মুসলিমদের যেরূপে দেখতে চান আল্লাহ তায়ালা এবং বাঙালি মুসলিমের আমলনামা
- Update Time : ০৫:০১:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
- / ৫৩ Time View

ফিরোজ মাহবুব কামাল
মুসলিমদের যেরূপে দেখতে চান মহান আল্লাহ
ঈমানদার ব্যক্তিকে যে ভাবনা ও তাড়না নিয়ে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় তা হলো, মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রিয়তর হওয়ার ভাবনা ও তাড়না। মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন এজেন্ডা থাকতে পারে না। কারণ যে তার মহান রব’য়ের কাছে প্রিয়তর হয়, একমাত্র সেই জান্নাত পায়। সে সাথে তাকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় মহান রব’য়ের বিরাগ ভাজন হওয়া থেকে। কারণ যে তাঁর বিরাগ ভাজন হয় -সে নিশ্চিত জাহান্নামে যায়। তাই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে হলে ঈমানদারকে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করলে চলে না, তাকে অবশ্যই সঠিক ভাবে জানতে হয়, মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে কিরূপে দেখতে চান -সে বিষয়টি। কারণ, তাকে তাঁর রব’য়ের পছন্দ অনুসারেই গড়ে তুলতে হয়। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে তো একমাত্র সে ব্যক্তিই প্রিয়তর, যে ব্যক্তি একমাত্র সে ভাবেই বাঁচে -যে ভাবে বাঁচাটি তিনি পছন্দ করেন। তবে মুসলিমদের তিনি কিরূপে দেখতে চান -সেটি মহান রব কখনোই গোপন রাখেননি। সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে পবিত্র কুর’আনের নিচের আয়াতে:
ٱلْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌۭ فَأَصْلِحُوا۟ بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থ: “মুমিনগণ হলো পরস্পরে ভাই; অতঃপর নিজ ভাইদের মধ্য সমস্যা থাকলে তা সংশোধন করে নাও। এবং ভয় করো আল্লাহকে -যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হতে পারো।”

উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের পরিচয় ও পারস্পারিক বন্ধনের ভিত্তিটি অতি স্পষ্ট ভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, মুসলিমের কাঙ্খিত পরিচয়টি। সেটি হলো, মুসলিম বাঁচবে অপর মুসলিমের ভাই রূপে। তাই অপর মুসলিমের শত্রু হওয়ার অর্থ মহান রব’য়ের প্রত্যাশার বিরুদ্ধচারণ। মুসলিমকে শুধু অন্য মুসলিমের প্রতিবেশী, সহকর্মী, সহযাত্রী বা সহনাগরিক হলে চলে না, অবশ্যই সাচ্চা ভাইয়ের মত ভাই হতে হয়। ভাই হওয়ার অর্থ ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দ-সুখের ভাগিদার হওয়া। এবং ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট ও অভাব লাঘবে সর্বসামর্থ্য দিয়ে সচেষ্ট হওয়া। ঈমানদারের সে ভাতৃসুলভ দরদ ও সহমর্মিতার বর্ণনা দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহ তায়ালা; এবং সেটি নিচের আয়াতে:
وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌۭ ۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِۦ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُفْلِحُونَ
অর্থ: “এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের উপর তাদেরকে (অন্য মুসলিম ভাইদের অভাবকে) তারা অগ্রাধিকার দেয়। এবং যাদেরকে রক্ষা করা হয় মনের কার্পণ্য থেকে তারাই সফলকাম।” –(সুরা হাশর, আয়াত ৯।
ঈমানদারের ঈমানদারী তাই শুধু নামাজা-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের মধ্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয় না, পরীক্ষা করা কতটুকু অপর মুসলিমের হৃদয়বান দরদী ভাই রূপে বাঁচলো -তার মধ্য দিয়ে। গায়ের রং, দেহের গঠন বা মুখের ভাষা যাই হোক তা দিয়ে ভাইয়ের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় না। সে ভিন্নতাগুলিকে যদি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং সেগুলি যদি ভাতৃত্বের সম্পর্কে ফাটল ধরায়, তবে বুঝতে হবে বিশাল ব্যর্থতাটি এখানে ঈমানদার হওয়ায়। এবং ঈমানদার হতে যারা ব্যর্থ হয়, বস্তুত তারাই ব্যর্থ হয় অপর মুসলিমের সাথে ভাতৃত্বের পরিচয় গড়ে তুলতে। এবং এরাই হলো মুসলিম দেশে মুসলিমের মুখোশধারী বেঈমান। তাদের হাতে দেখা যায় গোত্রবাদী, বর্ণবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী, জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী সেক্যুলার রাজনীতির ঝাণ্ডা। তাদের দেখা যায় নির্মূলমুখী রাজনীতিতে। এরাই ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন এলাকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় ও গণধর্ষণে নামে। এগুলি তো শয়তানকে খুশি করা এবং শয়তানী এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার পথ। ১৯৭১’য়ে বিপুল সংখ্যক বাঙালির মাঝে সে বেঈমানীর রাজনীতি প্রবল ভাবে দেখা গেছে। তাদেরকে দেখা গেছে বিহারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও তাদের ঘরবাড়ী দখলে নেয়ার অপরাধে। ঈমানের পরীক্ষায় যারা এভাবে পাপের পাহাড় নিয়ে ফেল করে, তাদের কুর’আন তেলাওয়াত, নামাজ-রোজা, দোয়া-দরুদ ও হজ্জ-উমরাহ কি পরিত্রাণ দিতে পারে?
