস্কৃতি একেক
রকম। প্রাচীনকাল থেকেই টুপি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। গোড়ার দিকে মানুষ মাথা ঢাকার জন্য
পাতা, পশুর চামড়া, পাখির পালক ইত্যাদি ব্যবহার করতো। একসময় এটি সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে
জড়িয়ে যায়। রাজা, বাদশা ও যোদ্ধারা মাথায় মুকুট আর শিরোস্ত্রাণ পরিধান করতে থাকে। বিভিন্ন
অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের টুপির প্রচলন দেখা যায়। ধর্মীয় অঙ্গনের বাইরে বা বিশেষ ঘরানায়
আলাদা আলাদা টুপি ব্যবহারের রীতি চালু আছে। এগুলোর ব্যবহার ও ধরন হিসেবে বিভিন্ন নামও
আছে। যেমন- গোল টুপি, লম্বা টুপি বা কিস্তি টুপি, পাঁচকল্লি টুপি, চারকল্লি টুপি, জিন্নাহ টুপি,
গান্ধী টুপি, নেহরু টুপি, নেপালি টুপি, মালয়েশিয়ান টুপি, শামি টুপি, তুর্কি টুপি, রুমি টুপি,
পাকিস্তানি টুপি, সৌদি টুপি, আরবি টুপি, জালি টুপি, তালি টুপি, বেতের টুপি, খানকা টুপি, দরবারি
টুপি, পিরালি টুপি, মুরিদি টুপি, কংগ্রেসি টুপি, বিয়ের টুপি ও ঈদের টুপি ইত্যাদি। আজ আমাদের
দেশের অন্তরবর্তী কালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাথায় নৌকার
কাঠামোর মত সাদা টুপি দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে এই টুপির ইতিহাস কি ? বন্ধুগন এটি
আমাদের দেশে কিস্তি টুপি নামে পরিচিত। এই টুপি একসময় বাংলার মুসলিম সমাজের পরিচিত পোশাক ছিল। এর
শিকড় ঐতিহাসিকভাবে মুঘল ও উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কিস্তি টুপি শব্দটির
উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া কঠিন, তবে এটি ফারসি কেশতি শব্দ থেকে আসতে পারে, যার অর্থ
"নৌকা" । অনেক কিস্তি টুপির সামনের অংশ উঁচু ও বাঁকা থাকত, যা নৌকার কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে দরবারে উপস্থিত হওয়ার সময় হিন্দু রাজারা ধূতি, পৈতা ও টিকলি পরতেন।
আকবর এটিকে অশোভন মনে করে অমুসলমানদের জন্য কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী ও কিস্তি টুপি পরিধানের
নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে এই টুপি মুঘল আমলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দেওবন্দ
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতুবী কিস্তি টুপি ও কোণা ফাড়া পাঞ্জাবী পরতেন। তার
অনুসারীদের মাধ্যমে এটি দেওবন্দি আলেমদের পোশাকে পরিণত হয়। ভারতে জহরলাল নেহেরু থেকে এখন
পর্যন্ত কিস্তি টুপির নমুনায় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে ও ভারতীয় অনেক নামী দামী ব্যক্তিদেরকে টুপি পরতে
দেখা গেছে। আমাদের দেশে হক্কানী আলেম প্রয়াত মাওলানা আমিনুল হক, প্রখ্যাত তাফসিরকারক মাওলানা
নূরুল ইসলাম অলিপুরী, নেজামে ইসলাম পার্টির প্রয়াত আশরাফ আলী ধরমন্ডলী ও ইসলামী ঐক্যজোটের
মহাসচিব প্রয়াত মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামীকে কিস্তি টুপি মাথায় দিতে দেখা গেছে। পূর্ববাংলার চাষা-
মজদুর থেকে শুরু করে জমিদার, পণ্ডিত ও আলেমগণ এ টুপি ব্যবহার করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক
প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বও এটি পরিধান করতেন, যা একসময় বাংলার মুসলিম সমাজে এটি সংস্কৃতির অংশ করে
তোলে। কিস্তি টুপি বাংলার মুসলিম সমাজে কেবল ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত
হয়েছিল। কৃষক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এটি ছিল জনপ্রিয়, বিশেষত গ্রামীণ সমাজে। শেখ মুজিবুর
রহমানের কিস্তি টুপি পরিধান এটিকে রাজনৈতিকভাবেও পরিচিত করে তোলে। কালের পরিক্রমায় পাঞ্জাবি ও
টুপি সংস্কৃতির পরিবর্তন আসে, ফলে কিস্তি টুপির ব্যবহার কমতে থাকে। বর্তমানে এটি অনেকটাই
ঐতিহাসিক স্মারক হয়ে উঠেছে। কারন নদীর জল একস্থানে সবসময় থাকে না। ইসলামী আইনবিদদের একটি
অংশ কিস্তি টুপিকে "হারাম" বলে ঘোষণা করেছেন। তাদের যুক্তি নিম্নরূপ- অনেক আলেমের মতে, কিস্তি টুপি
হিন্দু মারওয়ারী ও অমুসলিমদের পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও কিস্তি টুপি পরিধানে আমরা
