মুজিব, জিয়া ও ভাসানীর অপরাধনামা
- Update Time : ০৪:৩৭:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ২১২ Time View

ফিরোজ মাহবুব কামাল
মুজিবের অপরাধনামা
বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধী ব্যক্তি হলো শেখ মুজিব। মীর জাফরের পর বাংলার ইতিহাসে এতো বড় অপরাধী আর কখনোই জন্ম নেয়নি। শেখ মুজিব এক দিকে যেমন ছিল ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী, ক্ষমতালোভী ও ভারতের সেবাদাস, তেমনি ছিল আদ্যপান্ত মিথ্যুবাদী। মুজিবের মিথ্যার নমুনা, পূর্ব পাকিস্তান বলতো পাকিস্তানসৃষ্ট একটি শ্মশান। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ মুজিব “পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন” এ প্রশ্ন রেখে লক্ষ লক্ষ পোস্টার ছেপে সারা দেশের হাটে বাজারে ও রাস্তাঘাটে এঁটে দিয়েছিল। এ পোস্টার ছিল মিথ্যায় পরিপূর্ণ। উক্ত পোস্টারে দাবী করা হয়, চাউল, আটা, চিনি, ডাল, তেল, কাগজ ইত্যাদি সকল প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিগুণ। দাবী করা হয়, মূল্যের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য নাকি পাকিস্তানের সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত। অথচ এটি ছিল ডাহা মিথ্যা।
উম্মাহর বিভক্তি হারাম; তাই খেলাফত ভেঙে ২২টি আরব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে হারাম পথে। একই রূপ হারাম পথে পাকিস্তান ভেঙে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। মুসলিম নামধারী বাঙালি ফ্যাসিস্টগণ ভারতীয় পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাশকতা ঘটিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙতে। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো সব চেয়ে বড় অপরাধ। বাংলাদেশে হয়তো ভবিষ্যতে বহু কিছুই নির্মিত হবে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলিমের ১৯৭১’য়ের অপরাধ নিয়ে হাজার বছর পরও বিশ্বের কোনে কোনে বিচার বসবে। সেদিন বাঙালি মুসলিমদের বিচারের কাটগড়ায় উঠানো হবে। তখন ঘৃণার ধিক্কার ধ্বনিত হবে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতার নায়ক একাত্তরের বাঙালি মীর জাফরদের বিরুদ্ধে। সেদিন ধিক্কার কুড়াবে মুজিব, জিয়া, তাজুদ্দীন ও ওসমানীর ন্যায় নাশকতার নায়কগণ। মুসলিম উম্মাহর সে আদালতে বিচারক রূপে কোন জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদী সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার নাস্তিকদের স্থান থাকবে না। সে আদালতের বিচারক হবেন ঈমানদারগণ। তাদের রায়ে একাত্তরের এই ভারতসেবীরা ঘৃণ্য অপরাধী রূপে গণ্য হবে। তবে এ অপরাধীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ানক রায়টি অপেক্ষা করছে রোজহাশরের বিচার দিনে। বিদ্রোহের দায় নিয়ে সেদিন তাদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
https://www.facebook.com/obaidul1991
মুজিবের মিথ্যা বয়ানের রাজনীতি
শেখ মুজিব ও তার অনুসারীদের দাবী, পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী। এ দাবী ভিত্তিহীন। কলোনীর বাসিন্দারা কখনোই প্রভু দেশের শাসন ক্ষমতায় বসার সুযোগ পায়না, সব সময় গোলামই থাকতে হয়। বাংলার শিশুরাও সেটি বুঝে। সুবে বাংলা ১৯০ বছর ব্রিটিশের কলোনী ছিল। একজন বাঙালিও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ দূরে থাক, কোন ক্ষুদ্র মন্ত্রীও হতে পারিনি। অথচ পূর্ব পাকিস্তান কলোনী হলে পাকিস্তানের দুইজন রাষ্ট্রপ্রধান বাঙালি হলো কি করে? সে দু’জন হলেন ঢাকার খাজা নাজিমুদ্দীন এবং মুর্শিবাদের জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। চার জন প্রধানমন্ত্রী হলেন কিরূপে? তারা হলেন খাজা নাজিুদ্দীন, বগুড়ার মহম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং নুরুল আমীন। জাতীয় পরিষদ তথা পার্লামেন্টের স্পীকার হয়েছেন মৌলভী তমিজউদ্দীন খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আব্দুল জব্বার খান। পররাষ্ট্র মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদেও অনেক পূর্ব পাকিস্তানী বসেছেন। লক্ষ্যণীয় হলো, এ ইতিহাস বাংলাদেশের পাঠ্য বইয়ে পড়ানো হয়। বরং পূর্ব পাকিস্তানকে পেশ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী রূপে। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাঙালিগণ কখনোই নিজ শাসন করার সুযোগ পায়নি; শাসন করেছে অববাঙালি সুলতান ও মোগলরা।
