০১:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

শত্রুশক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং বাঙালি মুসলিমের বিপন্ন স্বাধিনতা

Reporter Name
  • Update Time : ০৩:৩৩:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫
  • / ১৬১ Time View

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 

শত্রুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ

শত্রু পক্ষের প্রবল বিরোধীতার মুখে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলেও দেশটির শত্রু পক্ষ কোন কালেই বিলুপ্ত হয়নি। বরং ১৯৪৭ থেকেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে পাকিস্তানকে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে তারা নতুন যুদ্ধ শুরু করে। সে যুদ্ধটি শুধু রাজনৈতিক অঙ্গণে সীমিত ছিল না, বরং প্রবল ভাবে শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে। সে লক্ষ্যে গড়ে উঠে পাকিস্তান বিরোধী শক্তির বিশাল কোয়ালিশন। তাতে শামিল হয় পরাজিত বিপুল সংখ্যক কংগ্রেসী নেতাকর্মী, জমিদারী হারানো জমিদার, হিন্দুত্ববাদী শক্তি, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট এবং বাম ধারার কম্যুনিস্টগণ। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার পর পাকিস্তানপন্থীদের যেরূপ হত্যা বা কারাবন্দী করা হয় এবং তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান বিরোধীদের ক্ষেত্রে সেরূপ হয়নি। বরং মনরঞ্জন ধর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ফনিভূষন মজুমদারদের ন্যায় কংগ্রেসী নেতাগণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশগ্রহনের পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। তাদের থেকে গণপরিষদের তথা সংসদের সদস্যপদও কেড়ে নেয়া হয়নি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও তাদের চেতনার ভূমি দ্রুত অধিকৃত হতে শুরু করে পরাজিত হিন্দু ও তাদের দোসরদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাছে। কারণ, ১৯৪৭’য়ের পরও পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে প্রবল প্লাবন বইছিল কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির। পূর্ব পাকিস্তানে তখনও ছাপা খানা গড়ে উঠেনি। বই কলকাতা থেকে ছাপা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতো। পাকিস্তান সরকার সে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অরক্ষিত থেকেছে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমান্ত।

পাকিস্তান বিরোধীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জোয়ার তীব্রতর হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে। সে আন্দোলনের নেতৃত্বে আসে ইসলামের কট্টোর শত্রু কম্যুনিস্ট নাস্তিক ও কংগ্রেসী হিন্দুত্ববাদীগণ। ঢাকা সহ দেশের প্রত্যন্ত স্কুল কলেজে গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনারের নাম দিয়ে পৌত্তলিক স্তম্ভপূজার রীতি। সেটি পরিণত হয় পাকিস্তান বিরোধীদের সাংস্কৃতিক আইকনে। শুরু হয় পৌত্তলিকতার নতুন রেওয়াজ; সেটি ছিল প্রতি বছর ২১ ফেব্রেয়ারির অন্ধকার ভোর রাতে নগ্ন পদে হেটে ফুল দিয়ে স্তম্ভপূজা। এ জোয়ার মুসলিম লীগ ও দেশের আলেম সমাজ রুখতে পারিনি। তাদের রাজনৈতিক পরাজয়ের শুরু এখান থেকেই। এবং সে পরাজয় চুড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরে।

 

 

শত্রুপক্ষের রাজনৈতিক বিজয় এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প

রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে পাকিস্তান বিরোধী সেক্যুলার, বামপন্থী ও হিন্দুত্ববাদী পক্ষটির প্রতিপত্তি ও প্রভাব এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে খাজা নাজিমুদ্দীন ও নুরুল আমীনের ন্যায় যেসব মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিল এবং জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে বাঙালি মুসলিমদের জমির মালিক বানালো, তাদেরকে বাদ দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা এবং কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ও মনরঞ্জণ ধরের ন্যায় হিন্দুত্ববাদীদেরকে হিরো রূপে গ্রহণ করলো। হিরো রূপে গৃহিত হলো উগ্র হিন্দুত্ববাদী ক্ষুদি রাম ও সূর্য সেন। পাকিস্তান বিরোধীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিজয়ের ফল হলো, ১৯৫৪ সালে নির্বাচেন মুসলিম লীগের ভূমিধ্বস পরাজয়।

