০১:২৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৫ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

মুসলিম দেশে মুনাফিক শাসন ও উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়

মতামত
  • Update Time : ০২:২৬:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
  • / ২৩৭ Time View

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল:

www.drfirozmahboobkamal.com/blog/মুসলিম-দেশে-মুনাফিক-শাসন/

 

ইসলামী শাসন, কাফির শাসন ও মুনাফিক শাসন

মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে মানব জাতির বিভাজন মূলত তিন শ্রেণীতে: কাফির, মুনাফিক ও মুমিন। এবং কারা দেশ শাসন করছে তার ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থাও তিন প্রকার: ইসলামী শাসন, কাফির শাসন ও মুনাফিক শাসন। ইসলামী শাসন বলতে সেটিই বুঝায় -যা মহান নবীজী (সা:) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করে এবং  ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান রূপে শাসন করে নমুনা পেশ করে গেছেন। এ শাসন ব্যবস্থার মূল কথা  মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার। নবীজী (সা:)’র পর খোলাফায়ে রাশেদা সে শাসন ব্যবস্থা আরো বহু বছর জীবিত রাখেন; পরে সে ইসলামী রাষ্ট্র সর্ববৃহৎ বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়। এবং সে রাষ্ট্রের উপর নির্মিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।

ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আইনের শাসন; এবং রাষ্ট্রের সে আইন মানবসৃষ্ট নয়, বরং মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া। রাষ্ট্রের শাসক কাজ করে কোন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রূপে নয় বরং মহান রবের খলিফা রূপে। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় মানব কল্যান, সত্য, সুশিক্ষা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে। এবং বিশাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও তার প্রাতিষ্ঠানিক লোকবল কাজ করে মিথ্যা, দুর্বৃত্তি, জুলুম ও অবিচারের নির্মূলে্। এবং রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয় ওহীর জ্ঞানে জনগণকে আলোকিত করায়। এভাবে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে যে রাষ্ট্র নিজের এজেন্ডা বানিয়ে নেয়ে -সেটিই হলো ইসলামী রাষ্ট্র। এবং মহান আল্লাহর এজেন্ডা হলো, সকল মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও মিথ্যা দর্শনের উপর ইসলামের বিজয়। তখন জিহাদ সংঘটিত হয় শুধু জালেম রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধেই নয়, বরং বড় জিহাদটি পরিচালিত হয় জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে। এবং সে জিহাদের অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন।

ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তখন শাসক না হয়ে জনগণের খাদেমে পরিণত হয়। সাধারণ জনগণ তখন পায় নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠার পূর্ণ স্বাধীনতা। ফলে অতি দ্রুত আসে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সম্পদের প্রাচুর্য। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় এতীম, দুস্থ, নিঃস্ব ও পঙ্গুদের অভিভাবকে। সে রাষ্ট্রের প্রশাসন, শিক্ষাদান, বিচার কার্য, সমাজ কর্ম ও রাজনীতি পরিণত হয় উচ্চ মার্গীয় ইবাদতে। রাষ্ট্র তখন শুধু জনগণের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা দেয় না, বরং সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয় জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর। এভাবে রাষ্ট্র পরিণত হয় জান্নাতের বাহনে। নবীজী (:)’র প্রতিষ্ঠিত সে রাষ্ট্রই  হলো ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল। নবীজী (:)’র সে রাষ্ট্র কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়েছিল। সমগ্র মানব ইতিহাসে সে রাষ্ট্রই হলো মানব কল্যানের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজেক্ট। রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, কৃষি উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক রাষ্ট্রই করে, কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে অনন্ত অসীম কালের জন্য নেয়ামত ভরা জান্নাতে নেয়ার কাজটি আর কোন রাষ্ট্রই করেনি। তাই ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কর্ম এ পৃথিবী পৃষ্ঠে নাই। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের এ লড়াইটি হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদ।

