০১:৫০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল ও সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ প্রসঙ্গ এবং বাঙালি মুসলিমের আমল নামা

Reporter Name
  • Update Time : ০২:২৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
  • / ১১২ Time View

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 

নেক আমলের শুরু সত্যের আবিস্কার থেকে

কিছু বিকলাঙ্গ মানব ছাড়া প্রায় প্রতিটি মানব সন্তানকে মহান আল্লাহ তায়ালা বিস্ময়কর সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। চরিত্র ও কর্মের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে সে যেমন ফেরেশতার চেয়েও উত্তম হতে পারে, তেমনি চারিত্রিক স্খলনের কারণে পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর ও নৃশংসতর হতে পারে। ইতিহাস মানব চরিত্রের এরূপ উত্থান ও পতনের এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্তে ভরপুর। নবীজী (সা:)’র আমলে তাঁর সাহাবাগণ চরিত্র, কর্ম ও সততায় সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে বেড়ে উঠতে পেরছিলেন। সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। কারণ সত্য আবিস্কারে এবং সে সত্য পালনে তারাই ছিলেন সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। অপরদিকে ফিরাউন, চিঙ্গিস খাঁ ও হিটলারের অনুসারী এবং আজকের মার্কিনী ও ইসরাইলীরা ইতিহাস গড়েছে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং নানারূপ নৃশংস অপরাধ কর্মে।

মানব কিরূপে কর্ম ও চরিত্রে শ্রেষ্ঠতর হয় এবং কিরূপে নিকৃষ্টতর হয় -তার ব্যাখা দিয়েছেন মহান স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা নিজে। তাঁর পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গে বয়ান এসেছে:

وَنَفْسٍۢ وَمَا سَوَّىٰهَا ٧

فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَىٰهَا

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩

وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا

 

অর্থ: ‍“এবং শপথ সেই নফসের এবং যিনি তা সুসম ভাবে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে জানিয়ে  দিয়েছেন মন্দকাজ ও তাকওয়ার বিষয়ে। নিশ্চয়ই সেই সফল হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো। এবং সেই ব্যর্থ হলো যে নিজেকে কলুষিত করলো।’ –(সুরা আশ শামস, আয়াত ৭-১০)।

উপরিউক্ত আয়াতগুলি হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এই আয়াতগুলি নাযিল করার আগে এ সুরার পূর্ববর্তী আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহ তায়ালা সাত বার কসম খেয়েছেন। এরূপ কসম খেয়ে তিনি যখন কোন আয়াত নাযিল করেন, বুঝতে হবে তার গুরুত্ব অপরিসীম। সেগুলি চেতনায় সর্বক্ষণ ধারণ করার বিষয়। এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই জীবনে সফল হতে চায়। এবং বাঁচতে চায় ব্যর্থতা থেকে। এর চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা মানব জীবনে থাকতে পারেনা। এখানে ভুল হলে এ জীবন পুরাটাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। উপরের আয়াত থেকে বুঝা যায় মহান আল্লাহ তায়ালার মানুষকে শুধু হাত-পা, হৃৎপিণ্ড, মগজ, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে সৃষ্টি করেননি, প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরের গভীরে বসিয়ে দিয়েছেন সত্য-অসত্য ও ন্যায়-অন্যায় যাচায়ের জ্ঞান। সেটিই হলো মহান রব’য়ের পক্ষ থেকে ইলহাম। তাই ইলহাম শুধু নবী-রাসূলদের কাছেই আসে না, বরং ঘোষণা না দিয়ে মনের অজান্তেই ইলহাম আসে প্রতিটি মানুষের কাছে। সে কথার ঘোষণা এসেছে উপরিউক্ত আয়াতে।

একই রূপ বয়ান এসেছে সুরা লাইলে। প্রতিটি ব্যক্তিকে পথ নির্দেশনার লক্ষ্যে মহান আল্লাহ তায়ালার নিজ দায়িত্বের কথা ঘোষিত হয়েছে নীচের আয়াতে:

إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَىٰ

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমার উপর দায়িত্ব মানুষকে পথ দেখানো।”-(সুরা লাইল, আয়াত ১২) ।

মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সত্য পথ দেখানোর লক্ষ্যে যেমন নবী-রাসূল ও কিতাব নাযিল করেছেন, তেমনি ব্যক্তির হৃদয়ে সরাসরি ইলহামও দিয়ে থাকেন। ফলে বিচ্ছিন্ন জনপদে, গুহায় বা পণ্য কুঠিরে বসেও একজন মানুষ জানতে পারে চুরি করা, মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, ধর্ষণ করা বা কাউকে খুন করা অপরাধ। এবং জানতে পারে নেক কর্ম হলো অনাথকে সাহায্য করা, ক্ষুদার্তকে খাদ্য দেয়া, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়া। এজন্য তাকে কোন নবী বা রাসূলের উম্মত হওয়া লাগেনা। সত্যকে আবিস্কার করা কোন রকেট সায়েন্স ও জটিল বিজ্ঞানের বিষয় নয়। একজন নিরক্ষর মানুষও সেটি বুঝে -যদি তার বিবেক ও স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান সঠিক ভাবে কাজ করে। নবী-রাসূলের সান্নিধ্যে না এসেও একজন মানুষ নিজের সামর্থ্যেই জানতে পারে কোনটি ন্যায় ও সত্য এবং কোনটি অন্যায় ও মিথ্যা। পশুর সে সামর্থ্য থাকেনা। তাই পশু যেখানে ঘাস দেখে, সেখানেই মুখ দেয়, হারাম-হালাল দেখে না। তাই রোজ হাশরের বিচার দিনে তারাও বিচারের মুখে পড়বে যাদের কাছে কোন নবী বা রাসূল আসেনি। তাদের বিচার হবে সত্য ও ন্যায়ের আবিস্কারে তারা তাদের বিবেককে কতটা কাজে লাগিয়েছে। এখানে দায় এড়ানোর উপায় নাই।

বস্তুত সত্য আবিস্কারের সামর্থ্যই মানুষের সেরা সামর্থ্য। নবেল প্রাইজ পেলেও রোজ হাশরের বিচার দিনে তার কোন মূল্য নাই, যদি সে ব্যর্থ হয় সত্য আবিস্কারে। মহান আল্লাহ তায়ালা কখনোই তার বান্দার জটিল বিজ্ঞানের জ্ঞান আছে কিনা -সেটির পরীক্ষা নেন না। এ নিয়েও বিচার করেন না, হিমালয়ের শীর্ষে উঠার সামর্থ্য আছে কিনা। বরং পরীক্ষা নেন, অসত্যের ভিড় থেকে পরম সত্যকে আবিস্কারের সামর্থ্য তথা মহান আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব বা আয়াত টের পাওয়ার সামর্থ্য আছে কিনা? তিনি দেখেন, নেক আমলের নিয়ত। এবং দেখেন সে নিয়ত পূরণে তার দৈহিক বল, অর্থ, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ ছিল কিনা?

