১৪ আগষ্ট বাংলার বিভক্তি কি মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা? -আতিকুল ইসলাম

- Update Time : ০৪:৩৭:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ অগাস্ট ২০২৫
- / ৮৬ Time View
১. ভেঙ্গে পড়া আইন শৃংখলা পুন:প’তিষ্ঠা ও প’শাসনিক সুবিধার স্বার্থে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৮৬ বর্গ মাইলের বিশাল আয়তনের বেঙ্গল ফোর্ট উইলিয়াম পে’সিডেন্সী ভেঙ্গে একটি নতুন প’দেশ গঠনের বৃটিশ সরকারের পরিকল্পনার একটি খসড়া প’স্তাব ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারী গেজেটে প’কাশিত হয়। এই পে’সিডেন্সীর পূর্ব সীমানা থেকে পশ্চিম সীমানার দুরত্ব প’ায় ৮০০ মাইল। গেজেটে প’কাশিত প’স্তাবকে সামনে রেখে ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারী নবাব খাজা সলিমুল্লাহ‘র (১৮৭১-১৯১৫) আহ্বানে ও সভাপতিত্বে আহসান মঞ্ছিলে মুসলমানদের এক মত বিনিময় সভা হয়। সভাপতির ভাষণে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ১৮৭৪ সালের ১২ অক্টোবর গঠিত আসাম প’দেশ, ঢাকা বিভাগ, চট্টগ’াম বিভাগ, রাজশাহী বিভাগ এবং দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহারসহ পে’সিডেন্সী বিভাগের যশোর ও খুলনা জিলা দুটোর সমন্বয়ে ব্যবস্থাপক সভা বিশিষ্ট গভর্ণর শাসিত একটি নতুন প’দেশ গঠন এবং মুঘল রাজধানীর হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে ঢাকা‘কে নতুন প’দেশের রাজধানী করার প’স্তাব দেন।
পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের সামাজিক নেতা ও পরস্পরা নবাব এর প’স্তাব আমলে নিয়ে লর্ড কার্জন নতুন প’দেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির প’য়োজন অনুভব করেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯০৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী চট্টগ’ামে, ১৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় এবং ২০ শে ফেব্রুয়ারী মোমেনশাহীতে অনুষ্ঠিত জনসভায় লর্ড কার্জন উনড়বততর জীবন যাপনের জন্য নতুন প’দেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। ঢাকা সফর কালে বৃটিশ রাজপরিবারের সদস্য লর্ড কার্জন নবাব বাড়ী আহসান মঞ্ছিলের মেহমান হন। এই সময় নতুন প’দেশ কার্যকর করা নিয়ে নবারের সঙ্গে লর্ড কার্জন একান্তে আলোচনা করেন। নবাব খাজা সলিমুল্লাহ নিজের বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করে আহসান মঞ্ছিলের মাঠে লর্ড কার্জনের সম্মানে অদৃষ্টপূর্ব এক জমকালো সম্বর্ধনার আয়োজন করেন। উক্ত সম্বর্ধনায় উপস্থিত হাজার হাজার শে’াতার কাছে ভাইসরয় নতুন প’দেশের পক্ষে যুক্তি উণ্ডাপন করে বক্তব্য রাখেন।
২. বৃটিশ রাজা (১৯০১-১৯১০) সপ্তম এডওয়ার্ড এর কাছ থেকে চুড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে ভাইসরয় (১৮৯৯-১৯০৫) লর্ড জর্জ ন্যাথালিয়েন কার্জন (১৮৫৯-১৯২৫) বঙ্গভঙ্গ করে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর পূর্ববঙ্গ ও আসাম প’দেশ গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। নতুন প’দেশের রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ’াম বন্দর নগরী। অখন্ড বাংলার ১৪টি জিলা ও ২টি দেশীয় রাজ্য নতুন প’দেশে অর্ন্তভূক্ত হয়। সেগুলো হলো: বাকেরগঞ্ছ, ফরিদপুর, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, ঢাকা, মোমেনশাহী, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম এবং ১৮৭৪ সালের ১২ অক্টোবর ১০টি জিলা নিয়ে গঠিত আসাম প’দেশ। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প’দেশের সীমানা এমন ভাবে চিহ্নিত হয়, যার ফলে হিন্দি ভাষী কোনো এলাকা অন্তর্ভূক্ত হয়নি। নতুন প’দেশের আয়তন ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৩ কোটি ১০ লক্ষ। এর মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মুসলিম এবং ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দু আর বাকী ১০ লক্ষ বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প’দেশের প’থম গভর্ণর তদানীন্তন আসাম প’দেশের চীফ কমিশনার র্যামফিল্ড ফুলার (১৮৫৪-১৯৩৫) যিনি নতুন প’দেশের একজন ঘোর সমর্থক।
৩. শুরু থেকেই বাংলার বর্ণবাদী বাবুরা প’বল ভাবে নতুন প’দেশ গঠনের প’স্তাবের বিরোধীতা করেন। কালকাতা প’বাসী পূর্ব বঙ্গের জমিদার, ভূ-স্বামী, জোতদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীসহ বিভিনড়ব পেশাজীবি তাদের কায়েমী স্বার্থে কুষ্টিয়ার জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তুলেন। বঙ্গভঙ্গের দিন ১৬ অক্টোবর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে কলিকাতায় পালিত হয় ধর্মঘট এবং গঙ্গা¯ড়বান, কালীপূজা ও রাখী বন্ধন কর্মসূচী। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অখন্ড বাংলার জন্য রচিত বেশ কয়টি গান এ সময় গীত হয়। এর মধ্যে ১৯০৫ সালের ৭ অক্টোবর কলিকাতার টাউন হলের প’তিবাদ সভায় প’থম গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি অন্যতম যা খন্ডিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এই সময় বিলাতি পণ্য বর্জনের নামে গড়ে উঠে স্বদেশী আন্দোলন। কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরসহ বিশিষ্ট কয়েকজন হিন্দু জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯০৬ সালে চালু হয় শিবাজী উৎসব এবং গড়ে তোলা হয় কয়েকটি সন্ত্রাসী দল। উপমহাদেশে বোমাবাজীর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় কলিকাতা
২
থেকে যা পরবর্তীতে সুস্থ রাজনীতিকে কলুষিত করে। ১৯০৬ সালের ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর দাদাভাই নওরোজীর সভাপতিত্বে এবং কংগে’সের নজরকাড়া তরুণ নেতা ব্যারিষ্টার মুহাম্মদ আলী জিনড়বাহ‘র (১৮৭৬-১৯৪৮) অংশ গ’হণে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগে’সের ২২তম অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প’স্তাব গৃহীত হলে তা সর্বভারতীয় বিরোধীতায় পরিণত হয়। তাদের এই আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ রহিত করার লক্ষ্যে, কোনো ভাবেই বৃ্িটশ শাসন বিরোধী ছিলো না।
৪. কলিকাতা থেকে প’কাশিত ভারত কি করে ভাগ হল গ’ন্থে বিমলানন্দ শাসমল সত্য প’কাশ করে বলেছেন: ্রবঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীত ভাবে মুসলিম বিরোধী এবং গভীর ভাবে মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনের তাগিদে যে সকল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প’কাশিত হলেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন গভীর ভাবে মুসলমান বিরোধী”। বঙ্গভঙ্গ করে নতুন প’দেশ গঠন করার পর পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত ও হতদরিদ্র ভূমিদাস মুসলিমদের সামনে সর্বক্ষেত্রে ভাগ্যোনড়বয়নের শত বছরের রুদ্ধ কপাটটি খুলে যায়। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে হিন্দু জমিদার ও সমাজপতিরা মুসলমানদের উনড়বতি ঠেকাতে নতুন প’দেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন প’তিবাদ অব্যাহত রাখেন। ১৮১৩ সালে সিলেক্ট কমিটিতে স্যার জন ম্যালকম বলেছিলেনঃ” হিন্দু সম্প্রদায়ের আনুগত্য আমাদের ভারত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার প’ধান উৎস।”
৫. বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলিকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার সমাজপতি ও বুদ্ধিজীবিদের সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে মুকাবিলা করার মতো অনুরূপ ঐক্য পূর্ব বঙ্গের পশ্চাৎপদ ও অসচেতন মুসলিমদের মধ্যে ছিলোনা। ফলে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন প’দেশের পক্ষে বৃটিশ ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সমর্থনের প’য়োজনীয়তা নির্ভূল ভাবে উপলব্ধি করেন। তাই তিনি ১৯০৬ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর নতুন রাজধানী ঢাকায় নিজ খরচে আয়োজন করেন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স’ এর ২০তম অধিবেশন। এই ঐতিহাসিক অধিবেশন সফল করতে তাঁর একমাত্র সার্বক্ষনিক সহকর্মী, নবাবের ব্রেইন চাইল্ড নামে খ্যাত তরুণ আইনজীবি এ, কে, ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২)। সর্ব ভারত থেকে ঢাকায় আগত ২৪২৩ জন বিশিষ্ট মুসলিম প’তিনিধিদের ছয়দিন থাকা ও খানা পিনার অবিশ্বাস ব্যবস্থা করেন মেজবান নবাব। অধিবেশন শেষে নবাবের অনুরোধে ৩০ ডিসেম্বর এক বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইংরেজীতে প’দত্ত দীর্ঘ ভাষণে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ পরাধীন ভারতের মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষাসহ জাতিসত্ত্বার চেতনায় তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠনের প’স্তাব উণ্ডাপন করেন। প’স্তাবটি সর্বসম্মতিμমে গৃহীত হবার পর ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত নবাবদের ইশারাত মনজিলের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন) ময়দানে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। নব গঠিত দলের আহ্বায়ক পদে নবাব ভিকারুল মুলক মোশতাক হোসাইন বাহাদুর (১৮৪১-১৯১৭) এবং সদস্য সচিব পদে নবাব মহসিন-উল-মুল্ক মেহেদী আলী খান (১৮৩৭-১৯০৭) নির্বাচিত হন।
৬. ১৯০৮ সালের ৯ আগষ্ট আলীগড়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কেন্দ্রিয় আহ্বায়ক কমিটির সভায় ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে মুসলিম প’তিনিধি অন্তর্ভুক্ত, মুসলিম বিচারপতি নিয়োগ করে পূর্ববঙ্গ আসাম প’দেশের রাজধানী ঢাকায় স্বতন্ত্র হাইকোর্ট স্থাপনের দাবীসহ বঙ্গভঙ্গ বিরোধীতার ঘটনায় উদ্বেগ প’কাশ করে প’স্তাব গ্রহণ করা হয়। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে পূর্ববঙ্গ আসাম প’দেশের প’তি সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের কার্যকর সমর্থন ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে তরুণ নবাব খাজা সলিমুল্লাহ‘র দুরদর্শিতা প’মাণিত হয়। নবাব খাজা সলিমুল্লাহ‘র উদ্দ্যেগে ও একক অর্থায়নে ১৯০৬ সালে ঢাকায় গঠিত মুসলিম লীগৈর আদর্শিক পতাকা নিয়ে মুসলিমরা ১৯০৭ সালে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প’বেশ করার সুযোগ লাভ করে। ফলে ভারতের রাজনীতিতে কংগে’সের ২১ বছরের একক কর্তৃত্ব ও একচ্ছত্র আধিপত্য হ্রাস পায়। অত:পর আমাদের পূর্ব পুরুষদের লুন্ঠিত অধিকার পুনরুদ্ধারের গৌরব নিয়ে মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগষ্ট বৃটিশ ভারতকে বিভক্ত করে দুইটি প’দেশের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে।
৩
৭. পলাশী যুদ্ধের পর ১৪৯ বছর ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের আনুগত্য ও সহযোগিতার উপর ভর করে বৃটিশরা বাংলা ও ভারত লুন্ঠন এবং শাসন করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই সম্প্রদায়ের আনুগত্য অক্ষুনড়ব রাখতে বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ নিয়ে পুনরায় ভাবতে থাকেন। “বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করলে বাংলার হিন্দু নেতারা তা মেনে নিলে রাজা পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রহিত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প’দেশ বিলুপ্ত করবেন——” ভাইসরয় (১৯১০-১৯১৬) লর্ড ব্যারন হার্ডিঞ্ছের কাছ থেকে এমন সুস্পষ্ট বার্তা পেয়ে উল্লসিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা পঞ্চম জর্জকে ভারতের ভগবান বা ভাগ্য বিধাতার চেয়ার অধিষ্ঠিত করে লিখলেন: ্রজনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা…” গানটি যা বৃটিশ রাজার উদ্দেশ্যে প’থম গীত হয় ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীর দরকার হলে। ভাইসরয়ের বক্তৃতার পর রাজা হঠাৎ ঘোষণা করলেনঃ “ভারতের রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হবে। বঙ্গভঙ্গ রহিত করা হলো”। এই ঘোষণা শুনে দরবার হলে উপস্থিত নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও অন্যান্য মুসলিম নেতারা হতবাক হলেন কিšদ প’তিবাদ করতে পারলেন না, কারণ শাসনতান্ত্রিক বিধানে রাজার উক্তির বিরুদ্ধে কারো পক্ষে কোনো আপত্তি উণ্ডাাপন করার অধিকার ছিলোনা। অনুগত হিন্দু সম্প্রদায়কে সšদষ্ট রাখতে বঙ্গভঙ্গ রহিত করে পূর্ববঙ্গ ও আসামের পশ্চাৎপদ মুসলমানদের পুনরায় অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিতে বৃটিশ রাজা সেদিন কুন্ঠাবোধ করেন নি।
৮. বঙ্গভঙ্গ রহিত করায় নতুন প’দেশ বিলুপ্ত হয়। কলিকাতা পুনরায় অখন্ড বাংলার রাজধানী হবার পর ঢাকা আবার জিলা শহরে পরিণত হয় যা ছিলো ১৯৪৭ সালের ১৩ আগষ্ট পর্যন্ত। নতুন প’দেশটি বিলুপ্ত করার পর থেকে হতাশায় নবাব খাজা সলিমুল্লাহ শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন। বাংলার মুসলমানদের একমাত্র নেতা ও তাঁদের রাজনীতি ও শিক্ষা বিস্তারের পথ প’দর্শক দানবীর নবাব খাজা সলিমুল্লাহ কলিকাতাস্থ ডালহৌসী স্কোয়ারের নিজ বাসভবনে ১৯১৫ সালের ১৬জানুয়ারী মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দাফনের জন্য নবাবকে ঢাকায় আনার পর বৃটিশ সরকার লাশ দেখার অনুমতি দেয়নি তাঁর আতড়বীয় স্বজন ও ষোকাহত ঢাকাবাসীদের। সৈন্যরা বেগম বাজারস্থ তাঁর কবরটি ছয় মাস পাহারা দিয়ে রাখে। তাতেই অনুমতি হয় যে, নবাবকে বিষ প’য়োগে হত্যা করা হয়। নবাবের