কাফির শাসিত রাষ্ট্রের উত্তম উদাহরণ হলো আজকের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের শাসিত ভারত। এদেশে লাগতর যুদ্ধটি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে। পৌত্তলিকতার ন্যায় অতি সনাতন মিথ্যাকে ধর্মের লেবাস পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখাই হলো এ রাষ্ট্রের মূল এজেন্ডা। রাষ্ট্রের নীতি হলো, গরু, মূর্তি, লিঙ্গ, সাপ, পাহাড়-পর্বত, নদী -এগুলিকে পূজনীয় করা। দেশটির নীতি হলো হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের প্রচারকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিহত করা।  কেউ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলে তাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়। সেটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়। এদেশে স্বাধীনতা একমাত্র হিন্দুদের। এবং একমাত্র তারাই ভারতীয় যাদের জন্মস্থান ও পুণ্যস্থান হলো ভারত। এর অর্থ, যাদের পুণ্যস্থান মক্কা বা জেরুজালেম, হিন্দুত্ববাদীদের দৃষ্টিতে তারা ভারতীয় নয়। মুসলিমদের এরা ভারতীয় না বলে বহিরাগত বলে। দেশটির রাজ পথে স্লোগান তোলা হয়: মুসলিম কো লিয়ে দো স্তান: পাকিস্তান ইয়া কবরস্তান। ভারতে মসজিদ ভাঙ্গা হয় এবং নতুন মসজিদ নির্মাণে অনুমতি দেয়া হয়না। মসজিদের অভাবে মুসলিম নামাজীরা যখন রাস্তায় বা খোলা মাঠে নামাজ পড়তে দাঁড়ায় তখন পুলিশ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাদেরকে লাঠি দিয়ে পেটায় ও মাথার উপর পাথর ছুঁড়ে। টুপি মাথায় দিয়ে রাস্তায় নামলে “জয় শ্রীরাম” বলতে বাধ্য করা হয়।

কাফির রাষ্ট্রের মূল কাজ হলো, রাষ্ট্রকে জাহান্নামের বাহনে পরিণত করা। সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মচারিগণ কাজ করে শয়তানের এজেন্ট রূপে। শয়তানের এ এজেন্টদের কাজ হয় মুসলিম মহল্লায় ঢুকে বুল ডোজার চালিয়ে মুসলিমদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করা ও গণহত্যা চালানো। এদেশে মুসলিমদের গণহ্ত্যা ও মুসলিম নারীদের গণধর্ষণ করলে শাস্তি হয়না। মুসলিমদের নতুন কোন আবাসিক এলাকায় বাড়ী ক্রয়ের অনুমতি দেয়া হয়না। ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা ২০ কোটির অধিক, কিন্তু মন্ত্রী সভায় একজন মুসলিমও নেই। জনসংখ্যা শতকরা ১৮ ভাগ মুসলিম, কিন্তু সরকারি চাকুরিতে শতকরা ৩ ভাগও মুসলিম নয়। এভাবে মুসলিমদের বঞ্চিত রাখাই হলো সরকারি নীতি।

মুনাফিক শাসিত রাষ্ট্রের উদাহরণ হলো মুজিব ও হাসিনার শাসিত বাংলাদেশ। কাফির রাষ্ট্রের ন্যায় মুনাফিক শাসিত রাষ্ট্রেও যুদ্ধটি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ইসলামকে পরাজিত রাখাই এমন রাষ্ট্রের নীতি। শুধু পার্থক্য হলো, এসব মুনাফিক শাসকগণ নিজেদেরকে কাফির না বলে মুসলিম রূপে দাবী করে। শেখ মুজিব ক্ষমতায় এসেই সকল ইসলামী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। সকল ইসলামী দলের নেতাদের কারাবন্দী করেছিল। নিষিদ্ধ করেছিল ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়াকে। এবং পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল কম্যুনিস্টদের ন্যায় সকল ইসলামবিরোধী শক্তিকে। শেখ হাসিনাও আলেম ও ইসলামপন্থীদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে কারাবন্দী করেছিল। শাপলা চত্বরে হিফাজতে ইসলামের জনসমাবেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। এবং নিয়ন্ত্রিত করেছিল কুর’আনের তাফসিরকে। ভারতের সাথে নীতিগত কোন পার্থক্য না থাকাতে ভারতে মসজিদে ধ্বংস করলে বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বার বার গণহত্যা চালালে হাসিনা কখনোই তার নিন্দা করেনি।

 

জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁচাটি হলো মুনাফিকি থেকে বাঁচা