একতার পথটি ঈমানদারীর, বিভক্তির পথটি বেঈমানীর
মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর একতা চান। কারণ, একতার মধ্যেই তাদের কল্যাণ। তিনি চান তাঁর ঈমানদার বান্দাগণ এ পৃথিবী পৃষ্ঠে স্বাধীনতা, জান ও মালের নিরাপত্তা এবং ইজ্জত নিয়ে বাঁচুক। আর সে জন্য চাই শক্তিশালী রাষ্ট্র। বিভক্ত ও বিচ্ছন্ন মানুষদের সংখ্যা বহু শত কোটি হলেও তাদের দিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মিত হয়না। অথচ শক্তিশালী রাষ্ট্র ছাড়া কখনোই সুনিশ্চিত হয় না মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা। সেরূপ শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য জরুরি হলো মুসলিম ভাতৃত্বের মজবুত বন্ধন। সে ভাতৃত্বের বন্ধনটি কখনোই ভাষা, গোত্র বা বর্ণের ভিত্তিতে গড়ে উঠে না, বরং সেটি হতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার উপর অটল ঈমানের উপর। সে জন্য সবাইকে সম্মিলিত ভাবে ধরতে হয় মহান আল্লাহতায়ালা রশি কুর’আনকে। মহান রব’য়ের পক্ষ থেকে তাই হুকুম হলো:
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟
অর্থ: “আর তোমরা সবাই মিলে শক্তভাবে ধরো আল্লাহর রশি তথা কুর’আনকে এবং বিভক্তি গড়বে না।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১০৩)।
উপরিউক্ত আয়াত হলো একতাবদ্ধ উম্মাহ গড়ায় মহান রব’য়ের দেয়া প্রেসক্রিপশন। সে প্রেসক্রিপশন বিস্ময়কর সফলতা দেখিয়েছে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের যুগে। তখন আরব, ইরানী, কুর্দি, তুর্কি, হাবশী -এরূপ নানা পরিচয়ের মুসলিমগণ পরস্পরের ভাইয়ে পরিণত হয়েছে। আজও কি এর বিকল্প আছে? অন্য পথগুলি তো বর্ণ,গোত্র, ভাষা ও ভুগোল ভিত্তিক বিভক্তির ও হানাহানীর পথ। তাই ইসলামে সেগুলি নিষিদ্ধ পথ তথা জাহান্নামের পথ। আজ সে নিষিদ্ধ পথে চলে আরবগণ ২২ টুকরোয় বিভক্ত। এবং বাঙালি মুসলিমগণ পাকিস্তান ভেঙেছে।
উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দুটি ফরজ হুকুম এসেছে: একটি হুকুম হলো একতার ও অপরটি হলো বিভক্তি থেকে বাঁচার। মুসলিমকে তাই শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের হুকুম মানলে চলেনা, বাঁচতে হয় একতার হুকুম মেনে এবং সর্বদা বাঁচতে হয় বিভক্তি থেকে। নইলে ঈমান বাঁচে না। অথচ ইসলাম থেকে দূরে সরা সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে আল্লাহ তায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে। একতার বদলে তারা বেছে নিয়েছে বিভক্তির পথ। এ ভাবে তারা বিজয়ী করেছে বিদ্রোহ নিয়ে বাঁচার শয়তানী সূন্নতকে।
মহান আল্লাহ তায়ালা চান, ভাতৃত্বের বন্ধনের উপর নির্মিত হোক নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের নিয়ে শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র, ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ এবং বিশ্বজয়ী সভ্যতা এবং সে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পাক মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা। ইসলাম যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম সেটি তো এভাবেই বিশ্ববাসীর সামনে দৃশ্যমান হয়। ইসলামের গৌরব যুগে তো সেটিই দেখা গেছে। মুসলিমদের পতনের শুরু তখন থেকেই যখন তারা ভাতৃত্বের বদলে হানাহানী এবং একতার বদলে বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। এভাবেই মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে যেমন মহান রব’য়ের হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে, তেমনি দ্রুত নিচে নামায়। ফলে দেড় কোটি ইহুদীদের বিশ্বজুড়ে যে দাপট -তা ১৫০ কোটি মুসলিমদের নাই। ইসরাইলের ৬০ লাখ ইহুদীদের হাত থেকে নিরাপত্তা পেতে ৪০ কোটির বেশী আরববাসীর রাষ্ট্র প্রধানগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দ্বারে দ্বারে সাহায্য ভিক্ষা করছে। কারণ, ইহুদীরা একতাবদ্ধ, কিন্তু আরব মুসলিমগণ বিভক্ত এবং হানাহানীতে লিপ্ত।
১৯৭১’য়ে জাতীয়তাবাদী বাঙালিরা পাকিস্তান ভেঙেছে। এবং ১৯১৭ সালে জাতীয়তাবাদী আরবগণ ভেঙেছে খেলাফতকে। এরূপ ভাঙাতেই তাদের আনন্দ ও গৌরব। অথচ প্রতিটি বিভক্তিই মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুম ও এজেন্ডার সাথে বেঈমানী এবং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতা। আর সে নাশকতা নিয়েই সেক্যুলার বাঙালিদের উৎসব। এটি তো শয়তান ও তার পৌত্তলিক খলিফাদের খুশি করার উৎসব। আর শয়তানকে খুশি করার উৎসব পরিণত হয়েছে সেক্যুলারিস্ট বাঙালিদের সংস্কৃতিতে। সেটি দেখা যায় বছর ঘুরে প্রতি বছর ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর এলে।
প্রকৃত মুসলিম ও মুখোশধারী মুসলিম
মুসলিম হওয়ার অর্থ পূর্ণ মুসলিম হওয়া। ইসলামে আধা বা অপূর্ণাঙ্গ মুসলিমের কোন স্থান নাই। তেমনি স্থান নাই জাতীয়তাবাদী মুসলিম, সেক্যুলার মুসলিম বা কম্যুনিস্ট মুসলিমের। বস্তুত পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার ব্যর্থতাই হলো প্রকৃত মুসলিম হওয়ার ব্যর্থতা। পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায় বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতাটি বিশাল এবং অতি করুন। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু বেশি বেশি মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ নয়। শুধু নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাত পালনও নয়। বরং মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সেনাদলের সৈনিক হওয়া এবং মহান রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার যুদ্ধে সীসাঢালা দেয়ালসম একতা নিয়ে খাড়া হওয়া। ইসলামের সে পথটিতে যেমন জিহাদ আসে, তেমনি শাহাদতও আসে। পবিত্র কুর’আনে বার বার সে পথের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া সে পথে বাঁচাটি শিখিয়ে গেছেন খোদ নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। অর্ধেকের বেশী সাহাবা সে পথে শহীদ হয়েছেন। ঈমানদারকে তাই পদে পদে তার নিজের পথটি মিলিয়ে দেখতে হয় নবীজী (সা:)’র পথের সাথে। আল্লাহ তায়ালার কাছে হিসাব দেয়ার আগে এভাবেই নিজের হিসাবটি নিজে নিতে হয়। মহান রব’য়ের সেনাদলের সৈনিক হতে এবং যুদ্ধ নিয়ে বাঁচতে যে ব্যক্তি ব্যর্থ হয়েছে -বুঝতে হবে সে ব্যর্থ হয়েছে প্রকৃত মুসলিম হতে। তার মুসলিম পরিচয়টি মুখোশ মাত্র। সে মুখোশ পড়ে অন্যদের ধোকা দেয়া যায়; কিন্তু তা দিয়ে কখনো নিজেকে বাঁচানো যায়না।