১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাষানীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পায় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সে দলটি পরিণত হয় কম্যুনিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসী নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের রাজনৈতিক মঞ্চে। ইসলামের প্রতি এ নতুন দলটির কোন অঙ্গীকার না থাকাতে দলের নামের  সাথে মুসলিম শব্দটি অগ্রহনযোগ্য হয়ে পড়ে; ফলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে স্রেফ আওয়ামী লীগ করা হয়। আর মুসলিম ও ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার না থাকলে পাকিস্তানের প্রতিও অঙ্গীকার থাকার কথা নয়। ফলে দলটির নেতৃত্বে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প। এ দলটি শুরু থেকেই ছিল ভারতের আশির্বাদপুষ্ট। পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলন তখন একটি মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়। কম্যুনিস্ট ঘরানার বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর যখন বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলন -তখন তিনি মিথ্যা বলেন না। বদরুদ্দীন উমর আরো বলেন, কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাজুদ্দীনকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করানো হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প নিয়ে মুজিবের চেয়েও অধিক সক্রিয় ছিল এই তাজুদ্দীন। কারণ সেটিই ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান এজেন্ডা।

তাছাড়া পাকিস্তান ছিল SEATO ও CENTO চুক্তি ভু্ক্ত মার্কিন বলয়ের একটি দেশ; ফলে সোভিয়েত রাশিয়ারও সামরিক স্ট্রাটেজি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বুকে মার্কিন শিবিরকে দুর্বল করা। সে  লক্ষ্যে সোভিয়েত রাশিয়া কোয়ালিশন গড়ে তোলে চরম পাকিস্তান বিরোধী ভারতের সাথে। বস্তুত ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মাঝে চলমান স্মায়ু যুদ্ধের অংশ রূপে। সোভিয়ের রাশিয়ার সে পাকিস্তান বিরোধী নীতির প্রবল প্রভাব দেখা যেত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের বাম রাজনীতিতে। ১৯৫৭ সালে ৬ ফেব্রেয়ারিতে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সে সম্মেলনে দলের সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাষানী পশ্চিম পাকিস্তানকে “আসসালামু আলাইকুম” জানিয়ে দেন। বস্তুত সেটিই ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রথম ঘোষণা। ভাষানী নিজেও ১৯৭১’য়ে ভারতের কোলে আশ্রয় নেন এবং প্রচুর ভারতীয় নিমক গ্রহন করেন। ১৯৭১’য়ে ভারতপন্থী দুর্বৃত্তরা যখন বিহারীদের উপর বাংলার ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালায় এবং বিহারীদের ঘরবাড়ী ও দোকান পাট কেড়ে নেয়, তখন ভাষানী সে নৃশংসতার কোন নিন্দা করেননি। তিনি সেদিন সে অসহায় মজলুমদের পাশে দাঁড়ায়নি। এমন কি সে নৃশংসতার নিন্দা করেনি তার অনুসারী বামপন্থীরাও। কারণ সেটি ছিল রাজনীতির ভারতপন্থী ও বাম ধারার প্রকল্প।

 

একাত্তরের শিক্ষনীয় বিষয়

১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া থেকে অতি শিক্ষনীয় বিষয়টি হলো, শুধু ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বাঁচে না। স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে লাগাতর যুদ্ধ চাই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও। চাই, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিজয়। সে বিজয়টি আনতে চাই, বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। বুঝতে হবে, শত্রু পক্ষের যুদ্ধটি শুধু ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গণে হয় না, বরং সে যুদ্ধ প্রতিক্ষণ চলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও। তাই দেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে শত্রুর বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রণাঙ্গণেও।