একমাত্র মুমিন তথা ঈমানদারগণ যাবে জান্নাতে। কাফির ও মুনাফিকগণ যাবে জাহান্নামে। তাই মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় বিষয় হলো, কারা কাফির, কারা মুনাফিক ও কারা মু’মিন -সে বিষয়গুলি সঠিক ভাবে জানা। এবং জীবনের প্রধান এজেন্ডা হতে হয় সত্যিকার মুমিন হওয়ায়। এখানে ভূল হলে পুরা বাঁচাটাই ভূল হয়; এবং সে ভূল জাহান্নামে হাজির করে। এক্ষেত্রে পবিত্র কুর’আন ও হাদীসের বয়ান অতি সুস্পষ্ট।

মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে শুধু বিশ্বাসই করে না, ইসলামের পূর্ণ বিজয়ও চায়।  অপর দিকে কাফির তো তারাই যারা এ পৃথিবী পৃষ্ঠে ইসলামের বিজয় বা প্রতিষ্ঠা চায় না। ইসলামের প্রতিষ্ঠা চাওয়ার অর্থ: মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনে প্রতিষ্ঠা। সে সাথে অসত্য ও অবিচারের নির্মূল এবং কুর’আনী সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। কাফিরদের ন্যায় মুনাফিকগণও ইসলামের এরূপ বিজয় ও প্রতিষ্ঠা চায় না। শুধু তাই নয়, ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধনে তারা কাফিরদের সাথে একত্রে যুদ্ধও করে – যেমনটি ১৯৭১ সালে করেছে ভারতীয় কাফিরদের সাথে মিলে এবং ১৯১৭ সালে করেছে ইংরেজদের সাথে মিলে। অতীতে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে ব্রিটিশ, মার্কিন, ফরাসী ও ভারতীয়রা বিপুল সংখ্যক সহায়ক সৈনিক পেয়েছে এই মুনাফিকদের মধ্য থেকেই। অধিকাংশ মুসলিম দেশ আজ অধিকৃত বস্তুত এমন মুনাফিকদের হাতেই। মুসলিম উম্মাহর আজকের বিভক্তি ও বিপর্যয়ের মূল কারণ এই মুনাফিক অধিকৃতি।

মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁচাটি হলো মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচা। কাফির হওয়া থেকে বাঁচাটি অতি সহজ। মুখে একবার জনসম্মুখে কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করলে তাকে আর কাফির বলা যায় না। অথচ আজকের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হচ্ছে মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচায়। কালেমা পাঠের ন্যায় নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করাও তেমন কঠিন নয়। বহু ঘুষখোর, সূদখোর এবং প্রতারক দুর্বৃত্তরাও নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং হজ্জ করে। নবীজী (সা:)’র যুগে অতি কপট মুনাফিকগণও নামাজ পড়তো। তারা নামাজ পড়তো এমন কি নবীজী (সা:)’র পিছনে প্রথম সারীতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে ঈমানদার হতে। কারণ, নামাজ পড়লেও তারা ইসলামের বিজয় চায়নি। আরবের ভূ-রাজনীতিতে তারা ছিল কাফিরদের মিত্র। মুসলিমদের পরাজিত করার লক্ষ্যে তারা কাফের ও ইহুদীদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করতো। তাদের মুনাফিকি প্রকাশ পায় ওহুদের যুদ্ধের সময়; সে সময় মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিতে তারা রাজী হয়নি। এরা মুখে নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও পবিত্র কুর’আনে তাদেরকে কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। এরাই মুসলিম উম্মাহর ঘরের শত্রু। পবিত্র কুর’আন মতে জাহান্নামে মুনাফিকদের স্থান হবে কাফেরদের চেয়েও নীচে তথা অধিকতর আযাবপূর্ণ স্থানে।

 