সত্য আবিস্কারের সামর্থ্যের বরকতে নবী-রাসূলের সাক্ষাৎ না পেয়েও বহু জনপদে বহু ন্যায়পরায়ন মানুষের উদ্ভব হয়েছে। সত্য আবিস্কারের সে সামর্থ্যের গুণে হযরত ইব্রাহীম (আ:) মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হয়েছেন। হযরত লুকমান নবী ছিলেন কিনা -সে প্রমাণ নাই; কিন্তু তাঁর হিকমত-পূর্ণ কথাগুলি মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র কিতাবে অন্তর্ভুক্ত করে অমর করে রেখেছেন। তেমনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে হযরত খিজির (আ:)‌য়ের কথা। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়ালা অমর করেছেন সম্রাট জুল কারনাইনের প্রজ্ঞাময় সিদ্ধান্তকে। তাই মানুষের দায়িত্ব শুধু তার নিজ দেহ ও সম্পদকে পাহারা দেয়া নয়, বরং তাকে কলুষিত হওয়া থেকে বাঁচাতে হয় মহান রব’য়ের দেয়া পথনির্দেশনার ইলহামকে। যারা একাজে ব্যর্থ হয়, তারাই ব্যর্থ হয় নিজেকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাতে।

 

ঈমান ও নেক আমল: জান্নাতে চাবি

মানুষকে জান্নাতে নেয় তার ঈমান ও নেক আমল। পবিত্র কুর’আনে যে বাক্যগুলি সবচেয়ে বেশী বার বলা হয়েছে সেগুলির মাঝে সম্ভবতঃ এ বাক্যটি অন্যতম। যেমন বলা হয়েছে:

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّـَٔاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ ٱلَّذِى كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ

অর্থ: “এবং যারা ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো, আমি অবশ্যই তাদের থেকে গুনাহগুলিকে দূর করে দিব এবং অবশ্যই পুরস্কৃত করবো এমন কিছু দিয়ে যা তাদের আমলের চেয়ে উত্তম।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ৭)।

একই রূপ বয়ান এসেছে নীচের আয়াতে:

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِى ٱلصَّـٰلِحِينَ

অর্থ: “ এবং যারা ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো, তাদেরকে অবশ্যই আমি নেক বান্দাদের মাঝে প্রবেশ করাবো।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ৯)।

সুরা আছরে বলা হয়েছে:

وَٱلْعَصْرِ ١

إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَفِى خُسْرٍ ٢

إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلصَّبْرِ ٣

অর্থ: “সময়ের কসম। নিশ্চয়ই সকল মানব ক্ষতির মধ্যে আছে। একমাত্র তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে এবং অন্যদের সত্য ও ছবরের নসিহত দিয়েছে।” –(সুরা আছর আয়াত ১-৩)।

উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তাযালা কসম খেয়ে বলেছেন, সকল মানব রয়েছে এক মহা ক্ষতির মুখোমুখী। সে ভয়ানক ক্ষতিটি জাহান্নামে আগুনে পৌঁছার। তবে তিনি বাতলিয়ে দিয়েছেন সে ক্ষতি থেকে বাঁচার পথটিও। সেটি হলো, ঈমান, নেক আমল এবং অন্যদের কাছে সত্যের বাণী পৌঁছানো এবং সে সাথে ছবরের নসিহত। অর্থাৎ শুধু বাঁচার খাতিরে বাঁচা নয়, বাঁচতে হবে ঈমান ও নেক আমলের মিশন নিয়ে। সুরা ত্বীনে বলা হয়েছে:

لَقَدْ خَلَقْنَا ٱلْإِنسَـٰنَ فِىٓ أَحْسَنِ تَقْوِيمٍۢ ٤

ثُمَّ رَدَدْنَـٰهُ أَسْفَلَ سَـٰفِلِينَ ٥

إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍۢ

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি মানবদেরকে সর্বোত্তম দৈহিক গঠনে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর ফিরিয়ে দিয়েছি সবচেয়ে হীন থেকে হীনতম রূপে। একমাত্র তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করছে। তাদের জন্য রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন পুরস্কার।” –(সুরা ত্বীন আয়াত ৪-৬)।

উপরের আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেয়া তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শেষ পরিণতির কথাও। সতর্ক করেছেন এই বলে, মানব সন্তানকে দেয়া সুন্দরতম দৈহিক কাঠামো অপেক্ষা করছে অতি করুণ পরিণতির জন্য -যখন সে দেহ একদিন প্রাণহীন হবে, মাটিতে মিশে যাবে এবং পুনরুত্থানের পর জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পৌঁছবে। তবে তা থেকে পরিত্রাণের রাস্তাও তিনি বাতলিয়ে দিয়েছেন। সেটি হলো ঈমান ও নেক আমল। তাই ঈমান ও নেক আমল যে জান্নাতে চাবি -সেটি আর অস্পষ্ট থাকে না।

সুরা মুলকে বলা হয়েছে:

ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَوٰةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًۭا ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفُورُ ٢

অর্থ: “তিনি সেই মহান আল্লাহ যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন; এবং সেটি এজন্য যে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করবেন, কে আমলে উত্তম। তিনিই পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।” –(সুরা মুলক, আয়াত ২)।

উপরের আয়াতে মহান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, তিনি কেন মানবের জন্ম দেন এবং কেন মৃত্যু দেন। সেটির কারণ এই যে, তিনি দেখতে চান জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে মানুষ কিরূপ আমল করে। তাই এ জীবন হলো পরীক্ষা স্থল। জান্নাতে যেতে হলে পরীক্ষার এ পর্বটি অবশ্যই পাড়ি দিতে হবে। এ পরীক্ষা এড়ানোর কোন রাস্তা নাই। যারা আমলে উত্তম, তাদের জন্য পুরস্কার হলো জান্নাত।

যারা জান্নাতে যেতে চায়, তাদের জন্য উপরিউক্ত আয়াতগুলির মধ্যে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। সেটি হলো, শুধু ঈমানে মুক্তি নাই। সাথে অবশ্যই থাকতে হবে আমলে সালেহ তথা নেক আমল। লক্ষনীয় হলো, উপরিউক্ত আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহ তায়ালা এ ঈমান ও নেক আমল -এ দুটিকে একসাথে বয়ান করেছেন। অতএব বুঝতে হবে, ঈমানের সাথে বেশি বেশি নেক আমল ছাড়া এ জীবনে অন্য কোন উদ্দেশ্য বা মিশন থাকতে পারে না। প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি কথা, প্রতিটি লেখনি, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি কর্ম ও প্রতিটি কুর’বানীকে নেক আমলে পরিণত করতে হবে। নেক আমলে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ পুরা জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাওয়া।

অতএব বুঝতে হবে, শুধু তাসবিহ-তাহলিল, কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে মুক্তি নাই। ইবাদত শুধু ইবাদতে শেষ হলে চলে না; ইবাদতগুলির মূল লক্ষ্য হতে হয় ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি এবং নেক আমলের সামর্থ্য বৃদ্ধি। ইবাদতের লক্ষ্য কি হতে হবে সেটি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে নীচের আয়াতে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعْبُدُوا۟ رَبَّكُمُ ٱلَّذِى خَلَقَكُمْ وَٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ٢١

অর্থ: “হে মানবগণ, তোমরা সেই প্রতিপালকের ইবাদত করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন -যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২১)।

অর্থাৎ ইবাদতের লক্ষ্য তাকওয়া বৃদ্ধি। প্রশ্ন হলো তাকওয়ার অর্থ কি? তাকওয়ার অর্থ, আল্লাহর ভয়। সে ভয় সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুতির। সে ভয় মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণ থেকে বিস্মৃতির। এমন ভয় থেকে সৃষ্টি হয় পাপ থেকে বাঁচা এবং বেশী বেশী নেক আমলের সার্বক্ষণিক তাড়না। এখানে কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করা ও তাঁর থেকে মাগফিরাত লাভের তাড়না। তাকওয়া সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলে বুঝতে হবে ইবাদত ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশে নামাজী ও রোজাদারদের সংখ্যাটি বিশাল। কিন্তু তাদের সে ইবাদতে কতটুকু বাড়ছে তাদের ঈমান ও তাকাওয়া? এবং কতটুকু বাড়ছে তাদের নেক আমলের সামর্থ্য‍? যারা নামাজ-রোজা পালন করেও ঘুষখায়,সূদ খায়, প্রতারণা করে, মিথ্যা বলে এবং ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতি করে, তাদের পথটি তো অকল্যাণের।  এগুলিতে নেক আমল বলে কিছু নাই।

 

সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল: জাহান্নামের আগুন থকে বাঁচানো ও জান্নাতে নেয়া