প্রকৃত ঈমানদারের জীবন তাই শুধু কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে এসে থেমে থাকে না। সে পথ ধরে তার জীবন আরো বহুদূর সামনে এগুয়। সে জীবনে থাকে ইসলামের পক্ষে দাওয়াত, বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও জিহাদ। এমন ব্যক্তি প্রতিক্ষণ জিহাদের রণাঙ্গণ খোঁজে এবং সমগ্র সামর্থ্য নিয়ে সে জিহাদে যোগ দেয়। কোথাও জিহাদ শুরু না হলে, সে জিহাদের প্রস্তুতি নেয়। জিহাদ অথবা জিহাদের প্রস্তুতি -এ দুটি পর্ব নিয়েই মুমিনের জীবন। যাদের জীবনে জিহাদে নাই এবং জিহাদে যোগ দেয়ার তাড়নাও নাই -বুঝতে হবে সে নির্ভেজাল মুনাফিক। নবীজী (সা:)’র প্রসিদ্ধ হাদীস: “যে ব্যক্তি কখনো জিহাদ করেনি এবং জিহাদে নিয়তও রাখে না -সে ব্যক্তি মুনাফিক।”-(মুসলিম শরীফ)। নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ আদায় করে এবং রোজা রেখেও আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাই মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচেনি।
বাঙালি মুসলিম জীবনে জাহিলিয়াত ও প্যান ইসলামী চেতনা
অপরাধ শুধু নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকা নয়, বরং গুরুতর অপরাধ হলো, আল্লাহ তায়ালার সেনাদলে যোগ না দেয়া অথবা সে দলে বিভক্তি গড়া। এমন ভূমিকায় খুশি হয় শয়তান এবং বিজয়ী হয় শয়তানের এজেন্ডা। তাই মুসলিম উম্মাহর ভাতৃত্বের বন্ধনে ফাটল ধরানোর যে কোন প্রচেষ্টাই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তথা কুফুরি। মুসলিম দেশে ভাতৃত্বের সে বন্ধনটি বিলুপ্ত করে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, দলবাদ ও শ্রেণীবাদের ন্যায় হারাম মতবাদগুলি। তাই মূর্তিপূজা, মদ, জুয়া শুকরের গোশত যেরূপ হারাম, তেমনি হারাম হলো এ মতবাদগুলি। এজন্যই মুসলিম যেমন মূর্তিপূজারী হতে পারেনা, তেমনি হতে পারেনা জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী ও বর্ণবাদী। মুসলিম উম্মাহর পতনের শুরু তো তখন থেকেই যখন থেকে তারা ইসলাম ছেড়ে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ ও বর্ণবাদের স্রোতে ভাসা শুরু করেছে। এবং ১৯৭১’য়ে সে হারাম মতবাদগুলির স্রোতে ভাসায় বাঙালি মুসলিমগণ ইতিহাস গড়ছে। ভাসতে ভাসতে তারা ভারতীয় পৌত্তলিকদের কোলে গিয়ে উঠেছে। এবং পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে কোয়ালিশন গড়ে যুদ্ধ করেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এবং সে দেশটি ভেঙে পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে মিলে উৎসব করেছে। বাঙালি মুসলিমের জীবনে এমন কদর্য ইতিহাস অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। অথচ ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছিল নিজ দেশে প্যান ইসলামী চেতনার বিজয় এনে। তারা ভাতৃত্বের বন্ধন গড়েছিল পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, বিহারী, গুজরাতী ইত্যাদি নানা পরিচয়ের মুসলিমদের সাথে। বাঙালি মুসলিম ইতিহাসে সেটি ছিল অতি বড় মাপের নেক কর্ম।
বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলাম দারুন পরাজিত। এদেশে শরিয়ত বিলুপ্ত। সংবিধানে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের কোন স্থান নাই। শিক্ষা ব্যবস্থায় নাই কুর’আন শিক্ষা। দেহব্যবসা, সূদী কারবার, মদ-জুয়া -এসবই দেশটিতে আইন সিদ্ধ। এদেশে অবাঙালি বিহারীদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে বস্তিতে থাকতে বাধ্য করা হয়। এদেশে বিশাল বিজয়টি শয়তানের খলিফাদের। ইসলাম বন্দী হয়েছে কিতাবে ও মসজিদ-মাদ্রাসায়। এদেশে মসজিদ-মাদ্রাসার বিশাল সংখ্যা নিয়ে গর্ব করা হয়; কিন্তু ক্ষোভ নাই ইসলামের