মুনাফিকি নিয়ে বাঁচাই যখন আচার

প্রশ্ন হলো, মুনাফিকদের সংখ্যা কি বাংলাদেশে কম? দেশটির রাজনীতিতে যারা ইসলামকে পরাজিত রেখেছে, সংবিধানে যারা বিলুপ্ত করেছে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, আদালতে বিলুপ্ত করেছে শরিয়তের আইন -তাদের সবাই কি মূর্তিপূজারী কাফের? অথচ এ কাজ তো তাদের যাদের অনেকেই নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, যাকাত দেয় এবং হজ্জ করে। এদের অনেকের হাতে তাসবিহ এবং মাথায় টুপিও দেখা যায়। পবিত্র কুর’আনের সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে পৃথক ভাবে বলা হয়েছে: যারা তার কুর’আনে নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালনা করে না তারা কাফির, তারা জালিম ও তারা ফাসিক। এ আয়াতে কোন অস্পষ্টতা নাই; যে কোন পাঠকই এর অর্থ বুঝতে পারে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে যে শাসকগণ ও বিচারকগণ আদালতে শরিয়ত আইন বিলুপ্ত করে রেখেছে এবং বিচারের বিধান রেখেছে কুফিরী আইনে তাদেরকে কি মুসলিম বলা যায়? কুর’আন তাদের কাফির বলছে। কিন্তু তারা যেহেতু নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে, সেহেতু তাদের কাফির বলা যাবে না। ফলে তাদেরকে অবশ্যই মুনাফিক বলতে হবে। কারণ, তাদের কাজটি কাফিরদের মত, কিন্তু অভিনয়টি মুসলিমের মত। এ মুনাফিকদের মুসলিম বললে তো বিদ্রোহ ও মিথ্যাচার হয় মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণার সাথে। অথচ সে বিদ্রোহ ও মিথ্যাচারের সাথে জড়িত তো সে সব মুসলিম -যারা এ মুনাফিকদের মুসলিম বলে।

একজন রাজার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো সেই সব প্রজা যারা তার সার্বভৌমত্ব ও আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় এবং তার আইনকে অমান্য করে। রাজা এমন বিদ্রোহী প্রজাদের ফাঁসিতে চড়াবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। নইলে তার রাজত্ব বাঁচবে না। প্রশ্ন হলো, যাদের বিদ্রোহ মহান আল্লাহ তায়ালার শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে, সেসব কাফিরদের কি জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে? সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও আইনের প্রতি যাদের বিশ্বাস তাদের তো উচিত ছিল দেশের মুনাফিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হওয়া এবং শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। কিন্তু তা নিয়ে কোন ভাবনা নাই, কোন তাড়নাও নাই। মুনাফিকি তাই শুধু শাসক শক্তির নয়, জনগণেরও আচারে পরিণত হয়েছে।

মুসলিম হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, তাকে বাঁচতে হয় কাফিরদের থেকে বিপরীত রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডা নিয়ে। কিন্তু কালেমা পাঠ করার পরও যাদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের যুদ্ধটি ইসলামের বিরুদ্ধে, আদালতে শরিয়তী আইন বিলুপ্ত রাখাই যাদের বৈচারিক নীতি, হিন্দুত্ববাদী ভারতের বন্ধুত্ব যাদের পররাষ্ট্র নীতি, সূদ দেয়া ও সূদ নেয়াই যাদের অর্থনীতি, নগরে-বন্দরে পতিতাপল্লীগুলিকে প্রহরা দেয়া যাদের সংস্কৃতি, অফিসের বসে ঘুষ খাওয়াই যাদের প্রশাসনিক রীতি  -তারা তো সুস্পষ্ট মুনাফিক। নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়াদরুদ যতই পালন করা হোক না কেন -সেগুলি মুনাফিকদের ঈমানদার বানাতে পারে? মুনাফিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুনাফিকি স্পষ্ট দেখা যায় ১৯৭১’য়ে। তখন তাদের দেখা গেছে ভারতীয় কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে। কাফেরদের এজেন্ডা ও তাদের এজেন্ডা সেদিন একাকার হয়েছিল। ঈমানদারের এজেন্ডা কি কখনো এক মুহুর্তের জন্যও কাফিরদের এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয়? তেল ও পানি যেমন কখনোই একত্রে মেশে না, তেমনি মুসলিমের এজেন্ডা ও কাফেরদের এজেন্ডা কখনোই একীভূত হয়না। পবিত্র কুর’আন তো সেটিই শেখায়। কাফিরদের সাথে এরূপ একাত্মতা ঘটে একমাত্র মুনাফিকদের ক্ষেত্রে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

3 thoughts on “মুসলিম দেশে মুনাফিক শাসন ও উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

মুসলিম দেশে মুনাফিক শাসন ও উম্মাহর বর্তমান বিপর্যয়

Update Time : ০২:২৬:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

 