বুদ্ধিবৃত্তিক এ যুদ্ধটি অতি পবিত্র জিহাদ। পবিত্র কুর’আনের সুর ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে এমন বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধকে “জিহাদান কবিরা” তথা বড় যুদ্ধ বলা হয়েছে। এ যুদ্ধের অস্ত্র পবিত্র কুর’আন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে বিজয় রূপে। তখন রাজপথের স্লোগান ছিল, “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” এ স্লোগানের মধ্য দিয়ে কুর’আনী দর্শন কথা বলে। আর মুসলিমের রাজনীতি তো সে কুর’আনী দর্শনকে বিজয়ী করার লড়াই। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের নেতাকর্মীগণ সে দর্শনের সাথে গাদ্দারী করে। যেমন ১৯৪৭-পূর্ব আসাম মুসলিম লীগের নেতা মাওলানা ভাষানী ইসলামের পতাকা ফেলে দিয়ে চীনপন্থী লাল পতাকা নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। এবং মুসলিম লীগের কলকাতার লাঠিয়াল শেখ মুজিব হাতে তুলে নেয় বাঙালি ফ্যাসিবাদের পতাকা। এমন গাদ্দার শুধু ভাষানী ও মুজিব ছিলনা, ছিল অনেকেই।

১৯৪৭’য়ের পূর্বে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে সে সময় মুসলিম লীগের হাতে যেমন চৌকশ রাজনৈতিক যোদ্ধা ছিল, তেমনি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধাও। ছিল অনেক গুলি শক্তিশালী পত্রিকা। ছিল বহু কবি, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি আর অব্যাহত রাখা হয়নি -বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বুকে। মুসলিম লীগ তার যুদ্ধকে সীমিত করে শুধু রাজনৈতিক অঙ্গণে। এবং বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণকে বিনাযুদ্ধে বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্ট শত্রু পক্ষের হাতে ময়দান খালি ছেড়ে দেয়। মুসলিম লীগ পত্রিকা বের করতো, কিন্তু পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলি দখলে নিত বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্ট লেখক ও কলামিস্টগণ। ফলে মুসলিম লীগের পত্রিকা দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান আর মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের পক্ষে থাকেনি। সেগুলি বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্টদের দখলে চলে গেছে।

এমন কি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের বুদ্ধিজীবীগণ ব্যর্থ হয়েছেন, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা কেন অপরিহার্য ছিল -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জনগণকে বুঝাতে। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার বিপদ কি -সেটিও তারা বুঝাতে পারেননি। অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচলে যে বাঙালি মুসলিমগণ পেত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ -সে কথাটিও বাঙালি মুসলিমদের বুঝাতে পারেননি। পাকিস্তান ভাঙ্গলে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ যে অরক্ষিত হবে এবং ভারতের অধিনত এক আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হবে -সে বাস্তবতাটিও প্রবল ভাবে তুলে ধরতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে মুসলিম লীগের নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীগণ পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে একটি বইও লেখেননি। তাদের সে ব্যর্থতার কারণেই পাকিস্তানের শত্রুগণ ১৯৭১’য়ে একটি সহজ বিজয় পেয়েছে এবং তাতে বাঁচেনি অখণ্ড পাকিস্তান -যা হতে পারতো মুসলিম উম্মাহর একটি অভিভাবক রাষ্ট্র।

তবে পাকিস্তানের একাত্তরের পরাজয় এবং বিভক্তি বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখে গেছে। সেটি হলো, আগামীতে বাংলাদেশও বাঁচবে না -যদি ভারতীয় সাহায্যপুষ্ট পৌত্তলিক সংস্কৃতির জোয়ার রুখার কাজে বাঙালি মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়। এবং যদি তারা ব্যর্থ হয় সেক্যুলারিস্টদের ষড়যন্ত্র রুখতে। কারণ, এ দুটি ক্ষেত্রে শত্রুশক্তির বিনিয়োগটি বিশাল ও লাগাতর। এবং যে কোন দেশের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টানোর ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জোয়ারের সামর্থ্যটি বিশাল। সে জোয়ারই রাজনৈতিক জোয়ার সৃষ্টি করে। সে জোয়ারই ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের ভূগোল পাল্টিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পিছনেও কাজ করেছে তেমনি এক জোয়ার।  হাসিনার শাসনামলে সে জোয়ার এতটাই বেগবান হয়েছিল যে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমিন বলেছিল, “ভারতের বিজয়ই আমাদের বিজয়।” চেতনার ভূগোল যদি এতটা একাকার হয়ে যায় তখনকি দেশের ভূগোল পৃথক থাকে? ভারত তো সে পথেই এগুতে চায়।

 

স্বাধীনতার সুরক্ষা কিরূপে?