জিয়ার অপরাধনামা
মুজিবের ন্যায় জিয়াউর রহমানের অপরাধের তালিকাটিও বিশাল। জিয়ার সবচেয়ে অপরাধটি হলো, ১৯৭১’য়ে সেই সর্বপ্রথম পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। সেট ছিল শরীয়তবিরোধী এক হারাম ঘোষণা। মুসলিম দেশ ভাঙা সব সময়ই হারাম, সেটি হারাম ছিল একাত্তরেও। শরীয়তের আইনে এরূপ ঘোষণার শাস্তি গুরুতর। এমনকি শেখ মুজিবও এরূপ হারাম ঘোষণা দিতে সাহস করেনি। অথচ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য রূপে মেজর জিয়া অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করার জন্য কুর’আনের কসম খেয়েছিল। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল সে কসমের সাথে বেঈমানী। এরূপ কসম ভাঙা ইসলামে কবিরা গুনাহ -যা জাহান্নামে নেয়।
জেনারেল জিয়ার দ্বিতীয় অপরাধ, জাতীয়তাবাদী পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’য়ের গঠন। বর্ণবাদ ও গোত্রবাদের ন্যায় জাতীয়তাবাদও ইসলামে হারাম। ইসলামী পরিভাষায় এটি আসাবিয়াত -যা শরিয়তে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি যেমন মূর্তিপূজারী হতে পারেনা, তেমনি বর্ণবাদী, গোত্রবাদী ও জাতীয়তাবাদীও হতে পারে না। এ হারাম রাজনীতির লড়াইটি মূলত মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে লড়াই। সকল মানব সন্তানের জন্ম হযরত আদম ও বিবি হাওয়া থেকে; বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের মাঝে বিভক্তি গড়া মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আদৌ কাম্য নয়। তিনি চান, মুসলিমদের মাঝে থাকবে ভাতৃত্বের বন্ধন। অথচ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির লক্ষ্য, প্যান-ইসলামী চেতনার বিনাশ। এবং ব্যর্থ করে নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াই। এ রাজনীতি ভিন্ন ভাষী, ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন এলাকার মানুষদের ঘৃণা করতে শেখায়। এবং জন্ম দেয় ফেতনা ও বিভক্তির । মুসলিম উম্মাহ আজ যেরূপ ৫০টির বেশী টুকরোয় বিভক্ত -তার মূল কারণ তো এই জাতীয়তাবাদী ও গোত্রবাদী রাজনীতি। এ রাজনীতির নাশকতা যেহেতু গুরুতর, ফলে শরিয়তী আইনে শাস্তিও অতি কঠোর। মুজিবের ন্যায় জিয়াও এই সংক্রামক রাজনীতির প্রচারক। তারা উভয়ই তাই গুরুতর অপরাধী।
জেনারেল জিয়ার তৃতীয় অপরাধটি গুরুতর যুদ্ধ অপরাধের। মেজর জিয়া হত্যা করে চট্টগ্রাম সেনানীবাসে তার উর্দ্ধতন কমাণ্ডিং অফিসার নিরস্ত্র কর্নেল জানজুয়াকে। কোন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে -সে যে বাহিনীরই হোক, তাকে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধাপরাধের সে শাস্তি থেকে জিয়া এ দুনিয়ায় বাঁচলেও আখেরাতে কি বাঁচবে? জেনারেল জিয়ার চতুর্থ অপরাধ, একাত্তরে সে ভারতের কোলে গিয়ে উঠেছিল এবং ভারতের আশ্রয়, পানাহার ও অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান ভাঙতে যুদ্ধ করেছিল। কোন ঈমানদার কি কখনো কোন কাফিরের গৃহে আশ্রয় নেয়? বন্ধুত্ব করে কি কাফিরদের সাথে? যুদ্ধ করে কি কোন কাফির শক্তির পার্শ্বচর রূপে মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে? পবিত্র কুর’আনে কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে নিচের আয়াতে:
لَّا يَتَّخِذِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْكَـٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ ٱللَّهِ فِى شَىْءٍ إِلَّآ