ফিরোজ মাহবুব কামাল:

www.drfirozmahboobkamal.com/blog/মুসলিম-দেশে-মুনাফিক-শাসন/

 

ইসলামী শাসন, কাফির শাসন ও মুনাফিক শাসন

মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে মানব জাতির বিভাজন মূলত তিন শ্রেণীতে: কাফির, মুনাফিক ও মুমিন। এবং কারা দেশ শাসন করছে তার ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থাও তিন প্রকার: ইসলামী শাসন, কাফির শাসন ও মুনাফিক শাসন। ইসলামী শাসন বলতে সেটিই বুঝায় -যা মহান নবীজী (সা:) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করে এবং  ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান রূপে শাসন করে নমুনা পেশ করে গেছেন। এ শাসন ব্যবস্থার মূল কথা  মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার। নবীজী (সা:)’র পর খোলাফায়ে রাশেদা সে শাসন ব্যবস্থা আরো বহু বছর জীবিত রাখেন; পরে সে ইসলামী রাষ্ট্র সর্ববৃহৎ বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়। এবং সে রাষ্ট্রের উপর নির্মিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।

ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আইনের শাসন; এবং রাষ্ট্রের সে আইন মানবসৃষ্ট নয়, বরং মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া। রাষ্ট্রের শাসক কাজ করে কোন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রূপে নয় বরং মহান রবের খলিফা রূপে। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় মানব কল্যান, সত্য, সুশিক্ষা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে। এবং বিশাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও তার প্রাতিষ্ঠানিক লোকবল কাজ করে মিথ্যা, দুর্বৃত্তি, জুলুম ও অবিচারের নির্মূলে্। এবং রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয় ওহীর জ্ঞানে জনগণকে আলোকিত করায়। এভাবে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে যে রাষ্ট্র নিজের এজেন্ডা বানিয়ে নেয়ে -সেটিই হলো ইসলামী রাষ্ট্র। এবং মহান আল্লাহর এজেন্ডা হলো, সকল মিথ্যা ধর্ম, মিথ্যা মতবাদ ও মিথ্যা দর্শনের উপর ইসলামের বিজয়। তখন জিহাদ সংঘটিত হয় শুধু জালেম রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধেই নয়, বরং বড় জিহাদটি পরিচালিত হয় জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে। এবং সে জিহাদের অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন।

ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ তখন শাসক না হয়ে জনগণের খাদেমে পরিণত হয়। সাধারণ জনগণ তখন পায় নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠার পূর্ণ স্বাধীনতা। ফলে অতি দ্রুত আসে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সম্পদের প্রাচুর্য। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় এতীম, দুস্থ, নিঃস্ব ও পঙ্গুদের অভিভাবকে। সে রাষ্ট্রের প্রশাসন, শিক্ষাদান, বিচার কার্য, সমাজ কর্ম ও রাজনীতি পরিণত হয় উচ্চ মার্গীয় ইবাদতে। রাষ্ট্র তখন শুধু জনগণের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা দেয় না, বরং সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয় জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর। এভাবে রাষ্ট্র পরিণত হয় জান্নাতের বাহনে। নবীজী (:)’র প্রতিষ্ঠিত সে রাষ্ট্রই  হলো ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল। নবীজী (:)’র সে রাষ্ট্র কোটি কোটি মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়েছিল। সমগ্র মানব ইতিহাসে সে রাষ্ট্রই হলো মানব কল্যানের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজেক্ট। রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, কৃষি উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক রাষ্ট্রই করে, কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে অনন্ত অসীম কালের জন্য নেয়ামত ভরা জান্নাতে নেয়ার কাজটি আর কোন রাষ্ট্রই করেনি। তাই ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কর্ম এ পৃথিবী পৃষ্ঠে নাই। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের এ লড়াইটি হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তথা জিহাদ।