নেক আমল হাজারো রকমের। পথের কাঁটা বা আবর্জনা সরানোও নেক আমল। অর্থ দান, বস্ত্র দান, খাদ্য দান, গৃহ দান, সড়ক নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ -এসবই নেক আমল। তবে সবচেয়ে বড় নেক আমল হলো মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো এবং জান্নাতের পথ দেখানো। সেটিই মহান রাব্বুল আলামিনের প্রধানএজেন্ডা। সে লক্ষ্য পূরণে তিনি লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং অনেকগুলি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। একমাত্র হযরত দাউদ (আ:) ও হযরত সুলাইমান (আ:) ছাড়া নবী-রাসূলগণ দরিদ্র ছিলেন। তাদের হাতে কোন অর্থ দান, খাদ্য দান, বস্ত্র দান, গৃহ নির্মাণ ও সড়ক নির্মাণ প্রকল্প ছিলনা। তাদের লক্ষ্য কোন শিল্প বিপ্লব বা কৃষি বিপ্লব ঘটানো ছিল না। নেক আমলে মহান আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব সূন্নত হলো, এমন জ্ঞান দান করা -যা জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায় এবং জান্নাতের পথ দেখায়। একমাত্র কুর’আনের জ্ঞান মানুষের চেতনায় বিপ্লব আনে এবং অন্ধকারের মাঝে আলোকিত পথ দেখায়। নবী-রাসূলগণ আল্লাহ তায়ালার সে সূন্নত নিয়ে কাজ করেছেন।

 

ইসলামী রাষ্ট্র: সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার

তবে সবচেয়ে বড় নেক আমলের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো ইসলামী রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্রের হাতে থাকে শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া,পুলিশ, প্রশাসন, প্রকাশনা, আদালতসহ জনগণের চেতনাকে প্রভাবিত করার নানারূপ শক্তিশালী হাতিয়ার। লক্ষ লক্ষ মসজিদ ও হাজার হাজার মাদ্রাসা নির্মাণ করে রাষ্ট্রের সমতুল্য কাজ করা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ হলো পৃথিবী সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল। এবং সে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিটি প্রচেষ্টাই হলো জিহাদ। এবং সে জিহাদে কেউ নিহত হলে সে শহীদ হয়। তখন সমগ্র রাষ্ট্র, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলির বিশাল জনশক্তি একত্রে কাজ করে জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে ও জান্নাতে নিতে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করে সর্বশেষ্ঠ নেক আমলটি করেছেন মহান নবীজী (সা:)। এবং সর্ব নিকৃষ্ট অপরাধ কর্ম হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করা। একাজ কাফির ও মুনাফিকদের; কখনো সে কাজটি কোন ঈমানদারের হতে পারে না।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমগণ নেক আমলে মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সূন্নত পালন করে না। তারা কিছু অর্থ দান, কিছু বস্তু দান এবং বড় জোর কিছু গরু-ছাগল জবাই করে গোশতো খাইয়ে দিয়ে ভাবে, বিশাল নেক আমল হয়ে গেছে। তারা জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কাজে নাই। তারা জ্ঞানের বিতরণে নাই। এমন কি জ্ঞানসমৃদ্ধ যে সব বই পবিত্র কুর’আনের বাণী প্রচার করে -সে ধরণের বই দানের কাজটিও তারা করে না। অথচ এ ধরনের বই দানের সওয়াব কোটি টাকা দানের চেয়েও অধিক। কারণ, কোটি টাকা করলেও সে অর্থ জান্নাতের পথ দেখায় না, কিন্ত সে কাজটি ইসলামী জ্ঞানসমৃদ্ধ বই করে। অর্থ বরং পাপের পথেও ধাবিত করতে পারে। মুসলিমগণ তখনই বিজয়ী হয়েছে ও ইজ্জত পেয়েছে যখন জ্ঞান দান তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। তখন প্রিন্টিং প্রেস ছিল না। হাতে লিখে বই প্রকাশ করা হতো এবং বিতরণ করা হতো। পবিত্র কুর’আনের পূর্বে আরবী ভাষাতে কোন বই ছিল না। কিন্তু জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানদান সেদিন এতোই গুরুত্ব পেয়েছিল যে, অল্প দিনের মাঝে আরবী ভাষাকে তারা বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত করেছিল। সে আমলে তাদেরকেই সবচেয়ে বেশী সম্ভ্রান্ত ও সবচেয়ে সম্মানিত মনে করা হতো, যাদের ঘরে বেশী বেশী বই থাকতো। মুসলিমদের আদৌ কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নাই -যতক্ষণ না তারা নেক আমলে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সূন্নত অনুসরণ করে। অর্থাৎ জ্ঞানদানকে গুরুত্ব দেয়। কিছু রাস্তাঘাট, কিছু ব্রিজ, কিছু কলকারখানা ও প্রাসাদসম কিছু গৃহ নির্মাণ করে পার্থিব জীবনের জৌলুস বাড়ানো যায়, কিন্তু সেটি জান্নাতের পথ নয়।

মানবের ঈমান ও বেঈমানী গোপন থাকার বিষয় নয়, দিনের আলোর ন্যায় তা স্পষ্ট দেখা যায়। ঈমানদারী ও বেঈমানী দৃশ্যমান হয় তার কর্ম, চরিত্র এবং উপাস্যদের দিকে নজর দিলে। যে ব্যক্তি মূর্তি ও গরুকে ভগবান বলে, বুঝতে হবে সে একজন বিশুদ্ধ বেঈমান ও কাফের। তেমনি যে ব্যক্তি হাসিনার ন্যায় একজন দুর্বৃত্ত ভোটডাকাতকে শ্রদ্ধেয়া ও মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী বলে, বুঝতে হবে সে কখনোই সভ্য ও ঈমানদার হতে পারে না; সে অসভ্য ও বেঈমান। সে ব্যক্তিও কি কম বেঈমান, যে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, বাকশালী ফ্যাসিস্ট, বিচার বহির্ভুত হত্যার নায়ক, ইসলামের শত্রু ও ভারতের চরকে বঙ্গ বন্ধু, নেতা ও জাতির পিতার আসনে বসায়? তখন বোঝা যায়, এমন ব্যক্তি সভ্য ও বিবেকবান মানুষ হতেই ব্যর্থ হয়েছে। অতীতে এ জাতের অসভ্যরাই দুর্বৃত্ত ফিরাউনকে খোদা বলেছে। এ ব্যর্থতার কঠিন শাস্তি যেমন দুনিয়াতে আছে, তেমনি আখেরাতেও আছে। এরূপ বেঈমান ও অসভ্য মানুষেরা আসলে জাহান্নামের বাসিন্দা, দুনিয়ায় বসবাস কালে তারা এ দুনিয়াটাকেও জাহান্নাম বানাতে চায়। এরাই জনগণের দুশমন। বাংলাদেশে এরাই গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি ও সন্ত্রাসের জোয়ার এনেছে এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে আয়না ঘর, ক্রস ফায়ার, গণহত্যা ও ফাঁসির রাজনীতি। ইসলাম এমন অপরাধীদের নির্মূল করতে বলে। আল্লাহ তায়ালার খলিফা রূপে সেটিই হলো প্রতিটি মুসলিমের উপর অর্পিত প্রধানতম দায়ভার।

 

নেক আমলের কুর’আনী নির্দেশনা

মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক). আ’মিরু বিল মারুফ। অর্থ: ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। দুই). নেহী আনিল মুনকার। অর্থ: অন্যায়ের তথা দুর্বৃত্তির নির্মূল। দুটি কাজই পবিত্র জিহাদ। ভূমিতে ফসল ফলাতে হলে প্রথমে বীজ ছিটালে চলে না; প্রথমে জমিতে চাষ দিতে হয় এবং আগাছা নির্মূল করতে হয়। তেমনি সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি একমাত্র তখনই সফল হয় যখন অসভ্যদের নির্মূলের কাজটিই সুষ্ঠ ও পূর্ণ ভাবে সাধিত হয়। দুর্বৃত্ত নির্মূলের কাজটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। যেদেশের জনগণের অনাগ্রহ এ পবিত্র ইবাদতে, তারা ব্যর্থ হয় সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণে। বাংলাদেশ হলো তারই উদাহরণ। বাংলাদেশের ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে এতোই বিশাল যে, বর্তমান শতাব্দীদের শুরুতে দেশটি সুনীতির বদলে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। এ কদর্যতা বড়ই অপমানের। প্রশ্ন হলো, অতি অপমানকর এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে ক’জন বাংলাদেশী চিন্তিত? কতটা চিন্তিত দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী ও আলেমগণ?  সুঠাম দেহের সুস্থ মানুষ হঠাৎ অসুস্থতায় শয্যাশালী হলে সে দুশ্চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্ত যে ব্যক্তিটি বছরের পর বছর অসুস্থ ও শয্যাশায়ী, তার সে ভাবনা থাকে না। বাংলাদেশের অবস্থা এরূপ অসুস্থ মানুষের ন্যায়।

অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে মানুষ খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস বা চুরিডাকাতির জন্য নয়। বরং সুস্থ বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞান  নিয়ে জীবন চালনায় ব্যর্থ হওয়াতে। তারা জালেম শাসকের সহযোগী হয়। এমন মানুষেরা পশুর চেয়েও ভয়ংকর ও নিকৃষ্টতর হয়। সে কথাটি বলা হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। এদের নিয়ে পবিত্র কুর’আনে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব ভাষ্যটি হলো: “উলায়িকা কা’আল আনয়াম, বাল’হুম আদাল।” অর্থ: তারাই হলো গবাদী পশুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। এ জন্যই সবচেয়ে জনহিতকর কাজটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কলকারখানা গড়া নয়, বরং সেটি হলো অসভ্য ও ইতর মানুষদেরকে মানুষ বানানো। সেটি মানুষের মাঝে বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে। একমাত্র তখনই মানব সন্তানেরা ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হয়। পবিত্র কুর’আন ও হাদীসও মূলত সে কাজটিই করতে বলে। এবং সেটিই হলো মহান নবীজী (সা:)’র জীবনের সূন্নত।

মহান আল্লাহ তায়ালা জটিল বিজ্ঞান শেখানোর জন্য পবিত্র কুর’আন নাজিল করেননি। সর্বশ্রেষ্ঠ এ কিতবটি নাজিল করেছেন মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার মূল কাজটি করার জন্য। বিবেক জেগে উঠলে মানুষ তখন মানবতা নিয়ে বেড়ে উঠতে শেখে। অপর দিকে শয়তানের কাজ হলো, বিবেককে হত্যা করা। বিবেক মারা যাওযাতে মানুষ তখন নিচে নামতে শুরু করে এবং নিজেকে তখন সে জাহান্নামের যোগ্য করে গড়ে তোলে। বিবেক হত্যার সে কাজটি পুরাপুরি হলে তাদের কাছে সাপ, শকুন, গরু, পুরুষের লিঙ্গ ও মূর্তিও পূজনীয় হয়ে উঠে। বিজ্ঞানী, আবিস্কারক, সামরিক জেনারেল বা কবি-সাহিত্যিক হতে সেরূপ সুস্থ বিবেক লাগে না, এমন কি বহু পৌত্তলিক নাস্তিক এবং দুর্বৃত্তও সে কাজে সফল হয় । ভারত বা পাশ্চাত্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে এদের সংখ্যা বিশাল। পেশাদারি প্রশিক্ষণ সে মানুষকে হিংস্র পশুর ন্যায় শিকারী জীবে পরিণত হয। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র তখন গণহত্যার হাতিয়ারে পরিণত হয়। অতীতে ঔপনিবেশিক শাসন, বর্ণবাদী নির্মূল, বিশ্বযুদ্ধ এবং অধুনা গাজাতে গণহত্যার কারণ তো এই গুরুতর অসুস্থ বিবেকের মানুষ।

বিবেক হত্যা তথা মানবতা হ্ত্যার কাজে শয়তান ও তার অনুসারীরা বিশাল বিজয় পেয়েছিল বাংলাদেশে। বিবেক হত্যার কাজটি যে কতটা সফল ভাবে হয়েছিল সেটি বুঝা যায়, যখন কোটি কোটি মানুষের কাছে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদী ভারতের একান্ত সেবাদাস, নৃশংস ইসলামবিরোধী এক দুর্বৃত্ত দেশের বন্ধু, নেতা ও পিতা রূপে গৃহিত হয়। এবং বুঝা যায় যখন শেখ হাসিনার ন্যায় একজন ভোটডাকাত এবং গুম-খুন-অপহরন ও সন্ত্রাসের সংঘটক শ্রদ্ধেয়া ও মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী রূপে গণ্য হয়। অথচ সভ্য দেশে এরূপ জঘন্য অপরাধীদের কারাগারে বন্দী রাখা হয়; মারা গেলে  নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে মুজিবের ন্যায় অপরাধীর মূর্তি গড়ে পায়ে ফুল দেয়া হয়েছে।

 

বিপ্লব বাঁচাতে আমৃত্যু বিপ্লবী হতে হয়

দুর্বৃত্ত হাসিনার শাসন বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু তার ১৬ বছরের শাসন কালে সরকারের ভিতরে যে বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ে উঠেছিল -তা নির্মূল হয়নি। গলিত আবর্জনার মাঝে মশামাছি ও বিষাক্ত কীটগুলি যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের গভীরে বিপুল সংখ্যায় আজও বেঁচে আছে দুর্বৃত্তগণ। ৫ আগস্টের পর তারা গর্তে ঢুকেছে, কিন্তু নির্মূল হয়নি। সুযোগ খুঁজছে বেরিয়ে আসার। সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণের কাজে শুধু দুর্বৃত্ত শাসককে নির্মূল করলে চলে না; নির্মূল করতে হয় ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের সকল দুর্বৃত্তদের। নইলে তারা আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়। এবং আবার জন্ম দেয় ভোটডাকাতি, আয়না ঘর, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।

বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত সরকার পতনের কাজ বহুবার হয়েছে। কিন্তু দুর্বৃত্ত শাসন বার বার ফিরে এসেছে। কারণ সরকারের গভীরে বসে থাকা দুর্বৃত্তির বীজ সরানোর কাজটি কোন বারই পূর্ণ ভাবে হয়নি। ফলে প্রতিবারই বিপ্লবের পর ভিতরে থেকে গেছে প্রতি বিপ্লবের বীজ। বিপ্লব সফল করতে হলে তাই বিপ্লবকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। বিপ্লব একটি প্রক্রিয়ার নাম। বিপ্লব বাঁচাতে হলে সে প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সত্যিকার বিপ্লবীকে তাই আমৃত্যু বিপ্লবী হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কতজন রয়েছে সে সত্যিকার বিপ্লবী? যারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তা নেমেছিল তারা প্রকৃত বিপ্লবী নয়, তারা স্বার্থান্বেষী। সেসব স্বার্থান্বেষীরা হাসিনার বিদায় ও কোটা বিলুপ্তির পর ঘুমিয়ে পড়বে বা বিদায় নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃত বিপ্লবী তো তারাই যারা রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তির পুরা অবকাঠামোকে আমূল পাল্টাতে বদ্ধপরিকর। সেরূপ আমূল পাল্টানোর কাজকে আরবীতে বলে ইনকিলাব। প্রকৃত বিপ্লবীদের মধ্যে দর্শন কাজ করে, স্বার্থপরতা নয়। এবং যারা ঈমানদার তাদের সে দর্শনটি হলো পবিত্র কুর’আনের। পবিত্র কুর’আন হলো বস্তুত ইনকিলাবের টেক্সটবুক। কুর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঈমানদারগণ তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। এখানে কোন পার্থিব স্বার্থপরতা কাজ করে না। বরং কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করে সে মহান রবকে খুশি করার তাড়না। ২৬/০৭/২০২৫

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল ও সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ প্রসঙ্গ এবং বাঙালি মুসলিমের আমল নামা