অর্থ: “মুমিনগণ যেন মুমিনদের ছাড়া কখনো কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে; যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নাই।” –( সুরা আল ইমরান, আয়াত ২৮)।
মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এটি এক গুরুতর হুশিয়ারি। উপরিউক্ত আয়াতের মূল কথা: বন্ধুত্ব কখনোই একই সাথে কাফিরদের সাথে ও মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে করা যায়না। যারা কাফিরদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করবে, তারা কখনোই বন্ধু রূপে পাবে না আল্লাহ তায়ালাকে। তাই মুজিব ও জিয়া এবং তাদের অনুসারীরা একাত্তরে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের কোলে গিয়ে উঠার মধ্য দিয়ে তারা ছিন্ন করেছিল মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক। এবং যাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয় আল্লাহতায়ালার সাথে তারা কি কখনোই মুসলিম হতে পারে? কোন মুসলিম কি এমন ব্যক্তিদের নেতা রূপে গ্রহণ করতে পারে? তারা তো ভারতীয় কাফিরদের লোক। তারা যদি মুসলিম রূপে দাবী করে, তবে বুঝতে হবে তারা মুনাফিক।
জেনারেল জিয়ার পঞ্চম অপরাধটি ছিল মজলুল অবাঙালিদের বিরুদ্ধে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েই যেন বিহারীরা ভূল করেছিল। যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল – সেরূপ বিপদে তাদের পড়তে হয়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পর বিহারীদের ঘরবাড়ী ও দোকান-পাট কেড়ে নিয়ে বস্তিতে পাঠানো হয়েছিল। এটি ছিল গুরুতর অপরাধ। অথচ জিয়া এ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সে দুর্বৃত্তদের হাতে দখলকৃত ঘরবাড়ী ও দোকান পাঠের মালিকানার দলিল তুলে দিয়েছিল। অপরাধ সবসময়ই অপরাধ। কিন্তু বিহারীদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধকে জিয়া বৈধতা দিয়েছিল। বিহারীদের নিদারুন দুঃখকষ্ট জিয়ার বিবেককে স্পর্শ করেনি।
জিয়ার পঞ্চম অপরাধটি হলো, তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন ১৯৭৫ সালের বিপ্লবের মূল স্পীরিটকে। বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বহুমুখী নাশকতা ছিল। সেটি যেমন ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ, গণহত্যা, গণতন্ত্র হত্যা ও সীমাহীন দুর্বৃত্তি, তেমনি চুরিডাকাতি ও লুটতরাজ। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ শুধু বিহারীদের ঘরবাড়ী ও সম্পদের ডাকাতি করেনি, ডাকাতি করেছে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নিজামে ইসলামীর ন্যায় পাকিস্তানপন্থী দলগুলির নেতাকর্মীদের সম্পদের উপর। চুরিডাকাতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ রাতারাতি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, মহম্মদপুর, মীরপুরসহ সমগ্র বাংলাদেশে বড় বড় বাড়ী, দোকানপাট ও কলকারখানার মালিক হয়ে যায়। তারা যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের সবার জন্য রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা হয়; নেতাদের কারাবন্দী করা হয়। বহু নেতাকর্মীকে নির্মম ভাবে হত্যাও করা হয়। ১৯৭৫’য়ের আগস্ট বিপ্লবের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের এসব অপরাধের তদন্ত ও তদন্ত শেষে বিচার করতে পারতেন। কিন্তু জিয়া কোন তদন্তই করেননি। কাউকে বিচারের সামনে খাড়া করেননি। এগুলি হলো জিয়ার গুরুতর অপরাধ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিপ্লব এবং ফ্যাসিস্ট মুজিবের হত্যা ছিল বাঙালি মুসলিমদের জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৪৭’য়ের ১৪ আগস্ট। মুজিবী শাসনের অবসান সুযোগ এনে দেয় আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তি ও দুঃশাসন থেকে দেশকে বাঁচানোর। সুযোগ আসে ভারতের অধিকৃতি থেকে বাঁচার। সুযোগ আসে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কবর দেয়ার। কিন্তু জেনারেল জিয়ার কাছে ১৯৭৫’য়ে অর্জিত স্বাধীনতা গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পায়নি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কবর