কাফির শাসিত রাষ্ট্রের উত্তম উদাহরণ হলো আজকের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের শাসিত ভারত। এদেশে লাগতর যুদ্ধটি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে। পৌত্তলিকতার ন্যায় অতি সনাতন মিথ্যাকে ধর্মের লেবাস পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখাই হলো এ রাষ্ট্রের মূল এজেন্ডা। রাষ্ট্রের নীতি হলো, গরু, মূর্তি, লিঙ্গ, সাপ, পাহাড়-পর্বত, নদী -এগুলিকে পূজনীয় করা। দেশটির নীতি হলো হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের প্রচারকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিহত করা।  কেউ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলে তাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়। সেটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়। এদেশে স্বাধীনতা একমাত্র হিন্দুদের। এবং একমাত্র তারাই ভারতীয় যাদের জন্মস্থান ও পুণ্যস্থান হলো ভারত। এর অর্থ, যাদের পুণ্যস্থান মক্কা বা জেরুজালেম, হিন্দুত্ববাদীদের দৃষ্টিতে তারা ভারতীয় নয়। মুসলিমদের এরা ভারতীয় না বলে বহিরাগত বলে। দেশটির রাজ পথে স্লোগান তোলা হয়: মুসলিম কো লিয়ে দো স্তান: পাকিস্তান ইয়া কবরস্তান। ভারতে মসজিদ ভাঙ্গা হয় এবং নতুন মসজিদ নির্মাণে অনুমতি দেয়া হয়না। মসজিদের অভাবে মুসলিম নামাজীরা যখন রাস্তায় বা খোলা মাঠে নামাজ পড়তে দাঁড়ায় তখন পুলিশ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাদেরকে লাঠি দিয়ে পেটায় ও মাথার উপর পাথর ছুঁড়ে। টুপি মাথায় দিয়ে রাস্তায় নামলে “জয় শ্রীরাম” বলতে বাধ্য করা হয়।

কাফির রাষ্ট্রের মূল কাজ হলো, রাষ্ট্রকে জাহান্নামের বাহনে পরিণত করা। সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মচারিগণ কাজ করে শয়তানের এজেন্ট রূপে। শয়তানের এ এজেন্টদের কাজ হয় মুসলিম মহল্লায় ঢুকে বুল ডোজার চালিয়ে মুসলিমদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করা ও গণহত্যা চালানো। এদেশে মুসলিমদের গণহ্ত্যা ও মুসলিম নারীদের গণধর্ষণ করলে শাস্তি হয়না। মুসলিমদের নতুন কোন আবাসিক এলাকায় বাড়ী ক্রয়ের অনুমতি দেয়া হয়না। ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা ২০ কোটির অধিক, কিন্তু মন্ত্রী সভায় একজন মুসলিমও নেই। জনসংখ্যা শতকরা ১৮ ভাগ মুসলিম, কিন্তু সরকারি চাকুরিতে শতকরা ৩ ভাগও মুসলিম নয়। এভাবে মুসলিমদের বঞ্চিত রাখাই হলো সরকারি নীতি।

মুনাফিক শাসিত রাষ্ট্রের উদাহরণ হলো মুজিব ও হাসিনার শাসিত বাংলাদেশ। কাফির রাষ্ট্রের ন্যায় মুনাফিক শাসিত রাষ্ট্রেও যুদ্ধটি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ইসলামকে পরাজিত রাখাই এমন রাষ্ট্রের নীতি। শুধু পার্থক্য হলো, এসব মুনাফিক শাসকগণ নিজেদেরকে কাফির না বলে মুসলিম রূপে দাবী করে। শেখ মুজিব ক্ষমতায় এসেই সকল ইসলামী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিল। সকল ইসলামী দলের নেতাদের কারাবন্দী করেছিল। নিষিদ্ধ করেছিল ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়াকে। এবং পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল কম্যুনিস্টদের ন্যায় সকল ইসলামবিরোধী শক্তিকে। শেখ হাসিনাও আলেম ও ইসলামপন্থীদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে কারাবন্দী করেছিল। শাপলা চত্বরে হিফাজতে ইসলামের জনসমাবেশে গণহত্যা চালিয়েছিল। এবং নিয়ন্ত্রিত করেছিল কুর’আনের তাফসিরকে। ভারতের সাথে নীতিগত কোন পার্থক্য না থাকাতে ভারতে মসজিদে ধ্বংস করলে বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বার বার গণহত্যা চালালে হাসিনা কখনোই তার নিন্দা করেনি।

 

জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁচাটি হলো মুনাফিকি থেকে বাঁচা