Update Time : ০২:২৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 

নেক আমলের শুরু সত্যের আবিস্কার থেকে

কিছু বিকলাঙ্গ মানব ছাড়া প্রায় প্রতিটি মানব সন্তানকে মহান আল্লাহ তায়ালা বিস্ময়কর সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। চরিত্র ও কর্মের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে সে যেমন ফেরেশতার চেয়েও উত্তম হতে পারে, তেমনি চারিত্রিক স্খলনের কারণে পশুর চেয়েও নিকৃষ্টতর ও নৃশংসতর হতে পারে। ইতিহাস মানব চরিত্রের এরূপ উত্থান ও পতনের এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্তে ভরপুর। নবীজী (সা:)’র আমলে তাঁর সাহাবাগণ চরিত্র, কর্ম ও সততায় সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রূপে বেড়ে উঠতে পেরছিলেন। সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। কারণ সত্য আবিস্কারে এবং সে সত্য পালনে তারাই ছিলেন সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। অপরদিকে ফিরাউন, চিঙ্গিস খাঁ ও হিটলারের অনুসারী এবং আজকের মার্কিনী ও ইসরাইলীরা ইতিহাস গড়েছে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং নানারূপ নৃশংস অপরাধ কর্মে।

মানব কিরূপে কর্ম ও চরিত্রে শ্রেষ্ঠতর হয় এবং কিরূপে নিকৃষ্টতর হয় -তার ব্যাখা দিয়েছেন মহান স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা নিজে। তাঁর পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গে বয়ান এসেছে:

وَنَفْسٍۢ وَمَا سَوَّىٰهَا ٧

فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَىٰهَا

قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩

وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا

 

অর্থ: ‍“এবং শপথ সেই নফসের এবং যিনি তা সুসম ভাবে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে জানিয়ে  দিয়েছেন মন্দকাজ ও তাকওয়ার বিষয়ে। নিশ্চয়ই সেই সফল হলো যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো। এবং সেই ব্যর্থ হলো যে নিজেকে কলুষিত করলো।’ –(সুরা আশ শামস, আয়াত ৭-১০)।

উপরিউক্ত আয়াতগুলি হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এই আয়াতগুলি নাযিল করার আগে এ সুরার পূর্ববর্তী আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহ তায়ালা সাত বার কসম খেয়েছেন। এরূপ কসম খেয়ে তিনি যখন কোন আয়াত নাযিল করেন, বুঝতে হবে তার গুরুত্ব অপরিসীম। সেগুলি চেতনায় সর্বক্ষণ ধারণ করার বিষয়। এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই জীবনে সফল হতে চায়। এবং বাঁচতে চায় ব্যর্থতা থেকে। এর চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা মানব জীবনে থাকতে পারেনা। এখানে ভুল হলে এ জীবন পুরাটাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। উপরের আয়াত থেকে বুঝা যায় মহান আল্লাহ তায়ালার মানুষকে শুধু হাত-পা, হৃৎপিণ্ড, মগজ, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে সৃষ্টি করেননি, প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরের গভীরে বসিয়ে দিয়েছেন সত্য-অসত্য ও ন্যায়-অন্যায় যাচায়ের জ্ঞান। সেটিই হলো মহান রব’য়ের পক্ষ থেকে ইলহাম। তাই ইলহাম শুধু নবী-রাসূলদের কাছেই আসে না, বরং ঘোষণা না দিয়ে মনের অজান্তেই ইলহাম আসে প্রতিটি মানুষের কাছে। সে কথার ঘোষণা এসেছে উপরিউক্ত আয়াতে।

একই রূপ বয়ান এসেছে সুরা লাইলে। প্রতিটি ব্যক্তিকে পথ নির্দেশনার লক্ষ্যে মহান আল্লাহ তায়ালার নিজ দায়িত্বের কথা ঘোষিত হয়েছে নীচের আয়াতে:

إِنَّ عَلَيْنَا لَلْهُدَىٰ

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমার উপর দায়িত্ব মানুষকে পথ দেখানো।”-(সুরা লাইল, আয়াত ১২) ।

মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সত্য পথ দেখানোর লক্ষ্যে যেমন নবী-রাসূল ও কিতাব নাযিল করেছেন, তেমনি ব্যক্তির হৃদয়ে সরাসরি ইলহামও দিয়ে থাকেন। ফলে বিচ্ছিন্ন জনপদে, গুহায় বা পণ্য কুঠিরে বসেও একজন মানুষ জানতে পারে চুরি করা, মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, ধর্ষণ করা বা কাউকে খুন করা অপরাধ। এবং জানতে পারে নেক কর্ম হলো অনাথকে সাহায্য করা, ক্ষুদার্তকে খাদ্য দেয়া, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়া। এজন্য তাকে কোন নবী বা রাসূলের উম্মত হওয়া লাগেনা। সত্যকে আবিস্কার করা কোন রকেট সায়েন্স ও জটিল বিজ্ঞানের বিষয় নয়। একজন নিরক্ষর মানুষও সেটি বুঝে -যদি তার বিবেক ও স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান সঠিক ভাবে কাজ করে। নবী-রাসূলের সান্নিধ্যে না এসেও একজন মানুষ নিজের সামর্থ্যেই জানতে পারে কোনটি ন্যায় ও সত্য এবং কোনটি অন্যায় ও মিথ্যা। পশুর সে সামর্থ্য থাকেনা। তাই পশু যেখানে ঘাস দেখে, সেখানেই মুখ দেয়, হারাম-হালাল দেখে না। তাই রোজ হাশরের বিচার দিনে তারাও বিচারের মুখে পড়বে যাদের কাছে কোন নবী বা রাসূল আসেনি। তাদের বিচার হবে সত্য ও ন্যায়ের আবিস্কারে তারা তাদের বিবেককে কতটা কাজে লাগিয়েছে। এখানে দায় এড়ানোর উপায় নাই।

বস্তুত সত্য আবিস্কারের সামর্থ্যই মানুষের সেরা সামর্থ্য। নবেল প্রাইজ পেলেও রোজ হাশরের বিচার দিনে তার কোন মূল্য নাই, যদি সে ব্যর্থ হয় সত্য আবিস্কারে। মহান আল্লাহ তায়ালা কখনোই তার বান্দার জটিল বিজ্ঞানের জ্ঞান আছে কিনা -সেটির পরীক্ষা নেন না। এ নিয়েও বিচার করেন না, হিমালয়ের শীর্ষে উঠার সামর্থ্য আছে কিনা। বরং পরীক্ষা নেন, অসত্যের ভিড় থেকে পরম সত্যকে আবিস্কারের সামর্থ্য তথা মহান আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব বা আয়াত টের পাওয়ার সামর্থ্য আছে কিনা? তিনি দেখেন, নেক আমলের নিয়ত। এবং দেখেন সে নিয়ত পূরণে তার দৈহিক বল, অর্থ, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ ছিল কিনা?

সত্য আবিস্কারের সামর্থ্যের বরকতে নবী-রাসূলের সাক্ষাৎ না পেয়েও বহু জনপদে বহু ন্যায়পরায়ন মানুষের উদ্ভব হয়েছে। সত্য আবিস্কারের সে সামর্থ্যের গুণে হযরত ইব্রাহীম (আ:) মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানবে পরিণত হয়েছেন। হযরত লুকমান নবী ছিলেন কিনা -সে প্রমাণ নাই; কিন্তু তাঁর হিকমত-পূর্ণ কথাগুলি মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র কিতাবে অন্তর্ভুক্ত করে অমর করে রেখেছেন। তেমনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে হযরত খিজির (আ:)‌য়ের কথা। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়ালা অমর করেছেন সম্রাট জুল কারনাইনের প্রজ্ঞাময় সিদ্ধান্তকে। তাই মানুষের দায়িত্ব শুধু তার নিজ দেহ ও সম্পদকে পাহারা দেয়া নয়, বরং তাকে কলুষিত হওয়া থেকে বাঁচাতে হয় মহান রব’য়ের দেয়া পথনির্দেশনার ইলহামকে। যারা একাজে ব্যর্থ হয়, তারাই ব্যর্থ হয় নিজেকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাতে।

