০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৬ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

বিপ্লব কি আবারো ব্যর্থ হয়ে যাবে? ফিরোজ মাহবুব কামাল

Reporter Name
  • Update Time : ০৩:৫২:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫
  • / ১৮৮ Time View

 

এবিসি

রাজনৈতিক বিপ্লব থেকেই জন্ম সকল বিপ্লবের

সকল বিপ্লবের শুরু রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে। রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে লাগাতর বিপ্লব শুরু হয় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভূ-রাজনৈতিক, শিল্প ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে। এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সে রাজনৈতিক বিপ্লব -যা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করে। ঈমানদারের সে পবিত্র লড়াইকে ইসলামে জিহাদ বলা হয়। ব্যক্তি, সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে বদলিয়ে দেয়ার এটিই হলো মূল হাতিয়ার। যেখানে রাজনৈতিক বিপ্লবের সে প্রক্রিয়া তথা জিহাদ নাই, সেখানে চেপে বসে পর্বতের ন্যায় অনড় স্থবিরতা। তখন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করা হোক না কেন তাতে সে স্থবিরতা দূর হয় না; সমাজে বিপ্লবও আসে না। বিপ্লবের বিপরীতে যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বিপর্যয়টি হলো রাজনৈতিক বিপর্যয়। তখন সে বিপর্যয় থেকে জন্ম নেয় নানা রূপ ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।  তখন শুরু হয় দ্রুত নিচে নামা। এটি এক লাগাতর পতন প্রক্রিয়া। কোন জাতি কখনো মহামারি, খড়া, প্লাবন ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়না, বরং ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয় রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে। সে বিপর্যয় জাতীয় জীবনে জন্ম দেয় বিভক্তি, পরাজয়, পরাধীনতা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য।

সেক্যুলারিস্টদের কাছে রাজনীতি পেশা, সেবা বা কল্যাণ মূলক কাজ হলেও ইসলামে রয়েছে এর অতি উচ্চতর মর্যাদা। এটি শয়তান শক্তির এজেন্ডার বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার চুড়ান্ত লড়াই। মুসলিম উম্মাহর জীবনে এ রাজনৈতিক জিহাদ মুমিনের জীবনে চুড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। এ জিহাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, যার জীবনে জিহাদ নাই, নবীজী (সা:)’র যুগে তাকে মুনাফিক বলা হয়েছে। তখন সে মুনাফিকের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত কোন কাজ দেয় না, তার স্থান হয় জাহান্নামে। জিহাদে যোগ না দেয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই রোজা রেখে এবং নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েও মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচেনি। 

যে জনগোষ্ঠি ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে, তাদের শত শত বছর বাঁচতে হয় কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই। আরবগণ বহু হাজার বছর বেঁচেছে একই রূপ জাহিলিয়াত, গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও এবং রক্তাক্ত লড়াই নিয়ে। তাদের ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় পরিচয়। ছিল না কোন ভূ-রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। কিন্তু সেই বিভক্ত আরবগণ রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন যুগের দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে সর্ববৃহৎ বিশ্ব শক্তি আবির্ভুত হয়। নানা নামে ও নানা ভাবে ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচার তো অনেক দেশেই হয়; আরবদের এ বিস্ময়কর সাফল্যের মূলে শুধু ধর্ম বিপ্লব ছিল না, ছিল নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সফল রাজনৈতিক বিপ্লব এবং সে বিপ্লবের শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে কাজ করে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র। নবীজী (সা:) যদি তাঁর মিশনকে শুধু ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারে সীমিত রাখতেন তবে কখনোই আরব ভূমিতে সেরূপ একটি সফল বিপ্লব কখনোই সম্ভব হতো না।

নবীজী (সা:) তাঁর জীবনের বেশী ভাগ সময় কাটিয়েছেন মক্কাতে। ধর্ম প্রচারে সেখানে তিনি ১৩টি বছর কাটিয়েছেন; কিন্তু সেখানে কোন রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে পারেননি এবং প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি ইসলামী রাষ্ট্র। ফলে নির্মাণ করতে পারেননি ইসলামী বিপ্লবের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। সে দীর্ঘ ১৩ বছরে নবীজী (সা:) মাত্র কয়েক শত কাফিরকে মুসলিম বানাতে পেরেছিলেন। কিন্তু মদিনায় হিজরতে পর ইতিহাস পাল্টে যায়। সে কাঙ্খিত রাজনৈতিক বিপ্লবটি তখন সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র । রাষ্ট্র তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে ইসলামের দ্রুত প্রসারে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। মুসলিম ইতিহাসে নবীজী (সা:)‌’র সে হিজরত এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত থেকেই শুরু হয়েছে নতুন যুগের সূচনা। শুরু হয়েছে ইসলামী সভ্যতা নির্মাণের কাজ। সাহাবাগণ হিজরতের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই হিজরত থেকে শুরু হয়েছে হিজরী সাল গণনার সূচনা। 

 

প্রতিটি বিপ্লবের পিছনে রাজনৈতিক দর্শন ও এজেন্ডা কাজ করে। নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে সংঘটিত সে রাজনৈতিক বিপ্লবের মূলে  ছিল কুর’আনী জ্ঞান ও দর্শন; এবং সে বিপ্লবের মূল এজেন্ডাটি ছিল মহান রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। সেদিন সে বিপ্লব সাধিত না হলে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়া বিধান এবং দুর্বৃত্তি নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কুর’আনী এজেন্ডা কিতাবেই থেকে যেত।  ইসলামের সে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে অব্যাহত রাখার কাজে হাতিয়ার রূপে কাজ করে ইসলামী রাষ্ট্র।  নবীজী (সা:) ১০টি বছর যে রাষ্ট্রের চালকে আসনে বসে ইসলামকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে যান। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর সে শাসনে বসেন তার হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ। পরবর্তীতে সে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর জন্ম নেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা -যা ইতিহাসের পরিচিতি পায় ইসলামী সভ্যতা রূপে।  