একমাত্র মুমিন তথা ঈমানদারগণ যাবে জান্নাতে। কাফির ও মুনাফিকগণ যাবে জাহান্নামে। তাই মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ শিক্ষনীয় বিষয় হলো, কারা কাফির, কারা মুনাফিক ও কারা মু’মিন -সে বিষয়গুলি সঠিক ভাবে জানা। এবং জীবনের প্রধান এজেন্ডা হতে হয় সত্যিকার মুমিন হওয়ায়। এখানে ভূল হলে পুরা বাঁচাটাই ভূল হয়; এবং সে ভূল জাহান্নামে হাজির করে। এক্ষেত্রে পবিত্র কুর’আন ও হাদীসের বয়ান অতি সুস্পষ্ট।

মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে শুধু বিশ্বাসই করে না, ইসলামের পূর্ণ বিজয়ও চায়।  অপর দিকে কাফির তো তারাই যারা এ পৃথিবী পৃষ্ঠে ইসলামের বিজয় বা প্রতিষ্ঠা চায় না। ইসলামের প্রতিষ্ঠা চাওয়ার অর্থ: মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনে প্রতিষ্ঠা। সে সাথে অসত্য ও অবিচারের নির্মূল এবং কুর’আনী সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। কাফিরদের ন্যায় মুনাফিকগণও ইসলামের এরূপ বিজয় ও প্রতিষ্ঠা চায় না। শুধু তাই নয়, ইসলামের প্রতিষ্ঠা রুখতে এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধনে তারা কাফিরদের সাথে একত্রে যুদ্ধও করে – যেমনটি ১৯৭১ সালে করেছে ভারতীয় কাফিরদের সাথে মিলে এবং ১৯১৭ সালে করেছে ইংরেজদের সাথে মিলে। অতীতে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে ব্রিটিশ, মার্কিন, ফরাসী ও ভারতীয়রা বিপুল সংখ্যক সহায়ক সৈনিক পেয়েছে এই মুনাফিকদের মধ্য থেকেই। অধিকাংশ মুসলিম দেশ আজ অধিকৃত বস্তুত এমন মুনাফিকদের হাতেই। মুসলিম উম্মাহর আজকের বিভক্তি ও বিপর্যয়ের মূল কারণ এই মুনাফিক অধিকৃতি।

মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁচাটি হলো মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচা। কাফির হওয়া থেকে বাঁচাটি অতি সহজ। মুখে একবার জনসম্মুখে কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করলে তাকে আর কাফির বলা যায় না। অথচ আজকের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হচ্ছে মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচায়। কালেমা পাঠের ন্যায় নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করাও তেমন কঠিন নয়। বহু ঘুষখোর, সূদখোর এবং প্রতারক দুর্বৃত্তরাও নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং হজ্জ করে। নবীজী (সা:)’র যুগে অতি কপট মুনাফিকগণও নামাজ পড়তো। তারা নামাজ পড়তো এমন কি নবীজী (সা:)’র পিছনে প্রথম সারীতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে ঈমানদার হতে। কারণ, নামাজ পড়লেও তারা ইসলামের বিজয় চায়নি। আরবের ভূ-রাজনীতিতে তারা ছিল কাফিরদের মিত্র। মুসলিমদের পরাজিত করার লক্ষ্যে তারা কাফের ও ইহুদীদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করতো। তাদের মুনাফিকি প্রকাশ পায় ওহুদের যুদ্ধের সময়; সে সময় মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিতে তারা রাজী হয়নি। এরা মুখে নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও পবিত্র কুর’আনে তাদেরকে কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। এরাই মুসলিম উম্মাহর ঘরের শত্রু। পবিত্র কুর’আন মতে জাহান্নামে মুনাফিকদের স্থান হবে কাফেরদের চেয়েও নীচে তথা অধিকতর আযাবপূর্ণ স্থানে।

 