মৃত্যুর পর পূর্ববঙ্গের আশাহত মুসলিমরা উপলব্ধি করেন যে, মুসলিম লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায় করতো না পারলে হিন্দুদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে বাঁচতে হবে। ফলে জাতিসত্ত্বার চেতনা নিয়ে আমাদের মুক্তিপাগল পূর্ব পুরুষরা ২৬ বছর পর ১৯৩৭ সালে অষ্কুরোদগম ঘটায় স্বাধীন রাষ্ট্রের সম্ভাবনার বীজটি। পলাশী যুদ্ধে শাসন ক্ষমতা হারানোর ১৮০ বছর পর ১৯৩৭ সালে নির্বাচিত হয়ে মুসলমানরা পুনরায় বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হয়। প’থম মুসলিম মূখ্যমন্ত্রী (১৯৩৭-৪৩) শের-এ- বাংলা এ,কে, ফজলুল হক, দ্বিতীয় মূখ্যমন্ত্রী (১৯৪৩-৪৬) খাজা নাজিমউদ্দিন এবং তৃতীয় মূখ্যমন্ত্রী (১৯৪৬-৪৭) হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী‘র মতো মুসলিম লীগের তিন কিংবদন্তী নেতা অখন্ড বাংলাকে শাসক করার গৌরব অর্জন করেন।
৯. ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। ফলে মুসলিম বিদ্বেষী কলিকাতার বর্ণবাদী হিন্দু নেতারা নিশ্চিত হন যে, মুসলিম লীগের প’স্তাব গ’হণ করে অখন্ড স্বাধীন বাংলা গঠন করলে বাংলায় মুসলিম শাসন স্থায়ী ভাবে প’তিষ্ঠিত হবে। তাই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে বাংলাকে ভাগ করতে তারা তৎপর হয়ে উঠেন। বাংলা ভাগকে অনিবার্য করতে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট কংগে’স ও হিন্দু মহাসভা কলিকাতায় সৃষ্টি করেন তিনদিন ব্যাপী ভয়াবহ দাঙ্গা। দাঙ্গায় ১০ হাজার মুসলিম নিহত হয়। এই দাঙ্গা ‘গে’ট ক্যালকাটা কিলিং নামে ’ ইতিহাসে অভিহিত। এইচ, ভি, হাডসন তাঁর দ্যা গে’ট ডিভাইড গ’ন্থে, আয়ান ষ্টিফেন তাঁর পাকিস্তান গ’ন্থে, কলিন্স ও লেপিয়ার তাদের ফ্রিডম এট মিডনাইট গ’ন্থে এবং দাঙ্গার প’ত্যক্ষদর্শী শেখ মুজিবর রহমান তার অসমাপ্ত আতড়বজীবনীতে ক্যালকাটা কিলিং এর ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন।
১০. হিন্দু মহাসভা ও কংগে’স নেতা ডা: শ্যামা প’সাদ মুখার্জি ১৯৪৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী এক বিবৃতিতে বললেন: “ভারত যদি ভাগ হয় তাহলে বাংলাকেও ভাগ করে হিন্দু সংখ্যাগুরু অঞ্চল আলাদা করতে হবে।” ৮ই মার্চ কংগে’স ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার প’স্তাব গৃহীত হয়। এই প’স্তাবের বিরোধীতা করে ১৬ই মার্চ
৪
দিনাজপুরে মুসলিম লীগের জনসভায় স্পীকার নূরুল আমিন বলেন: অখন্ড বাংলা হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ২২শে এপি’ল সাবেক মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪) বলেন: বাংলাকে ভাগ করলে তা হবে বাঙালীর জন্য মারাতড়বক ক্ষতিকর। ২২শে এপি’ল মূখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) বলেন: খন্ডিত পশ্চিম বঙ্গ হবে পশ্চিম ভারতের কলোনী। ১লা মে মুসলিম লীগ সভাপতি জিনড়বাহ বলেন: বাংলা ভাগের দাবী বিদ্বেষপূর্ণ ও দুরভিসন্ধীমূলক। ৫ই মে হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দীর কলিকাতাস্থ ৪০নং থিয়েটার রোডের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় হিন্দু মুসলিম নেতাদের নিয়ে স্বাধীন বাংলার খসড়া সংবিধান রচনার জন্য হোসেন শাহীদ সোহরোওয়াার্দী, খাজা নাজিমউদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, ফজলুর রহমান, পন্ডিত আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বোস, কিরণ শংকর রায়, নলিনী রঞ্ছন সরকার ও সত্য রঞ্ছন বকশী সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