 

ঈমান ও নেক আমল: জান্নাতে চাবি

মানুষকে জান্নাতে নেয় তার ঈমান ও নেক আমল। পবিত্র কুর’আনে যে বাক্যগুলি সবচেয়ে বেশী বার বলা হয়েছে সেগুলির মাঝে সম্ভবতঃ এ বাক্যটি অন্যতম। যেমন বলা হয়েছে:

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّـَٔاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ ٱلَّذِى كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ

অর্থ: “এবং যারা ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো, আমি অবশ্যই তাদের থেকে গুনাহগুলিকে দূর করে দিব এবং অবশ্যই পুরস্কৃত করবো এমন কিছু দিয়ে যা তাদের আমলের চেয়ে উত্তম।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ৭)।

একই রূপ বয়ান এসেছে নীচের আয়াতে:

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِى ٱلصَّـٰلِحِينَ

অর্থ: “ এবং যারা ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো, তাদেরকে অবশ্যই আমি নেক বান্দাদের মাঝে প্রবেশ করাবো।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ৯)।

সুরা আছরে বলা হয়েছে:

وَٱلْعَصْرِ ١

إِنَّ ٱلْإِنسَـٰنَ لَفِى خُسْرٍ ٢

إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلْحَقِّ وَتَوَاصَوْا۟ بِٱلصَّبْرِ ٣

অর্থ: “সময়ের কসম। নিশ্চয়ই সকল মানব ক্ষতির মধ্যে আছে। একমাত্র তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে এবং অন্যদের সত্য ও ছবরের নসিহত দিয়েছে।” –(সুরা আছর আয়াত ১-৩)।

উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তাযালা কসম খেয়ে বলেছেন, সকল মানব রয়েছে এক মহা ক্ষতির মুখোমুখী। সে ভয়ানক ক্ষতিটি জাহান্নামে আগুনে পৌঁছার। তবে তিনি বাতলিয়ে দিয়েছেন সে ক্ষতি থেকে বাঁচার পথটিও। সেটি হলো, ঈমান, নেক আমল এবং অন্যদের কাছে সত্যের বাণী পৌঁছানো এবং সে সাথে ছবরের নসিহত। অর্থাৎ শুধু বাঁচার খাতিরে বাঁচা নয়, বাঁচতে হবে ঈমান ও নেক আমলের মিশন নিয়ে। সুরা ত্বীনে বলা হয়েছে:

لَقَدْ خَلَقْنَا ٱلْإِنسَـٰنَ فِىٓ أَحْسَنِ تَقْوِيمٍۢ ٤

ثُمَّ رَدَدْنَـٰهُ أَسْفَلَ سَـٰفِلِينَ ٥

إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍۢ

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি মানবদেরকে সর্বোত্তম দৈহিক গঠনে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর ফিরিয়ে দিয়েছি সবচেয়ে হীন থেকে হীনতম রূপে। একমাত্র তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করছে। তাদের জন্য রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন পুরস্কার।” –(সুরা ত্বীন আয়াত ৪-৬)।

উপরের আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেয়া তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শেষ পরিণতির কথাও। সতর্ক করেছেন এই বলে, মানব সন্তানকে দেয়া সুন্দরতম দৈহিক কাঠামো অপেক্ষা করছে অতি করুণ পরিণতির জন্য -যখন সে দেহ একদিন প্রাণহীন হবে, মাটিতে মিশে যাবে এবং পুনরুত্থানের পর জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পৌঁছবে। তবে তা থেকে পরিত্রাণের রাস্তাও তিনি বাতলিয়ে দিয়েছেন। সেটি হলো ঈমান ও নেক আমল। তাই ঈমান ও নেক আমল যে জান্নাতে চাবি -সেটি আর অস্পষ্ট থাকে না।

সুরা মুলকে বলা হয়েছে:

ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَوٰةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًۭا ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفُورُ ٢

অর্থ: “তিনি সেই মহান আল্লাহ যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন; এবং সেটি এজন্য যে তিনি তোমাদের পরীক্ষা করবেন, কে আমলে উত্তম। তিনিই পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।” –(সুরা মুলক, আয়াত ২)।

উপরের আয়াতে মহান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, তিনি কেন মানবের জন্ম দেন এবং কেন মৃত্যু দেন। সেটির কারণ এই যে, তিনি দেখতে চান জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে মানুষ কিরূপ আমল করে। তাই এ জীবন হলো পরীক্ষা স্থল। জান্নাতে যেতে হলে পরীক্ষার এ পর্বটি অবশ্যই পাড়ি দিতে হবে। এ পরীক্ষা এড়ানোর কোন রাস্তা নাই। যারা আমলে উত্তম, তাদের জন্য পুরস্কার হলো জান্নাত।

যারা জান্নাতে যেতে চায়, তাদের জন্য উপরিউক্ত আয়াতগুলির মধ্যে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। সেটি হলো, শুধু ঈমানে মুক্তি নাই। সাথে অবশ্যই থাকতে হবে আমলে সালেহ তথা নেক আমল। লক্ষনীয় হলো, উপরিউক্ত আয়াতগুলিতে মহান আল্লাহ তায়ালা এ ঈমান ও নেক আমল -এ দুটিকে একসাথে বয়ান করেছেন। অতএব বুঝতে হবে, ঈমানের সাথে বেশি বেশি নেক আমল ছাড়া এ জীবনে অন্য কোন উদ্দেশ্য বা মিশন থাকতে পারে না। প্রতিটি ভাবনা, প্রতিটি কথা, প্রতিটি লেখনি, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি কর্ম ও প্রতিটি কুর’বানীকে নেক আমলে পরিণত করতে হবে। নেক আমলে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ পুরা জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাওয়া।

অতএব বুঝতে হবে, শুধু তাসবিহ-তাহলিল, কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে মুক্তি নাই। ইবাদত শুধু ইবাদতে শেষ হলে চলে না; ইবাদতগুলির মূল লক্ষ্য হতে হয় ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি এবং নেক আমলের সামর্থ্য বৃদ্ধি। ইবাদতের লক্ষ্য কি হতে হবে সেটি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে নীচের আয়াতে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعْبُدُوا۟ رَبَّكُمُ ٱلَّذِى خَلَقَكُمْ وَٱلَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ٢١

অর্থ: “হে মানবগণ, তোমরা সেই প্রতিপালকের ইবাদত করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন -যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২১)।

অর্থাৎ ইবাদতের লক্ষ্য তাকওয়া বৃদ্ধি। প্রশ্ন হলো তাকওয়ার অর্থ কি? তাকওয়ার অর্থ, আল্লাহর ভয়। সে ভয় সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুতির। সে ভয় মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণ থেকে বিস্মৃতির। এমন ভয় থেকে সৃষ্টি হয় পাপ থেকে বাঁচা এবং বেশী বেশী নেক আমলের সার্বক্ষণিক তাড়না। এখানে কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করা ও তাঁর থেকে মাগফিরাত লাভের তাড়না। তাকওয়া সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলে বুঝতে হবে ইবাদত ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশে নামাজী ও রোজাদারদের সংখ্যাটি বিশাল। কিন্তু তাদের সে ইবাদতে কতটুকু বাড়ছে তাদের ঈমান ও তাকাওয়া? এবং কতটুকু বাড়ছে তাদের নেক আমলের সামর্থ্য‍? যারা নামাজ-রোজা পালন করেও ঘুষখায়,সূদ খায়, প্রতারণা করে, মিথ্যা বলে এবং ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতি করে, তাদের পথটি তো অকল্যাণের।  এগুলিতে নেক আমল বলে কিছু নাই।

 

সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল: জাহান্নামের আগুন থকে বাঁচানো ও জান্নাতে নেয়া