দেয়াটিও। বরং যারা সেদিন সে স্বাধীনতা এনেছিল, সে সাহসী বীর সৈনিকদের পাঠিয়ে দেয়া হয় বিদেশে। বিপ্লবের সে ফসলকে জিয়া নিজ হাতে তুলে নেয়। অবশেষে জিয়ার দল বিএনপিই পুনর্জীবিত করে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে। অথচ দুনিয়ার নীতি হলো, যে দল একবার ফ্যাসিবাদের পথ বেছে নেয় সে দল আর কখনোই কোন সভ্য দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বৈধতা পায় না। তাই জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে কবরে পাঠালো, মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিল, হত্যা করলো হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে -সে আওয়ামী লীগ বৈধতা পায় কি করে? সে সাপ একবার ছোবল দিয়ে মানব হত্যা করেছে -সে সাপকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায়? গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে তো গণতন্ত্রের শত্রুদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হয়। অথচ জেনারেল জিয়া সেটি করেননি; বরং যে আওয়ামী লীগকে শেখ মুজিব কবরে পাঠিয়েছিল তাকে আবার জীবিত করেন। বহু আওয়ামী দুর্বৃত্তদের নিজ দলে স্থান দিলেন।
জিয়া ও তার অনুসারীদের কাছে গর্বের কারণ ১৯৭৫’য়ের দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়; কারণ সে স্বাধীনতার লড়াইয়ে জিয়ার কোন ভূমিকা ছিলনা। জিয়ার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের ঘোষণা। এমন কি জিয়ার কাছে গুরুত্ব পায়নি খালিদ মোশাররফের বিরুদ্ধে সেপাহী-জনতার বিদ্রোহ। সেপাহী জনতা খালেদ মোশাররফকে ভারতের চর রূপে সনাক্ত করেছিল, তাই তারা মেনে নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু ভারতে খুশি করতে জনগণের এ ভারত বিরোধী চেতনাকে জিয়া গুরুত্ব দেয়নি।
ভাসানীর অপরাধনামা
বাঙালি মুসলিমের রাজনীতিতে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাশকতাও কি কম? তার রাজনীতি শুরু হয় কংগ্রেসের রাজনীতি দিয়ে। ১৯৩৭ সালে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সালে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি আসাম ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন; কিন্তু মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে তার সম্পর্ক কখনোই মধুর হয়নি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মুসলিম লীগের রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা দেন। তিনি দলটির পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শাখার সভাপতি হন। ভাসানীর অপরাধ, পাকিস্তানের ঘোরতর দুশমন কম্যুনিস্টদেরকে তিনি দলে জায়গা করে দেন। অথচ এই কম্যুনিস্টগণ ছিল শুরু থেকেই পাকিস্তানের ঘরের শত্রু। তারা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন চায়নি, তেমনি পাকিস্তান বেঁচে থাকুক সেটিও চায়না। এই কম্যুনিস্টগণই ১৯৫২’য়ের ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তান ভাঙার কাজে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। তখন থেকেই ভাসানীর রাজনীতিতে শুরু হয় কম্যুনিস্টদের প্রভাব। শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার নিজের নাশকতার রাজনীতি।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই মুজিবকে তার রাজনৈতিক কর্মী রূপে রিক্রুট করলেও তাকে তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ দেননি। কারণ সোহরাওয়ার্দী মুজিবকে রাজনৈতিক গুণ্ডার চেয়ে বেশী কিছু মনে করতেন না। ফলে তাকে সে ভাবেই কলকাতার রাস্তায় কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু ভাসানী মুজিবকে উপরে টেনে তুলেন; আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্তি দেন। সে সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের সামছুল হক। প্রশ্ন হলো, মুজিবের ন্যায় একজন জঙ্গলি ফ্যাসিস্টকে প্রতিপালন দেয়া কি কম অপরাধ?
মাওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে ৬-১০ ফেব্রেয়ারীতে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে এক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সে জনসভায় তিনি আত্মঘাতি বয়ান রাখেন নিজ দলীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে তিনি শুধু ধমক দিয়েই ছাড়েননি, পশ্চিম পাকিস্তানকে আস সালামু আলাইকুম জানিয়ে দেন। ঐ সম্মেলনে তোরণ বানানো হয়েছিল গান্ধি, সুভাষ বসুর নামে ভারতীয় নেতাদের নামে। ভাসানীর ভক্তরা বলেন, এটিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা। এবং ঘোষণাকে দলিল বানিয়ে তারা মুজিবের বদলে ভাসানীকে জাতির পিতা বলে।
বহু বছরের চেষ্টার পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে গৃহীত হয় প্রথম শাসনতন্ত্র। পাকিস্তানের নাম রাখা হয় Islamic Republic of Pakistan। কিন্তু মাওলানা ভাসানীর কাছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র কথাটি ভাল লাগেনি। ভাসানী তার প্রতিবাদ জানান। যেখানেই ইসলাম, সেখানেই কম্যুনিস্টদের আপত্তি। ভাসানী তার দলের কম্যুনিস্টদের সে অভিপ্রায়টিই প্রকাশ করেছেন তার বিবৃতির মাত্র। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৬’য়ের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানের সকল মজহাবের উলামাদের দেয়া ২২ দফা সুপারিশকে মেনে নেয়া হয়। উল্লেখ্য, ভাসানী তার নামের আগে মাওলানা লাগালেও তিনি কখনোই ইসলামকে বিজয়ী করার পক্ষে অবস্থান নেননি। তার কেবলা ছিল চীনমুখী।
ভাসানীর রাজনীতিতে আদৌ কোন স্থিরতা ছিল না। কখনো বা তিনি কংগ্রেস করেছেন, কখনো বা মুসলিম লীগ করেছেন, আবার কখনো বা চীনপন্থী মাওবাদী হয়েছেন। কখনো বা তিনি স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরোধী সেজেছেন, আবার কখনো বা আইয়ুবের পক্ষ নিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে। তখন প্রেসিডেন্ট পদে আইয়ুবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কায়েদে আজমের বোন ফাতেমা জিন্নাহ। তখন পাকিস্তানের সকল বিরোধী দল তাকে সমর্থন দিয়েছিল। অথচ ভাসানী আইয়ুবের পক্ষ নিয়েছিলেন। এর কারণ, তার রাজনৈতিক গুরু মাও সে তুং তাকে নসিহত করেছিলেন, আইয়ুবের শাসনকে যেন অস্থির করা নায়। সে কথাটি মাও সে তুং তাকে বলেছিলেন ১৯৬৩ সালে -যখন তিনি চীন সফরে যান। ভাসানী মাও সে তুং’য়ের সে কথার উদ্ধৃতি দেন লন্ডনের তৎকালীন বামপন্থী ছাত্র নেতা তারিক আলীর কাছে। ভাসানীর সাক্ষাতকার নিতে জনাব তারিক আলী ঢাকায় গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন। (সূত্র: Tarek Ali, Can Pakistan Survive?)।
১৯৬৪ সালে নির্বাচন কালে মাওলানা ভাসানী প্রেসডিন্ট আইয়ুব খান থেকেও অর্থ নিয়েছিলেন। সে অর্থ নেয়ার কথাটি তিনি তার নিজ দল ন্যাপের পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা মাহমুদ আলী কাসুরীর কাছে স্বীকার করেছিলেন। আইয়ুব থেকে অর্থ নেয়ার কথাটি প্রকাশ পাওয়ায় জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী অত্যন্ত বিচলিত হন। তিনি বিষয়টি সরাসরি ভাসানী থেকে জানার জন্য লাহোর থেকে টাঙ্গাইল গিয়ে ভাসানীর গ্রামের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। মাহমুদ আলী কাসুরী তাঁর বইতে লিখেছেন. ভাসানীকে আইয়ুব খান থেকে অর্থপ্রাপ্তির কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, “কুছ দেয়া থা, লেকেন বাচ্চে লোক খা গিয়া।” অর্থ: “কিছু দিয়েছিল, কিন্তু ছেলে পেলেরা খেয়ে ফেলেছে।” (সূত্র: পাকিস্তানী সাংবাদিক হামিদ মীর, টিভি টক শো “ক্যাপিটাল টক”)।