১১. নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এর অগ’জ, ফরোয়ার্ড ব্লক ও কংগে’স নেতা শথরৎচন্দ্র বোস (১৮৮৯-১৯৫০) এর ১নং উডভার্ন পার্কের বাস ভবনে ২০শে মে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাধীন বাংলার খসড়া সংবিধান ও একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন পন্ডিত আবুল হাশিম ও শরৎ চন্দ্র বোস। বিষয়টি জানিয়ে শরৎচন্দ্র বোস ২৩মে গান্ধীকে একটি চিঠি পাঠান। প্রতি উত্তরে শরৎচন্দ্র বোসকে তিরস্কার করে ২৩ জুন কংগে’স নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) লিখেন: ্র………. তোমার উচিৎ হবে অখন্ড বাংলার জন্য সংগ’াম ত্যাগ করা এবং বাংলার বিভক্তির জন্য যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে কোনো বিঘড়ব সৃষ্টি না করা”।
১২. এইচ,বি,হাডসন তাঁর দ্যা গে’ট ডিভাইড গ’ন্থের ২৪৬ পৃ: বলেছেন: ্র২৩ এপি’ল পাঞ্চাব নিয়ে আলাপ কালে মাউন্ট ব্যাটেন অপ’াসঙ্গিক ভাবে জিনড়বাহকে বললেন: সোহরোওয়ার্দী ও তাঁর বন্ধুরা স্বাধীন বাংলা গঠন করার চেষ্টা করছে। অখন্ড স্বাধীন বাংলা‘র ব্যাপারে আপনার মত কি? অবশ্যি স্বাধীন বাংলা পাকিস্তানের বাইরে থাকবে”। জিনড়বাহ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন:্রবাংলা স্বাধীন হলে আমি খুশী হবো। কলিকাতা ছাড়া বাংলার মূল্য নেই। তাঁরা যদি একত্র হয়ে স্বাধীন বাংলা গঠন করে, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে তারা সদ্ভার রাখবে।” মুসলিম লীগের সেμেটারী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান স্বাধীন বাংলার পক্ষে ছিলেন। বিμমাদিত্য তাঁর স্বাধীনতার অজানা কথা গ’ন্থে বলেছেন: “…….. জিনড়বাহ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিলেন যে, বাংলা ও পাঞ্ছাবকে তিনি অখন্ড রাখতে পারবেন এবং বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।”
১৩. কতিপয় ব্যক্তি ব্যাতীত সকল হিন্দু দল ও সংগঠন এবং কংগে’স বাংলাকে বিভক্ত করার দাবী করেছে। বৃটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত মতে ভাইসরয় (১৯৪৭) এ্যাডমিরাল লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন পাঞ্ছাব ও বাংলা ভাগ করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েও ১৯১১সালে যেমন বঙ্গভঙ্গ রক্ষা করতে পারেনি তেমনি সর্বাতড়বক চেষ্টা করেও মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট বাংলার বিভক্তি ঠেকাতে পারেনি। বঙ্গ মাতার অঙ্গহানি করা হয়েছে বলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যে সকল বিপ্লবী যুব নেতারা রাজধানীর বিনিময়ে বঙ্গভঙ্গ রহিত করেছিলেন, তারাই ৩৫ বছর পর তাদের বঙ্গ মাতাকে বলি দিয়ে দ্বিখন্ডিত করেছেন। ১৯৪৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে তিনি কি মুসলিম লীগকে সমর্থন করে ১৯০৫ সালের মত অখন্ড স্বাধীন বাংলার পক্ষে থাকতেন? প’শড়বটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে। বাংলার বিভক্তি মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা কিনা তা বিজ্ঞ পাঠকই নির্ধারণ করবেন।
লেখক: স্থায়ী কমিটির সদস্য বাংলাদেশ মুসলিম লীগ। তারিখ: ০৭/০৮/২০২৫