একমাত্র কুর’আনী দর্শনই শত্রুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অধিকৃতি থেকে মুসলিম ভূমিকে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশে সে অস্ত্রের প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে হচ্ছে না স্বাধীনতা বাঁচানোর কাঙ্খিত কাজটি। ফলে হাসিনার পতন হলেও বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনার ভূমি এখনো অধিকৃত রয়ে গেছে ইসলাম বিরোধী দূষিত দর্শনে। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য সেটিই হলো বিপদের মূল কারণ। বুঝতে হবে, মানব দেহের প্রতিরক্ষা দেয় যেমন দেহের ভিভরে গড়ে উঠা ইম্যুনিটি, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয় আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ইম্যুনিটি । মুসলিম সে ইম্যুনিটি পায় পবিত্র কুর’আন ও হাদীস থেকে। মুসলিম তখন শধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী হওয়া নিয়ে খুশি থাকে না, বরং প্রতিক্ষণের লড়াকু মুজাহিদে পরিণত হয়।

বুঝতে হবে স্বাধীনতা বাঁচানোর যুদ্ধটি প্রতিক্ষণের। যাদের জীবনে সে যুদ্ধ নাই, তাদের বাঁচতে হয় শত্রুর পদতলে পরাধীনতা নিয়ে। তাই মহান নবীজী (সা:) তাঁর সাহাবাদের শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী বানাননি, আমৃত্য মুজাহিদে পরিণত করেছেন। অর্ধেক সাহাবী শহীদ হয়েছেন। এবং নবীজী (সা:) নিজে ২৮টি যুদ্ধে সশরীরে অংশ নিয়েছেন। এবং নবীজী (সা:) যা কিছু করেছেন তা তো সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেকই করেছেন। আর নবীজী (সা:) যা কিছু করেছেন -সে অনুসারে চলতে হয় প্রতিটি মুসলিমকে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম জীবনে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আদর্শ নাই। তারা বাঁচছে ইসলামের মুখোশ নিয়ে, ঈমান ও আমল নিয়ে নয়। যুদ্ধ দূরে থাকে, “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” বলে ক’জন বাঙালি মুসলিম রাজপথে শরিয়ত’য়ের দাবী নিয়ে রাস্তায় নেমেছে? শতকরা একজন দূরে থাক, হাজারে একজনও কি? ব্রিটিশ আমলে মুসলিম লীগের নেতৃ্ত্বে নেমেছিল, তাই পাকিস্তান পেয়েছিল।

যারা স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার মূল্য পরিশোধ করতে পারে, একমাত্র তারাই স্বাধীনতা পায়। সেটি ইতিহাসের রীতি। সে মূল্য পরিশোধে বাঙালি মুসলিম ১৭৫৭ ও ১৯৭১’য়ে ব্যর্থ হয়েছে। তারা তখন যুদ্ধে নামেনি। আগামীতেও যে নামবে সে সম্ভাবনাই বা কতটুকু? সে ঈমানী প্রস্তুতিই বা কই? ফলে ১৭৫৭’য়ে পেয়েছে ব্রিটিশের গোলামী এবং ১৯৭১’য়ে পেয়েছে ভারত ও ভারতসেবী দুর্বৃত্তদের গোলামী। উভয় গোলামী কালেই অসম্ভব করা হয়েছে স্বাধীনতা ও পূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচা। এবং নেমে এসেছে গণহত্যা ও গণনির্যাতন। তাই স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে প্রতিটি বাঙালি মুসলিমকে স্বাধীনতা বাঁচানোর দায় নিয়ে বাঁচতে হবে। থাকতে হবে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধের তাড়না। এ ফরজ দায়িত্ব পালনে কোন কাজা নাই। ২৩/০৭/২০২৫

 