নিষেধাজ্ঞাও দেখতে পায়, তবে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এটি দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছে। কালের বিবর্তনে এর ব্যবহার কমে গেলেও, ঐতিহাসিক গবেষণা ও বিতর্কে এটি এখনো
প্রাসঙ্গিক। স্বনামধন্য বাঙালি ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও তার
জাঁকজমকপূর্ণ রাজত্বকাল সম্পর্কে লিখেছেন, মহান এই মোগলের অধীনে 'ভারতের ঐশ্বর্য' বিদেশি
পর্যটকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, আর আনন্দোৎসবের দিনগুলোতে বুখারা, পারস্য, তুরস্ক, আর আরবের
রাজদূত, সেই সঙ্গে ফ্রান্স আর ইতালির পর্যটকেরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে হয়ে তাকিয়ে থেকেছে ময়ূর সিংহাসন,
কোহিনূর এবং অন্যান্য রত্নরাজির দিকে। তাঁর ভালোবাসার অট্টালিকাগুলোতে ব্যবহৃত শ্বেতপাথর যেমন
দামি, তেমনই বিশুদ্ধ তাদের ডিজাইন। জাঁকজমক আর ঐশ্বর্যে সাম্রাজ্যের সভাসদদের কাছেই হার মেনেছে
অন্যান্য রাজ্যের রাজারা। সাম্রাজ্যজুড়ে বিরাজ করেছে গভীর সুখ শান্তি। যত্নের সঙ্গে লালিত হয়েছে
চাষাবাদ; প্রজাদের অভিযোগে অনেকবার পদচ্যুত করা হয়েছে রূঢ় আর জুলুমকারী শাসককে। সবখানে বয়ে
গেছে ঐশ্বর্য আর উন্নতির জোয়ার। দয়ালু অথচ জ্ঞানী একজন প্রভু হিসেবে শাহজাহান নিয়োগ দিয়েছেন
অত্যন্ত দক্ষ কর্মচারীদের, তাঁর দরবার পরিণত হয়েছে দেশের বুদ্ধি আর জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে। মোগল
সম্রাজ্যে বাদশা আকবরের উপর সবচাইতে ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করে হিন্দুরা। যৌবনে রানী যোধবাই ও
অন্যান্য হিন্দু রাজপুত মহিলাদের পনি গ্রহণ করে যার ফলে হিন্দুদের সাথে অবাধ মেলামেশা করে হিন্দু
ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে। এবং হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ ফারসীতে অনুবাদ করার নির্দেশ দেয়। এরফলে
মুসলমানদের মধ্যেও হিন্দু মনোভাবাপন্ন একটি দল সৃষ্টি হয়। এসময় পুরুষোত্তম ব্রাম্মনের প্রভাবে বাদশা
আকবর জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী হয়। এবং পূনর্জনম ছাড়া শান্তি সম্ভব নয় বলে মনে করে। আর আকবর
তার দ্বীনে- এলাহীর জন্য পূনজন্ম বিশ্বাসী হওয়া জরুরী মনে করতো। ( মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড
)। আকবর এ সময় গরুকে শক্তির উৎস মনে করতো। সে গরু কুরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং গরুর গোশত
খাওয়ার উপরও বিধি নিষেধ আরোপ করে। কেননা হিন্দুরা গরু পুজা করতো এবং গোমুত্র পবিত্র মনে করতো।"
(মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড ৩২৬ পৃষ্ঠা)। হেরেমের রাজপুত ও হিন্দু রমনীদের প্রভাবে আকবর
গোশত ভক্ষন পরিহার করে এবং সুদীর্ঘ সাত মাস তার রান্ধনশালায় কোন গোশত রান্না হয় নাই। রাজা
দেবচাঁদ বাদশা আকবরকে বলতো, আল্লাহ দরবারে গরু খুবই সম্মানিত। অন্যথায় গরুর কথা কুরআন শরীফে
প্রথম দিকে কিছুতেই উল্লেখ থাকতো না। এদিকে রাজা ভবনদাসের মেয়ের সাথে আকবর তার ছেলে সেলিমের
বিয়ে সম্পূর্ণ হিন্দু রীতিতে সম্পন্ন করে। হিন্দু সমাজে সুদ দেয়া নেয়া কোন ব্যাপার নয়, তাদের প্রভাবে
আকবর সুদ, পাশা, জুয়া ইত্যাদি বৈধ ঘোষণা করে।
রাজ দরবারে জুয়ার জন্য আলাদা গৃহ নির্মান করা হয় এবং
জুয়াড়ীদের সরকারী কোষাগার থেকে সুদে টাকা ধার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দু সমাজের দ্বারা প্রভাবিত
হয়ে আকবর, মুসলিমদের চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো বোন বিবাহ নিষেধ করে আইন করে। হিন্দুরা
যেহেতু পর্দা করে না তাই সে নির্দেশ দেয় ভবিষ্যতে কোন মুসলমান মহিলা পর্দা করে বাইরে যেতে পারবে না।
সে আরবি ভাষার তথা কুরআন হাদীস শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এসময় অধিকাংশ হক্কানী
আলেমগন দেশ ত্যাগ করেন এবং আলেমের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মসজিদ মাদ্রাসা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
সেসময় হিন্দুরাও মুসলমানদের মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানাতে শুরু করে।
Share your link and rake in rewards—join our affiliate team! https://shorturl.fm/d08P2