এ পরাজয়ে। তবে এ মুসলিম দেশে শয়তানের এ বিশাল বিজয়টি মূর্তিপূজারী কাফিরগণ আনেনি। বরং এনেছে সেসব বাঙালি যাদের মুখোশটি মুসলিমের। নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও তাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধটি ইসলামকে পরাজিত রাখায়। তারা যুদ্ধ করে জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী, বামপন্থী ও সেক্যুলারিজমের পতাকা নিয়ে। একাত্তরে পৌত্তলিক ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং ভারতী সেনাবাহিনী সাথে কোয়ালিশ করে তারাই বিজয়ী হয়েছিল। এখনও ব্যস্ত একাত্তরের অর্জিত সে বিজয়কে ধরে রাখায়।
বিহারী মুসলিমদের দুর্ভোগ ও বাঙালি মুসলিমের অপরাধের শো’কেস
মুসলিমকে বাঁচতে হয় অপর মুসলিমের প্রতি ভাতৃসুলভ গভীর ভালবাসা নিয়ে। কারণ, প্রতিটি মুসলিমই হলো একই যুদ্ধে অপর মুসলিমের সহযোদ্ধা। মু’মিনের মাঝে তাঁর ঈমান ও ভাতৃত্ববোধ একত্রে উঠানামা করে। মু’মিনের ঈমান বাড়লে, তার মাঝে ভাতৃত্ববোধও বাড়ে। তেমনি ঈমান বিলুপ্ত হলে বিলুপ্ত হয় সে ভাতৃত্ববোধ। তখন অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মুসলিমগণ মুসলিমের মুখোশধারী বেঈমানদের কাছে হত্যাযোগ্য ও ধর্ষণযোগ্য মনে হয়। বাঙালি মুসলিম জীবনে সে কদর্য চিত্রটি দারুন চিত্রটি দেখা গেছে একাত্তরে। শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান বেঁচে থাকলে কেউ কি বিহারী মুসলিমদের ঘরবাড়ী, সহায়-সম্পদ ও দোকানপাট কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বস্তিতে পাঠাতো? তারা কি বিহারী মুসলিমদের হত্যায় ও বিহারী নারীদের উপর ধর্ষণে নামতো? বেঈমানীর লক্ষণ শুধু নামাজশূন্য বা ইবাদতশূন্য হওয়া নয়, বরং অপর মুসলিমের প্রতি ভাতৃত্ববোধ না থাকাটিও।
বিহারীদের দুর্ভাগ্য যে, তাদের বসবাস পশ্চিম পাকিস্তানে না হয়ে উগ্র বাঙালি ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ ও সেক্যুলারিজমে আক্রান্ত পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল। ভারত থেকে যে বহু লক্ষ ভারতীয় মুসলিম পশ্চিম পাকিস্তানে হিজরত করেছিল তাদের জীবনে এরূপ দুর্যোগ ও বিপর্যয় আসেনি -যেরূপ এসেছে বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারীদের জীবনে। কারণ, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সেক্যুলারিজম পশ্চিম পাকিস্তানীদের এতোটা নৃশংস ও বর্বর করেনি -যতটা বর্বরতা একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে দেখা গেছে। এর সাম্প্রতিক প্রমাণ, পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পরও প্রায় ২০ লাখ বাঙালি মুসলিম বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের করাচিতে গিয়ে বসবাস করছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভাঙার পর ৪ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল। তারা সেখানে চাকুরি সূত্রে ছিল। তাদেরকে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছিল।