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

শত্রুশক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং বাঙালি মুসলিমের বিপন্ন স্বাধিনতা

Update Time : ০৩:৩৩:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 

 

শত্রুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ

শত্রু পক্ষের প্রবল বিরোধীতার মুখে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলেও দেশটির শত্রু পক্ষ কোন কালেই বিলুপ্ত হয়নি। বরং ১৯৪৭ থেকেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে পাকিস্তানকে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে তারা নতুন যুদ্ধ শুরু করে। সে যুদ্ধটি শুধু রাজনৈতিক অঙ্গণে সীমিত ছিল না, বরং প্রবল ভাবে শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণে। সে লক্ষ্যে গড়ে উঠে পাকিস্তান বিরোধী শক্তির বিশাল কোয়ালিশন। তাতে শামিল হয় পরাজিত বিপুল সংখ্যক কংগ্রেসী নেতাকর্মী, জমিদারী হারানো জমিদার, হিন্দুত্ববাদী শক্তি, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট এবং বাম ধারার কম্যুনিস্টগণ। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার পর পাকিস্তানপন্থীদের যেরূপ হত্যা বা কারাবন্দী করা হয় এবং তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান বিরোধীদের ক্ষেত্রে সেরূপ হয়নি। বরং মনরঞ্জন ধর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ফনিভূষন মজুমদারদের ন্যায় কংগ্রেসী নেতাগণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশগ্রহনের পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। তাদের থেকে গণপরিষদের তথা সংসদের সদস্যপদও কেড়ে নেয়া হয়নি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও তাদের চেতনার ভূমি দ্রুত অধিকৃত হতে শুরু করে পরাজিত হিন্দু ও তাদের দোসরদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাছে। কারণ, ১৯৪৭’য়ের পরও পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে প্রবল প্লাবন বইছিল কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির। পূর্ব পাকিস্তানে তখনও ছাপা খানা গড়ে উঠেনি। বই কলকাতা থেকে ছাপা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতো। পাকিস্তান সরকার সে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অরক্ষিত থেকেছে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমান্ত।

পাকিস্তান বিরোধীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জোয়ার তীব্রতর হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে। সে আন্দোলনের নেতৃত্বে আসে ইসলামের কট্টোর শত্রু কম্যুনিস্ট নাস্তিক ও কংগ্রেসী হিন্দুত্ববাদীগণ। ঢাকা সহ দেশের প্রত্যন্ত স্কুল কলেজে গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনারের নাম দিয়ে পৌত্তলিক স্তম্ভপূজার রীতি। সেটি পরিণত হয় পাকিস্তান বিরোধীদের সাংস্কৃতিক আইকনে। শুরু হয় পৌত্তলিকতার নতুন রেওয়াজ; সেটি ছিল প্রতি বছর ২১ ফেব্রেয়ারির অন্ধকার ভোর রাতে নগ্ন পদে হেটে ফুল দিয়ে স্তম্ভপূজা। এ জোয়ার মুসলিম লীগ ও দেশের আলেম সমাজ রুখতে পারিনি। তাদের রাজনৈতিক পরাজয়ের শুরু এখান থেকেই। এবং সে পরাজয় চুড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরে।

 

 

শত্রুপক্ষের রাজনৈতিক বিজয় এবং পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প

রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে পাকিস্তান বিরোধী সেক্যুলার, বামপন্থী ও হিন্দুত্ববাদী পক্ষটির প্রতিপত্তি ও প্রভাব এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে খাজা নাজিমুদ্দীন ও নুরুল আমীনের ন্যায় যেসব মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিল এবং জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে বাঙালি মুসলিমদের জমির মালিক বানালো, তাদেরকে বাদ দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা এবং কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ও মনরঞ্জণ ধরের ন্যায় হিন্দুত্ববাদীদেরকে হিরো রূপে গ্রহণ করলো। হিরো রূপে গৃহিত হলো উগ্র হিন্দুত্ববাদী ক্ষুদি রাম ও সূর্য সেন। পাকিস্তান বিরোধীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিজয়ের ফল হলো, ১৯৫৪ সালে নির্বাচেন মুসলিম লীগের ভূমিধ্বস পরাজয়।