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে শান্তিপূর্ণ ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে ১৯৬৯ সালে। তখন চলছিল আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন। আইয়ুব খান গোল টেবিল বৈঠকে রাজী হন। তিনি রাজী হন পার্লামেন্টারী প্রথায় ফিরে যেতে। কিন্তু ভাসানী ভূট্টোর সাথে জোট বেঁধে সে বেঠক বর্জন করেন। এবং জ্বালাও পোড়াও’য়ের আন্দোলন শুরু করেন। এতে তিনি “লাল মাওলানা” নামে পরিচিতি পান। এভাবে দলের যুবকদের তিনি তখন থেকে সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দেন। এরাই পরবর্তীতে সিরাজ সিদকারের সর্বহারা পার্টি, হক-তোহা-দেবেন সিকদারের কম্যুনিস্ট পার্টির পরিচয়ে হত্যার রাজনীতি শুরু করে। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদাহ, যশোর, মাগুরাসহ বাংলাদেশের নানা জেলায় শত শত মানুষ তাদের হাতে নিহত হয়। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানীই হলেন গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতির জনক।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন দেন। “ভোটের আগে ভাত চাই”- এ দাবী তুলে ভাসানী ১৯৭০ সালের নির্বাচন বয়কট করেন। প্রশ্ন হলো, কোন গণতান্ত্রিক দল কি নির্বাচন বর্জন করতে পারে? নির্বাচন বর্জন করার অর্থ তো গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়া এবং দেশকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী রাজনীতির দিকে ঠেল দেয়া। অথচ সেটিই ছিল ভাসানীর রাজনীতি। তার দলের কম্যুনিস্টরা বস্তুত সেটিই চাচ্ছিল। তারা চীনা স্টাইলে সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছিল। ফলে পরিকল্পিত ভাবেই নির্বাচন বর্জন করলো। আর তাতে নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট মুজিবের বিজয় ত্বরান্বিত হলো। ১৯৭১’য়ে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতের কোলে গিয়ে উঠেন। মাওলানা ভাসানী একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তখন চার দিকে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও জবর দখল চলছিল বিহারীদের ঘরবাড়ী ও দোকানপাটের উপর। ভাসানী ইচ্ছা করলে সে গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে খাড়া হতে পারতেন। কিন্তু সে বর্বরতা রোধে তিনি কোন ভূমিকাই নেননি।
ফ্যাসিস্ট মুজিব যখন রক্ষি বাহিনী দিয়ে বিরোধীদের উপর নৃশংস দমন নিপীড়ন চালাচ্ছিল এবং হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছিল তখনও তিনি সোচ্চার হননি। তিনি নিষ্ক্রয়তা ও নীরবতার পথ বেছে নেন। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসলে ভাসানীর দলের বেশীর ভাগ লোকেরা ক্ষমতার লোভে জেনারেল জিয়ার দলে যোগ দেয়। জিয়ার মৃত্যুর পর জেনারেল এরশাদের উদয় হলে দলটির ক্ষমতালোভীরা জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়।
তাই ভাসানী ব্যর্থ হয়েছেন সভ্য ও উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের অনুকরণীয় আদর্শ বা লিগ্যাসি রেখে যেতে। নেতাদের মূল কাজ জাতিকে পথ দেখানো। অথচ তিনি নিজেই ছিলেন চরম বিভ্রান্ত। তিনি মকতব-মাদ্রাসায় পড়েছেন বটে, কিন্তু ইসলামের পথে যাননি। তিনি আজীবন রাজনীতির নৌকা ভাসিয়েছেন, কিন্তু কখনোই কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নৌকাকে ধাবিত করতে পারেননি। একেক সময় একেক নৌকায় উঠেছেন। ব্যর্থ হয়েছেন সঠিক পথটি আবিষ্কারে। এদিকে তিনি শুধু ব্যর্থ নেতাই নন, একজন অপরাধীও। তার গুরুতর অপরাধটি অসংখ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করার এবং তাদের মূল্যবান সময় ও সামর্থ্য বিনষ্ট করার।


