নেক আমল হাজারো রকমের। পথের কাঁটা বা আবর্জনা সরানোও নেক আমল। অর্থ দান, বস্ত্র দান, খাদ্য দান, গৃহ দান, সড়ক নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ -এসবই নেক আমল। তবে সবচেয়ে বড় নেক আমল হলো মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো এবং জান্নাতের পথ দেখানো। সেটিই মহান রাব্বুল আলামিনের প্রধানএজেন্ডা। সে লক্ষ্য পূরণে তিনি লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং অনেকগুলি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। একমাত্র হযরত দাউদ (আ:) ও হযরত সুলাইমান (আ:) ছাড়া নবী-রাসূলগণ দরিদ্র ছিলেন। তাদের হাতে কোন অর্থ দান, খাদ্য দান, বস্ত্র দান, গৃহ নির্মাণ ও সড়ক নির্মাণ প্রকল্প ছিলনা। তাদের লক্ষ্য কোন শিল্প বিপ্লব বা কৃষি বিপ্লব ঘটানো ছিল না। নেক আমলে মহান আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব সূন্নত হলো, এমন জ্ঞান দান করা -যা জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায় এবং জান্নাতের পথ দেখায়। একমাত্র কুর’আনের জ্ঞান মানুষের চেতনায় বিপ্লব আনে এবং অন্ধকারের মাঝে আলোকিত পথ দেখায়। নবী-রাসূলগণ আল্লাহ তায়ালার সে সূন্নত নিয়ে কাজ করেছেন।

 

ইসলামী রাষ্ট্র: সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমলের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার

তবে সবচেয়ে বড় নেক আমলের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো ইসলামী রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্রের হাতে থাকে শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়া,পুলিশ, প্রশাসন, প্রকাশনা, আদালতসহ জনগণের চেতনাকে প্রভাবিত করার নানারূপ শক্তিশালী হাতিয়ার। লক্ষ লক্ষ মসজিদ ও হাজার হাজার মাদ্রাসা নির্মাণ করে রাষ্ট্রের সমতুল্য কাজ করা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ হলো পৃথিবী সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল। এবং সে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিটি প্রচেষ্টাই হলো জিহাদ। এবং সে জিহাদে কেউ নিহত হলে সে শহীদ হয়। তখন সমগ্র রাষ্ট্র, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলির বিশাল জনশক্তি একত্রে কাজ করে জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে ও জান্নাতে নিতে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ করে সর্বশেষ্ঠ নেক আমলটি করেছেন মহান নবীজী (সা:)। এবং সর্ব নিকৃষ্ট অপরাধ কর্ম হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করা। একাজ কাফির ও মুনাফিকদের; কখনো সে কাজটি কোন ঈমানদারের হতে পারে না।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমগণ নেক আমলে মহান আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সূন্নত পালন করে না। তারা কিছু অর্থ দান, কিছু বস্তু দান এবং বড় জোর কিছু গরু-ছাগল জবাই করে গোশতো খাইয়ে দিয়ে ভাবে, বিশাল নেক আমল হয়ে গেছে। তারা জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর কাজে নাই। তারা জ্ঞানের বিতরণে নাই। এমন কি জ্ঞানসমৃদ্ধ যে সব বই পবিত্র কুর’আনের বাণী প্রচার করে -সে ধরণের বই দানের কাজটিও তারা করে না। অথচ এ ধরনের বই দানের সওয়াব কোটি টাকা দানের চেয়েও অধিক। কারণ, কোটি টাকা করলেও সে অর্থ জান্নাতের পথ দেখায় না, কিন্ত সে কাজটি ইসলামী জ্ঞানসমৃদ্ধ বই করে। অর্থ বরং পাপের পথেও ধাবিত করতে পারে। মুসলিমগণ তখনই বিজয়ী হয়েছে ও ইজ্জত পেয়েছে যখন জ্ঞান দান তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। তখন প্রিন্টিং প্রেস ছিল না। হাতে লিখে বই প্রকাশ করা হতো এবং বিতরণ করা হতো। পবিত্র কুর’আনের পূর্বে আরবী ভাষাতে কোন বই ছিল না। কিন্তু জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানদান সেদিন এতোই গুরুত্ব পেয়েছিল যে, অল্প দিনের মাঝে আরবী ভাষাকে তারা বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত করেছিল। সে আমলে তাদেরকেই সবচেয়ে বেশী সম্ভ্রান্ত ও সবচেয়ে সম্মানিত মনে করা হতো, যাদের ঘরে বেশী বেশী বই থাকতো। মুসলিমদের আদৌ কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নাই -যতক্ষণ না তারা নেক আমলে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সূন্নত অনুসরণ করে। অর্থাৎ জ্ঞানদানকে গুরুত্ব দেয়। কিছু রাস্তাঘাট, কিছু ব্রিজ, কিছু কলকারখানা ও প্রাসাদসম কিছু গৃহ নির্মাণ করে পার্থিব জীবনের জৌলুস বাড়ানো যায়, কিন্তু সেটি জান্নাতের পথ নয়।

মানবের ঈমান ও বেঈমানী গোপন থাকার বিষয় নয়, দিনের আলোর ন্যায় তা স্পষ্ট দেখা যায়। ঈমানদারী ও বেঈমানী দৃশ্যমান হয় তার কর্ম, চরিত্র এবং উপাস্যদের দিকে নজর দিলে। যে ব্যক্তি মূর্তি ও গরুকে ভগবান বলে, বুঝতে হবে সে একজন বিশুদ্ধ বেঈমান ও কাফের। তেমনি যে ব্যক্তি হাসিনার ন্যায় একজন দুর্বৃত্ত ভোটডাকাতকে শ্রদ্ধেয়া ও মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী বলে, বুঝতে হবে সে কখনোই সভ্য ও ঈমানদার হতে পারে না; সে অসভ্য ও বেঈমান। সে ব্যক্তিও কি কম বেঈমান, যে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, বাকশালী ফ্যাসিস্ট, বিচার বহির্ভুত হত্যার নায়ক, ইসলামের শত্রু ও ভারতের চরকে বঙ্গ বন্ধু, নেতা ও জাতির পিতার আসনে বসায়? তখন বোঝা যায়, এমন ব্যক্তি সভ্য ও বিবেকবান মানুষ হতেই ব্যর্থ হয়েছে। অতীতে এ জাতের অসভ্যরাই দুর্বৃত্ত ফিরাউনকে খোদা বলেছে। এ ব্যর্থতার কঠিন শাস্তি যেমন দুনিয়াতে আছে, তেমনি আখেরাতেও আছে। এরূপ বেঈমান ও অসভ্য মানুষেরা আসলে জাহান্নামের বাসিন্দা, দুনিয়ায় বসবাস কালে তারা এ দুনিয়াটাকেও জাহান্নাম বানাতে চায়। এরাই জনগণের দুশমন। বাংলাদেশে এরাই গুম, খুন, ধর্ষণ, চুরিডাকাতি ও সন্ত্রাসের জোয়ার এনেছে এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছে আয়না ঘর, ক্রস ফায়ার, গণহত্যা ও ফাঁসির রাজনীতি। ইসলাম এমন অপরাধীদের নির্মূল করতে বলে। আল্লাহ তায়ালার খলিফা রূপে সেটিই হলো প্রতিটি মুসলিমের উপর অর্পিত প্রধানতম দায়ভার।

 