১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাষানীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পায় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সে দলটি পরিণত হয় কম্যুনিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসী নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের রাজনৈতিক মঞ্চে। ইসলামের প্রতি এ নতুন দলটির কোন অঙ্গীকার না থাকাতে দলের নামের  সাথে মুসলিম শব্দটি অগ্রহনযোগ্য হয়ে পড়ে; ফলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে স্রেফ আওয়ামী লীগ করা হয়। আর মুসলিম ও ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার না থাকলে পাকিস্তানের প্রতিও অঙ্গীকার থাকার কথা নয়। ফলে দলটির নেতৃত্বে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প। এ দলটি শুরু থেকেই ছিল ভারতের আশির্বাদপুষ্ট। পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলন তখন একটি মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়। কম্যুনিস্ট ঘরানার বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর যখন বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলন -তখন তিনি মিথ্যা বলেন না। বদরুদ্দীন উমর আরো বলেন, কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাজুদ্দীনকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করানো হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্প নিয়ে মুজিবের চেয়েও অধিক সক্রিয় ছিল এই তাজুদ্দীন। কারণ সেটিই ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান এজেন্ডা।

তাছাড়া পাকিস্তান ছিল SEATO ও CENTO চুক্তি ভু্ক্ত মার্কিন বলয়ের একটি দেশ; ফলে সোভিয়েত রাশিয়ারও সামরিক স্ট্রাটেজি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বুকে মার্কিন শিবিরকে দুর্বল করা। সে  লক্ষ্যে সোভিয়েত রাশিয়া কোয়ালিশন গড়ে তোলে চরম পাকিস্তান বিরোধী ভারতের সাথে। বস্তুত ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মাঝে চলমান স্মায়ু যুদ্ধের অংশ রূপে। সোভিয়ের রাশিয়ার সে পাকিস্তান বিরোধী নীতির প্রবল প্রভাব দেখা যেত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের বাম রাজনীতিতে। ১৯৫৭ সালে ৬ ফেব্রেয়ারিতে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সে সম্মেলনে দলের সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাষানী পশ্চিম পাকিস্তানকে “আসসালামু আলাইকুম” জানিয়ে দেন। বস্তুত সেটিই ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রথম ঘোষণা। ভাষানী নিজেও ১৯৭১’য়ে ভারতের কোলে আশ্রয় নেন এবং প্রচুর ভারতীয় নিমক গ্রহন করেন। ১৯৭১’য়ে ভারতপন্থী দুর্বৃত্তরা যখন বিহারীদের উপর বাংলার ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালায় এবং বিহারীদের ঘরবাড়ী ও দোকান পাট কেড়ে নেয়, তখন ভাষানী সে নৃশংসতার কোন নিন্দা করেননি। তিনি সেদিন সে অসহায় মজলুমদের পাশে দাঁড়ায়নি। এমন কি সে নৃশংসতার নিন্দা করেনি তার অনুসারী বামপন্থীরাও। কারণ সেটি ছিল রাজনীতির ভারতপন্থী ও বাম ধারার প্রকল্প।

 

একাত্তরের শিক্ষনীয় বিষয়

১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া থেকে অতি শিক্ষনীয় বিষয়টি হলো, শুধু ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে কোন মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বাঁচে না। স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে লাগাতর যুদ্ধ চাই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও। চাই, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিজয়। সে বিজয়টি আনতে চাই, বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। বুঝতে হবে, শত্রু পক্ষের যুদ্ধটি শুধু ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গণে হয় না, বরং সে যুদ্ধ প্রতিক্ষণ চলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও। তাই দেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে শত্রুর বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রণাঙ্গণেও।