ঈমানদারের জীবনে নানা ভাবে পরীক্ষা আসে। পরীক্ষা হয়, সে কতটুকু নিজেকে বাঁচালো চুরি-ডাকাতি, মিথ্যাচারীতা ও প্রতারণামূলক দুর্বৃত্তি থেকে। এবং পরীক্ষা হয়, সে কতটা সদয় হলো এবং ভাতৃত্ব দেখালো ভিন্ ভাষা, ভিন্ ভূগোল ও ভিন্ বর্ণের প্রতিবেশি মুসলিমদের প্রতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঈমানের এ পরীক্ষায় একাত্তরে কতটুকু পাস করেছে বাঙালি মুসলিমগণ? অমুসলিম দেশে একজন নাগরিকের যে অধিকার থাকে সে অধিকারটুকুও আজ দেয়া হচ্ছে না বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারী মুসলিমদের। বিলেতে যে কোন বিদেশী ব্যক্তি আইনসঙ্গত ভাবে ৫ বছর বসবাস করলে সে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পায়। নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া সে ব্যক্তির সাথে ব্রিটেনে জন্ম নেয়া কোন শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ যদি বৈষম্য মূলক আচরণ (racial discrimination) করে তবে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ গণ্য হয়। অথচ বিহারীদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নাই; নাই কোন আশার আলো। তারা বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশে অর্ধ শতাব্দীর বেশি কাল বসবাসের পরও বঞ্চিত রাখা হচ্ছে শিক্ষার ন্যায় মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে। কিছু বিহারীকে নাগরিকত্ব দেয়া হলেও তাদের চাকুরিতে নেয়া হয়না। এমন কি পাসপোর্টও দেয়া হয়না। ফলে তাদেরকে সুযোগ দেয়া হয় না জীবিকার সন্ধানে বিদেশে যাওয়ার। এরূপ বৈষম্য তো আন্তর্জাতিক আইনে গুরুতর অপরাধ। এবং কবিরা গুনাহ শরিয়া আইনে। অথচ তা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসনিনক কর্মকর্তাদের কোন ভ্রক্ষেপ নাই। এ সংকটের যে সমাধান প্রয়োজন, সে ভাবনাও তাদের নাই।
দেশে মসজিদ-মাদ্রাসার বিপুল সংখ্যা বা ঘরের পাশে মসজিদ দেখে কি মানুষের ঈমান বুঝা যায়? ঈমান কি শুধু নামাজ-রোজায় ধরা পড়ে? বহু সূদখোর, ঘুষখোর, প্রতারকও তো নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করে। বরং ঈমান দেখা যায় অপর মুসলিমের প্রতি মানবিক ও ভাতৃত্বসুলভ আচরণ দেখে। ঈমানের সেটিই তো দৃশ্যমান রূপ। কিন্তু বিহারীদের প্রতি বাঙালি মুসলিমের সে ঈমানদারী কোথায়? কোথায় সে ভাতৃত্ববোধ? চোখের সামনের আল্লাহর ঘর ক্বাবা দেখেও তো আরবের লোকেরা মূর্তিপূজারী কাফির হয়েছে। ফলে ঘরের পাশে মসজিদ বা মাদ্রাসা থাকলেই ঈমানদার হবে -সে নিশ্চয়তা কোথায়? মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, হাসিনা -কত জনই তো ক্ষমতায় এলো। কিন্তু এই হতভাগা বিহারীদের প্রতি তাদের কেউ সামান্যতম মানবিক আচরণ করিনি।
বিহারীদের অপরাধ, একাত্তরে তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমর্থণ করেছিল। কথা হলো, সেরূপ সমর্থণ তো লক্ষ লক্ষ বাঙালিরাও করেছিল। সে বাঙালিদের ঘরবাড়ী কি কেড়ে নেয়া হয়েছে। বৈষম্য কি শুধু বিহারী হওয়ার জন্য? তাছাড়া ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানকে বানিয়েছিল তো বাঙালি মুসলিমরাই। পাকিস্তানের নির্মাণ যদি দোষের না হয়, তবে দেশটি বাঁচানোর পক্ষে থাকা দোষের হবে কেন? একাত্তরের যুদ্ধ ৫৪ বছর পূর্বে শেষ হওয়ার পরও তাদের সাথে এরূপ নির্যাতন মূলক আচরন নিরেট যুদ্ধাপরাধ। পরিতাপের বিষয় হলো অসহায় বিহারীগণ বিগত ৫৪ বছর যাবত সে যুদ্ধাপরাধের শিকার। এবং বাংলাদেশের বুকে এ বিহারী বস্তিগুলি এটিই সাক্ষ্য দেয়, বাঙালি মুসলিমগণ নিদারুন ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহর দেয়া মুসলিম ভাতৃত্বের পরিচয় নিয়ে বাঁচতে। এ বিহারী বস্তিগুলি বস্তুত বাঙালি মুসলিমের ঈমানী দৈন্যতা ও গুরুতর অপরাধের শো’কেস।



