নেক আমলের কুর’আনী নির্দেশনা

মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক). আ’মিরু বিল মারুফ। অর্থ: ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। দুই). নেহী আনিল মুনকার। অর্থ: অন্যায়ের তথা দুর্বৃত্তির নির্মূল। দুটি কাজই পবিত্র জিহাদ। ভূমিতে ফসল ফলাতে হলে প্রথমে বীজ ছিটালে চলে না; প্রথমে জমিতে চাষ দিতে হয় এবং আগাছা নির্মূল করতে হয়। তেমনি সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি একমাত্র তখনই সফল হয় যখন অসভ্যদের নির্মূলের কাজটিই সুষ্ঠ ও পূর্ণ ভাবে সাধিত হয়। দুর্বৃত্ত নির্মূলের কাজটি পবিত্র জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। যেদেশের জনগণের অনাগ্রহ এ পবিত্র ইবাদতে, তারা ব্যর্থ হয় সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণে। বাংলাদেশ হলো তারই উদাহরণ। বাংলাদেশের ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে এতোই বিশাল যে, বর্তমান শতাব্দীদের শুরুতে দেশটি সুনীতির বদলে দুর্বৃত্তিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়েছে। এ কদর্যতা বড়ই অপমানের। প্রশ্ন হলো, অতি অপমানকর এ বিশাল ব্যর্থতা নিয়ে ক’জন বাংলাদেশী চিন্তিত? কতটা চিন্তিত দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী ও আলেমগণ?  সুঠাম দেহের সুস্থ মানুষ হঠাৎ অসুস্থতায় শয্যাশালী হলে সে দুশ্চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্ত যে ব্যক্তিটি বছরের পর বছর অসুস্থ ও শয্যাশায়ী, তার সে ভাবনা থাকে না। বাংলাদেশের অবস্থা এরূপ অসুস্থ মানুষের ন্যায়।

অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে মানুষ খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস বা চুরিডাকাতির জন্য নয়। বরং সুস্থ বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞান  নিয়ে জীবন চালনায় ব্যর্থ হওয়াতে। তারা জালেম শাসকের সহযোগী হয়। এমন মানুষেরা পশুর চেয়েও ভয়ংকর ও নিকৃষ্টতর হয়। সে কথাটি বলা হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। এদের নিয়ে পবিত্র কুর’আনে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব ভাষ্যটি হলো: “উলায়িকা কা’আল আনয়াম, বাল’হুম আদাল।” অর্থ: তারাই হলো গবাদী পশুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট। এ জন্যই সবচেয়ে জনহিতকর কাজটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কলকারখানা গড়া নয়, বরং সেটি হলো অসভ্য ও ইতর মানুষদেরকে মানুষ বানানো। সেটি মানুষের মাঝে বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে। একমাত্র তখনই মানব সন্তানেরা ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর হয়। পবিত্র কুর’আন ও হাদীসও মূলত সে কাজটিই করতে বলে। এবং সেটিই হলো মহান নবীজী (সা:)’র জীবনের সূন্নত।

মহান আল্লাহ তায়ালা জটিল বিজ্ঞান শেখানোর জন্য পবিত্র কুর’আন নাজিল করেননি। সর্বশ্রেষ্ঠ এ কিতবটি নাজিল করেছেন মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার মূল কাজটি করার জন্য। বিবেক জেগে উঠলে মানুষ তখন মানবতা নিয়ে বেড়ে উঠতে শেখে। অপর দিকে শয়তানের কাজ হলো, বিবেককে হত্যা করা। বিবেক মারা যাওযাতে মানুষ তখন নিচে নামতে শুরু করে এবং নিজেকে তখন সে জাহান্নামের যোগ্য করে গড়ে তোলে। বিবেক হত্যার সে কাজটি পুরাপুরি হলে তাদের কাছে সাপ, শকুন, গরু, পুরুষের লিঙ্গ ও মূর্তিও পূজনীয় হয়ে উঠে। বিজ্ঞানী, আবিস্কারক, সামরিক জেনারেল বা কবি-সাহিত্যিক হতে সেরূপ সুস্থ বিবেক লাগে না, এমন কি বহু পৌত্তলিক নাস্তিক এবং দুর্বৃত্তও সে কাজে সফল হয় । ভারত বা পাশ্চাত্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে এদের সংখ্যা বিশাল। পেশাদারি প্রশিক্ষণ সে মানুষকে হিংস্র পশুর ন্যায় শিকারী জীবে পরিণত হয। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র তখন গণহত্যার হাতিয়ারে পরিণত হয়। অতীতে ঔপনিবেশিক শাসন, বর্ণবাদী নির্মূল, বিশ্বযুদ্ধ এবং অধুনা গাজাতে গণহত্যার কারণ তো এই গুরুতর অসুস্থ বিবেকের মানুষ।

বিবেক হত্যা তথা মানবতা হ্ত্যার কাজে শয়তান ও তার অনুসারীরা বিশাল বিজয় পেয়েছিল বাংলাদেশে। বিবেক হত্যার কাজটি যে কতটা সফল ভাবে হয়েছিল সেটি বুঝা যায়, যখন কোটি কোটি মানুষের কাছে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের খুনি, স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদী ভারতের একান্ত সেবাদাস, নৃশংস ইসলামবিরোধী এক দুর্বৃত্ত দেশের বন্ধু, নেতা ও পিতা রূপে গৃহিত হয়। এবং বুঝা যায় যখন শেখ হাসিনার ন্যায় একজন ভোটডাকাত এবং গুম-খুন-অপহরন ও সন্ত্রাসের সংঘটক শ্রদ্ধেয়া ও মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী রূপে গণ্য হয়। অথচ সভ্য দেশে এরূপ জঘন্য অপরাধীদের কারাগারে বন্দী রাখা হয়; মারা গেলে  নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে মুজিবের ন্যায় অপরাধীর মূর্তি গড়ে পায়ে ফুল দেয়া হয়েছে।

 

বিপ্লব বাঁচাতে আমৃত্যু বিপ্লবী হতে হয়

দুর্বৃত্ত হাসিনার শাসন বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু তার ১৬ বছরের শাসন কালে সরকারের ভিতরে যে বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ে উঠেছিল -তা নির্মূল হয়নি। গলিত আবর্জনার মাঝে মশামাছি ও বিষাক্ত কীটগুলি যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের গভীরে বিপুল সংখ্যায় আজও বেঁচে আছে দুর্বৃত্তগণ। ৫ আগস্টের পর তারা গর্তে ঢুকেছে, কিন্তু নির্মূল হয়নি। সুযোগ খুঁজছে বেরিয়ে আসার। সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণের কাজে শুধু দুর্বৃত্ত শাসককে নির্মূল করলে চলে না; নির্মূল করতে হয় ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের সকল দুর্বৃত্তদের। নইলে তারা আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়। এবং আবার জন্ম দেয় ভোটডাকাতি, আয়না ঘর, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।

বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত সরকার পতনের কাজ বহুবার হয়েছে। কিন্তু দুর্বৃত্ত শাসন বার বার ফিরে এসেছে। কারণ সরকারের গভীরে বসে থাকা দুর্বৃত্তির বীজ সরানোর কাজটি কোন বারই পূর্ণ ভাবে হয়নি। ফলে প্রতিবারই বিপ্লবের পর ভিতরে থেকে গেছে প্রতি বিপ্লবের বীজ। বিপ্লব সফল করতে হলে তাই বিপ্লবকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। বিপ্লব একটি প্রক্রিয়ার নাম। বিপ্লব বাঁচাতে হলে সে প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সত্যিকার বিপ্লবীকে তাই আমৃত্যু বিপ্লবী হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কতজন রয়েছে সে সত্যিকার বিপ্লবী? যারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তা নেমেছিল তারা প্রকৃত বিপ্লবী নয়, তারা স্বার্থান্বেষী। সেসব স্বার্থান্বেষীরা হাসিনার বিদায় ও কোটা বিলুপ্তির পর ঘুমিয়ে পড়বে বা বিদায় নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃত বিপ্লবী তো তারাই যারা রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তির পুরা অবকাঠামোকে আমূল পাল্টাতে বদ্ধপরিকর। সেরূপ আমূল পাল্টানোর কাজকে আরবীতে বলে ইনকিলাব। প্রকৃত বিপ্লবীদের মধ্যে দর্শন কাজ করে, স্বার্থপরতা নয়। এবং যারা ঈমানদার তাদের সে দর্শনটি হলো পবিত্র কুর’আনের। পবিত্র কুর’আন হলো বস্তুত ইনকিলাবের টেক্সটবুক। কুর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঈমানদারগণ তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। এখানে কোন পার্থিব স্বার্থপরতা কাজ করে না। বরং কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করে সে মহান রবকে খুশি করার তাড়না। ২৬/০৭/২০২৫