বুদ্ধিবৃত্তিক এ যুদ্ধটি অতি পবিত্র জিহাদ। পবিত্র কুর’আনের সুর ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে এমন বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধকে “জিহাদান কবিরা” তথা বড় যুদ্ধ বলা হয়েছে। এ যুদ্ধের অস্ত্র পবিত্র কুর’আন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে বিজয় রূপে। তখন রাজপথের স্লোগান ছিল, “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” এ স্লোগানের মধ্য দিয়ে কুর’আনী দর্শন কথা বলে। আর মুসলিমের রাজনীতি তো সে কুর’আনী দর্শনকে বিজয়ী করার লড়াই। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের নেতাকর্মীগণ সে দর্শনের সাথে গাদ্দারী করে। যেমন ১৯৪৭-পূর্ব আসাম মুসলিম লীগের নেতা মাওলানা ভাষানী ইসলামের পতাকা ফেলে দিয়ে চীনপন্থী লাল পতাকা নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। এবং মুসলিম লীগের কলকাতার লাঠিয়াল শেখ মুজিব হাতে তুলে নেয় বাঙালি ফ্যাসিবাদের পতাকা। এমন গাদ্দার শুধু ভাষানী ও মুজিব ছিলনা, ছিল অনেকেই।

১৯৪৭’য়ের পূর্বে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে সে সময় মুসলিম লীগের হাতে যেমন চৌকশ রাজনৈতিক যোদ্ধা ছিল, তেমনি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধাও। ছিল অনেক গুলি শক্তিশালী পত্রিকা। ছিল বহু কবি, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি আর অব্যাহত রাখা হয়নি -বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের বুকে। মুসলিম লীগ তার যুদ্ধকে সীমিত করে শুধু রাজনৈতিক অঙ্গণে। এবং বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণকে বিনাযুদ্ধে বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্ট শত্রু পক্ষের হাতে ময়দান খালি ছেড়ে দেয়। মুসলিম লীগ পত্রিকা বের করতো, কিন্তু পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলি দখলে নিত বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্ট লেখক ও কলামিস্টগণ। ফলে মুসলিম লীগের পত্রিকা দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান আর মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের পক্ষে থাকেনি। সেগুলি বামপন্থী ও সেক্যুলারিস্টদের দখলে চলে গেছে।

এমন কি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের বুদ্ধিজীবীগণ ব্যর্থ হয়েছেন, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা কেন অপরিহার্য ছিল -সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জনগণকে বুঝাতে। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার বিপদ কি -সেটিও তারা বুঝাতে পারেননি। অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচলে যে বাঙালি মুসলিমগণ পেত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার সুযোগ -সে কথাটিও বাঙালি মুসলিমদের বুঝাতে পারেননি। পাকিস্তান ভাঙ্গলে বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ যে অরক্ষিত হবে এবং ভারতের অধিনত এক আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হবে -সে বাস্তবতাটিও প্রবল ভাবে তুলে ধরতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে মুসলিম লীগের নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীগণ পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে একটি বইও লেখেননি। তাদের সে ব্যর্থতার কারণেই পাকিস্তানের শত্রুগণ ১৯৭১’য়ে একটি সহজ বিজয় পেয়েছে এবং তাতে বাঁচেনি অখণ্ড পাকিস্তান -যা হতে পারতো মুসলিম উম্মাহর একটি অভিভাবক রাষ্ট্র।

তবে পাকিস্তানের একাত্তরের পরাজয় এবং বিভক্তি বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখে গেছে। সেটি হলো, আগামীতে বাংলাদেশও বাঁচবে না -যদি ভারতীয় সাহায্যপুষ্ট পৌত্তলিক সংস্কৃতির জোয়ার রুখার কাজে বাঙালি মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়। এবং যদি তারা ব্যর্থ হয় সেক্যুলারিস্টদের ষড়যন্ত্র রুখতে। কারণ, এ দুটি ক্ষেত্রে শত্রুশক্তির বিনিয়োগটি বিশাল ও লাগাতর। এবং যে কোন দেশের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টানোর ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জোয়ারের সামর্থ্যটি বিশাল। সে জোয়ারই রাজনৈতিক জোয়ার সৃষ্টি করে। সে জোয়ারই ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের ভূগোল পাল্টিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পিছনেও কাজ করেছে তেমনি এক জোয়ার।  হাসিনার শাসনামলে সে জোয়ার এতটাই বেগবান হয়েছিল যে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমিন বলেছিল, “ভারতের বিজয়ই আমাদের বিজয়।” চেতনার ভূগোল যদি এতটা একাকার হয়ে যায় তখনকি দেশের ভূগোল পৃথক থাকে? ভারত তো সে পথেই এগুতে চায়।

 

স্বাধীনতার সুরক্ষা কিরূপে?

