মুগ্ধতা টিকিয়ে রাখার শিল্প

- Update Time : ০৫:১৭:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
- / ২১৫ Time View
মুগ্ধতা অসামান্য বিষয়। কারো কারো প্রতি মুগ্ধতা সারাজীবন বজায় থাকে।
তাদের কথা শুনে মুগ্ধতা বাড়ে, তাদের কাজ দেখে মুগ্ধতা জন্ম নেয়। তাদের
আচরণের ছায়ায় আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করে। অথচ কিছু মানুষের প্রতি
মুগ্ধতা কেবল দূরে থাকা অবধি বজায় থাকে; কাছে এলেই দুর্গন্ধ ছড়ায়। মুখোশের
আড়ালের মানুষটির আসল চরিত্র প্রকাশিত হওয়ার পরেই ঘৃণা বাড়ে। মুগ্ধতা
মোহের মতো—একবার ভেঙে গেলে আর কোনো রঙে তা জমা করা যায় না।
যে সকল মানুষের সাথে না মেশা পর্যন্ত, কথা না বলা পর্যন্ত কিংবা কাজ না
করা পর্যন্ত মুগ্ধতা থাকে, তারা আসলে মেকি ছদ্মবেশ নিয়ে চলে। যাদের
ভেতরের রূপের সাথে বাইরের অবয়বের মিল নেই, তারা মানুষের ভালোবাসা ধরে
রাখতে পারে না। তাদের সাথে কারো খাতির শেষমেশ টিকে থাকে না।
মানুষের সাথে যত কম মেশা যায়, যত কম কথা বলা যায় কিংবা যত কম লেনদেন
করা যায়, তত ভালো। দূর থেকে চিত্র সুচিত্রায়িত হয়, কাছে গেলে অগোছালো।
মানুষকে যত খুঁটিয়ে দেখা হবে, তত ক্ষত বের হবে। প্রয়োজন ছাড়া কারো
ব্যক্তিগত বিষয় না জানাই ভালো।
মানুষ মানুষের প্রতি মুগ্ধ হয় বিভিন্ন অংশ দেখে—কারো কথা শুনে, কারো গান
শুনে কিংবা কারো কাজ দেখে। মুগ্ধতাকে সে-সব নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ
রাখা উচিত। গানে মুগ্ধ হয়ে যদি তার ব্যক্তিত্ব অনুসন্ধানে নামা হয়, তবে গান
শোনা ছেড়ে দিতে হতে পারে। একজন মানুষের প্রতি সম্পূর্ণ মুগ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার
পরেই সে প্রিয়জন হয়। মনে মনে অনেকেই প্রিয়জন হলেও, জনে জনে একজনের
অধিক প্রিয়জন থাকলে সেগুলোর সবকটিই প্রয়োজনীয় হয়।
মানুষের সাথে যে বন্ধুত্ব, তা মুগ্ধতা থেকেই। মুগ্ধতার বিচ্যুতি হতে পারে এমন
খোলামেলা মেলামেশা করা উচিত নয়। কিছুটা রহস্য বজায় রাখলে মুগ্ধতা দিনকে
দিন বাড়ে। মানুষ মানুষের সাথে থাকতে পারে, মানুষের জন্য বাঁচতে পারে কেবল
মুগ্ধতার বদৌলতে। কখনো কখনো সামান্য কথায়, হাস্যকর আচরণে মুগ্ধতা দূর
হয়ে যেতে পারে।
নদীর ওপারকে যত মনোমুগ্ধকর মনে হয়, তা অজানা মুগ্ধতার জন্য। ব্যক্তিত্ব
নষ্ট হলে, চরিত্র খারাপ হলে কিংবা অসৎতা প্রকাশিত হলে মুগ্ধতার সৌন্দর্য
বিনষ্ট হয়। পেটের ক্ষুধা মেটানোর চেয়েও মনের মুগ্ধতা টিকিয়ে রাখা বেশি
জরুরি।
মুগ্ধতার ক্ষেত্রে মানুষকে ঘিরে পরিধি যতটা বিস্তৃত, ফুল, পাখি কিংবা
পরিবেশকে ঘিরে তার চেয়ে কম বিস্তৃত নয়। প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতার টান কখনো
নষ্ট হয় না, অথচ মানুষ মানুষের প্রতি মুগ্ধতা ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগে।
যার সাথে প্রয়োজন নেই, সে সরকার হলেও খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার
দরকার নেই। হীরার সংস্পর্শে এলেও হীরার গাঠনিক ও গুণগত ত্রুটি ধরা পড়বে।
দোষে-গুণে গঠিত মানুষ। কারো থেকে যা জানা অপ্রয়োজনীয়, তা জানতে না
যাওয়াই উচিত।
মানুষের প্রতি একবার বিশ্বাস হারালে তা উদ্ধার করা সহজ কোনো কাজ নয়।
কাজেই যা মুগ্ধ করে, সেখানে আটকে থাকলে পথচলা সহজ হয়। মানুষের প্রকাশ্য
এবং গোপন—দ্বিচারিতার চরিত্র আছে। যাদের বাহির ও ভেতর একরকম, তারা
মহামানব, নবী-ওলী। সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের খুঁজতে থাকলে সময়ের অপচয়
এবং আশাভঙ্গ ছাড়া কিছুই মিলবে না।
মানুষ মানুষের প্রতি যত আশা করে, তার অধিকাংশই প্রবৃত্তিগত; সেখানে
যৌক্তিকতার উপস্থিতি খুব কম।
মানুষের চরিত্র খুব রহস্যময়। সে অন্যের থেকে যা যা আশা করে, তা নিজের
মধ্যে অন্যদের জন্য মজুদ রেখে অপেক্ষা করে না। পাওয়ার অঙ্ক আর দেওয়ার
হিসাব না মেলাতেই যত অসঙ্গতি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট হয়, ন্যূনতম
মুগ্ধতাটুকুও কেটে যাওয়ার পর।
মানুষের মধ্যে যত বিবাদ, বোঝাপড়ার অভাব কিংবা পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ—তা
একজন আরেকজনকে অতিরিক্ত জানতে যাওয়ার ফল। সবাইকে বিশ্বাস করে
সবকিছু বলে দেওয়া, দুর্বলতা চিনিয়ে দেওয়ার পরে, সে পথে শত্রুপক্ষ হাঁটবেই।
লেখা ভালো লাগলে লেখার প্রেমে পড়া যাবে, কিন্তু লেখককে খুঁজলে, অন্তরঙ্গ
হলে বিপত্তির শুরু। কবিদের চরিত্র নিয়ে আপত্তি তো আর একজনের নয়!
দূর থেকে উপলব্ধি করুন, অনেকটা কল্পনা মিশ্রিত রূপকে ভাবুন—ভালোলাগার
ভাবাবেশ তৈরি হবে। সবকিছু ছোঁয়াতে সুন্দর হয় না, বরং স্পর্শ করলেই
অসুন্দরের সাথে লেপ্টে যায়। কখনো কখনো দূর থেকে দেখায় অন্যরকম
ভালোলাগা কাজ করে।
দিনের শেষে মুগ্ধতা বাঁচিয়ে রাখা জরুরি; কেননা মুগ্ধতা জীবনের সূক্ষ্ম আনন্দ।
এই আনন্দেই মানুষ নীড়ে ও জীবনে ফিরতে পারার প্রেরণা পায়। অন্যরকম টান
অনুভূত না হলে সেখানে থাকা যায় না।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
raju69alive@gmail.com