মুনাফিকি নিয়ে বাঁচাই যখন আচার

প্রশ্ন হলো, মুনাফিকদের সংখ্যা কি বাংলাদেশে কম? দেশটির রাজনীতিতে যারা ইসলামকে পরাজিত রেখেছে, সংবিধানে যারা বিলুপ্ত করেছে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, আদালতে বিলুপ্ত করেছে শরিয়তের আইন -তাদের সবাই কি মূর্তিপূজারী কাফের? অথচ এ কাজ তো তাদের যাদের অনেকেই নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, যাকাত দেয় এবং হজ্জ করে। এদের অনেকের হাতে তাসবিহ এবং মাথায় টুপিও দেখা যায়। পবিত্র কুর’আনের সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে পৃথক ভাবে বলা হয়েছে: যারা তার কুর’আনে নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালনা করে না তারা কাফির, তারা জালিম ও তারা ফাসিক। এ আয়াতে কোন অস্পষ্টতা নাই; যে কোন পাঠকই এর অর্থ বুঝতে পারে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে যে শাসকগণ ও বিচারকগণ আদালতে শরিয়ত আইন বিলুপ্ত করে রেখেছে এবং বিচারের বিধান রেখেছে কুফিরী আইনে তাদেরকে কি মুসলিম বলা যায়? কুর’আন তাদের কাফির বলছে। কিন্তু তারা যেহেতু নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে, সেহেতু তাদের কাফির বলা যাবে না। ফলে তাদেরকে অবশ্যই মুনাফিক বলতে হবে। কারণ, তাদের কাজটি কাফিরদের মত, কিন্তু অভিনয়টি মুসলিমের মত। এ মুনাফিকদের মুসলিম বললে তো বিদ্রোহ ও মিথ্যাচার হয় মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণার সাথে। অথচ সে বিদ্রোহ ও মিথ্যাচারের সাথে জড়িত তো সে সব মুসলিম -যারা এ মুনাফিকদের মুসলিম বলে।

একজন রাজার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো সেই সব প্রজা যারা তার সার্বভৌমত্ব ও আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় এবং তার আইনকে অমান্য করে। রাজা এমন বিদ্রোহী প্রজাদের ফাঁসিতে চড়াবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। নইলে তার রাজত্ব বাঁচবে না। প্রশ্ন হলো, যাদের বিদ্রোহ মহান আল্লাহ তায়ালার শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে, সেসব কাফিরদের কি জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে? সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও আইনের প্রতি যাদের বিশ্বাস তাদের তো উচিত ছিল দেশের মুনাফিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হওয়া এবং শরিয়তী আইনকে প্রতিষ্ঠা দেয়া। কিন্তু তা নিয়ে কোন ভাবনা নাই, কোন তাড়নাও নাই। মুনাফিকি তাই শুধু শাসক শক্তির নয়, জনগণেরও আচারে পরিণত হয়েছে।

মুসলিম হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, তাকে বাঁচতে হয় কাফিরদের থেকে বিপরীত রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডা নিয়ে। কিন্তু কালেমা পাঠ করার পরও যাদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের যুদ্ধটি ইসলামের বিরুদ্ধে, আদালতে শরিয়তী আইন বিলুপ্ত রাখাই যাদের বৈচারিক নীতি, হিন্দুত্ববাদী ভারতের বন্ধুত্ব যাদের পররাষ্ট্র নীতি, সূদ দেয়া ও সূদ নেয়াই যাদের অর্থনীতি, নগরে-বন্দরে পতিতাপল্লীগুলিকে প্রহরা দেয়া যাদের সংস্কৃতি, অফিসের বসে ঘুষ খাওয়াই যাদের প্রশাসনিক রীতি  -তারা তো সুস্পষ্ট মুনাফিক। নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়াদরুদ যতই পালন করা হোক না কেন -সেগুলি মুনাফিকদের ঈমানদার বানাতে পারে? মুনাফিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুনাফিকি স্পষ্ট দেখা যায় ১৯৭১’য়ে। তখন তাদের দেখা গেছে ভারতীয় কাফেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে। কাফেরদের এজেন্ডা ও তাদের এজেন্ডা সেদিন একাকার হয়েছিল। ঈমানদারের এজেন্ডা কি কখনো এক মুহুর্তের জন্যও কাফিরদের এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয়? তেল ও পানি যেমন কখনোই একত্রে মেশে না, তেমনি মুসলিমের এজেন্ডা ও কাফেরদের এজেন্ডা কখনোই একীভূত হয়না। পবিত্র কুর’আন তো সেটিই শেখায়। কাফিরদের সাথে এরূপ একাত্মতা ঘটে একমাত্র মুনাফিকদের ক্ষেত্রে।