একমাত্র কুর’আনী দর্শনই শত্রুর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অধিকৃতি থেকে মুসলিম ভূমিকে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশে সে অস্ত্রের প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে হচ্ছে না স্বাধীনতা বাঁচানোর কাঙ্খিত কাজটি। ফলে হাসিনার পতন হলেও বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনার ভূমি এখনো অধিকৃত রয়ে গেছে ইসলাম বিরোধী দূষিত দর্শনে। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য সেটিই হলো বিপদের মূল কারণ। বুঝতে হবে, মানব দেহের প্রতিরক্ষা দেয় যেমন দেহের ভিভরে গড়ে উঠা ইম্যুনিটি, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয় আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ইম্যুনিটি । মুসলিম সে ইম্যুনিটি পায় পবিত্র কুর’আন ও হাদীস থেকে। মুসলিম তখন শধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী হওয়া নিয়ে খুশি থাকে না, বরং প্রতিক্ষণের লড়াকু মুজাহিদে পরিণত হয়।

বুঝতে হবে স্বাধীনতা বাঁচানোর যুদ্ধটি প্রতিক্ষণের। যাদের জীবনে সে যুদ্ধ নাই, তাদের বাঁচতে হয় শত্রুর পদতলে পরাধীনতা নিয়ে। তাই মহান নবীজী (সা:) তাঁর সাহাবাদের শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী বানাননি, আমৃত্য মুজাহিদে পরিণত করেছেন। অর্ধেক সাহাবী শহীদ হয়েছেন। এবং নবীজী (সা:) নিজে ২৮টি যুদ্ধে সশরীরে অংশ নিয়েছেন। এবং নবীজী (সা:) যা কিছু করেছেন তা তো সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেকই করেছেন। আর নবীজী (সা:) যা কিছু করেছেন -সে অনুসারে চলতে হয় প্রতিটি মুসলিমকে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম জীবনে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আদর্শ নাই। তারা বাঁচছে ইসলামের মুখোশ নিয়ে, ঈমান ও আমল নিয়ে নয়। যুদ্ধ দূরে থাকে, “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” বলে ক’জন বাঙালি মুসলিম রাজপথে শরিয়ত’য়ের দাবী নিয়ে রাস্তায় নেমেছে? শতকরা একজন দূরে থাক, হাজারে একজনও কি? ব্রিটিশ আমলে মুসলিম লীগের নেতৃ্ত্বে নেমেছিল, তাই পাকিস্তান পেয়েছিল।

যারা স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার মূল্য পরিশোধ করতে পারে, একমাত্র তারাই স্বাধীনতা পায়। সেটি ইতিহাসের রীতি। সে মূল্য পরিশোধে বাঙালি মুসলিম ১৭৫৭ ও ১৯৭১’য়ে ব্যর্থ হয়েছে। তারা তখন যুদ্ধে নামেনি। আগামীতেও যে নামবে সে সম্ভাবনাই বা কতটুকু? সে ঈমানী প্রস্তুতিই বা কই? ফলে ১৭৫৭’য়ে পেয়েছে ব্রিটিশের গোলামী এবং ১৯৭১’য়ে পেয়েছে ভারত ও ভারতসেবী দুর্বৃত্তদের গোলামী। উভয় গোলামী কালেই অসম্ভব করা হয়েছে স্বাধীনতা ও পূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচা। এবং নেমে এসেছে গণহত্যা ও গণনির্যাতন। তাই স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে প্রতিটি বাঙালি মুসলিমকে স্বাধীনতা বাঁচানোর দায় নিয়ে বাঁচতে হবে। থাকতে হবে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধের তাড়না। এ ফরজ দায়িত্ব পালনে কোন কাজা নাই। ২৩/০৭/২০২৫