প্রতিটি বিপ্লবেরই পরই প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা শুরু হয়। তাই বিপ্লবকে শুধু শুরু করলে চলে না, বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও প্রতিটি ঈমানদারকে নিতে হয়। এ কাজটিও জিহাদ। বিপ্লব করা যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন হলো সে বিপ্লব বাঁচিয়ে রাখা। বিপ্লব করতে যেমন রক্ত দিতে হয়, তেমনি বিপ্লব বাঁচাতেও রক্ত দিতে হয়। ইসলামের ইতিহাসে বিপ্লব বাঁচতে বরং বেশী রক্ত দিতে হয়েছে। বিপ্লব সংঘটিত করতে ও বাঁচাতে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর রাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয় বিশাল আকারের বিদ্রোহ। আবির্ভাব হয় বহু মিথ্যা নবীর। বিদ্রোহ হয় যাকাতের ন্যায় ইসলামের মৌলিক বিধানের বিরুদ্ধে। হযরত আবু বকর (রা:) অতি সফল ভাবে সে প্রতিবিপ্লব নির্মূল করতে সফল হয়েছিলেন; ফলে অব্যাহত থাকে ইসলামের বিপ্লবের ধারা। কিন্তু ইয়াজিদের নেতৃত্বে যে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়, সে প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধে মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাঁচেনি নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত বিশুদ্ধ ইসলাম। প্রতিষ্ঠা পায় জাহিলী যুগের রাজতন্ত্র।  

 

বাঙালি মুসলিমের প্রথম বিপ্লব এবং প্রথম পরাধীনতা

বাংলার বুকে ইসলামের পক্ষে প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লবটি ঘটে ত্রয়দশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের ফলে। সে মুসলিম বিজয় বাংলার বুকে শুধু শাসক পাল্টায়নি, বরং বিপ্লব এনেছিল বাঙালি জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও। বস্তুত সেটিই হলো বঙ্গীয় বদ্বীপে বসবাসকারী জনগণের জীবনে প্রথম বিপ্লব। এর আগে বাঙালিদের হাজারো বছর বাঁচতে হয়েছে পৌত্তলিকতার সনাতন অজ্ঞতা, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশাপ নিয়ে। সেটি ছিল এক দীর্ঘকালিন স্থবিরতা। বাংলার বুকে ইসলামের আগমন এবং মুসলিম শাসনের শুরু হওয়াতে বাংলার মেধাবী ও পরিশ্রমী জনগণ পায় নিজ সামর্থ্যের পূর্ণ বিনিয়োগের পক্ষে এক সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ। ফলে দ্রুত বিপ্লব আসে বাংলার কৃষি, কুঠির শিল্প ও বাণিজ্যে। বাংলা দ্রুত পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে। পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের হিসাব মতে ১৭০০ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামালে বিশ্বের মোট জিডিপির শতকরা ২৬ ভাগ জোগান দিত ভারতীয় উপমহাদেশ। আর সে ভারতীয় জিডিপির অর্ধেকের বেশী জোগান দিত সুবে বাংলা একাই। মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হতো সুবে বাংলা থেকে। তৎকালে বাংলা বিখ্যাত ছিল তার মসলিন, মখমল, রেশম ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য -যা সেদিন বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছিল।

সম্পদ বাড়লে চোর-ডাকাতদের উপদ্রবও বাড়ে। বাংলার সে সম্পদের প্রাচুর্যে আকর্ষিত হয় সূদুর ইউরোপীয় বণিক ও ডাকাতগণ। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজদের বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলি। আসে ডাকাতগণও। বাংলার বুকে তখন নিয়মিত ডাকাতি করতো পর্তুগিজ, মারাঠী ও মগ ডাকাতগণ। তখন বাংলার মুসলিম শাসকদের বেশীর ভাগ সময় ব্যয় হতো এই বিদেশী ডাকাত তাড়াতে। আর সবচেয়ে বড় ডাকাতি হয়ে যায় ইংরেজ ডাকাতদের হাতে। সেটি ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর প্রান্তরে; সেদিন পুরা দেশই ডাকাতি হয়ে যায়।

 

তাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, দেশের অর্থনীতিকে শুধু সমৃদ্ধ করলে চলে না, দেশের স্বাধীনতা ও সম্পদকে সুরক্ষিত করার যথাযথ সামরিক ব্যবস্থাও নিতে হয়। শক্তিশালী করতে হয় সেনাবাহিনীকে। নইলে সম্পদের প্রাচুর্য বিপদের কারণ হয়। বাংলার ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী হওয়ার কারণে সমগ্র এশিয়ার বুকে ব্রিটিশদের হাতে প্রথম অধিকৃত হয় সুবে বাংলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাবাহিনী এতোই দুর্বল ও এতোই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার ছিল যে, তার বাহিনী  ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয় রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর মাত্র ৪ হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে। সে পরাজয়ের ফলে ১৯০ বছরের জন্য নেমে আসে ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে নির্মম পরাধীনতা। বাংলার সে সম্পদে বলবান হয়ে বিস্তর সাম্রাজ্য বাড়াতে পেরেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি।

স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়ার জিহাদে ব্যর্থ হওয়ার আযাবটি অতি গুরুতর। সে আযাব আসে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি ও গোলামীর শিকল নিয়ে। দূষণ ঘটায় ধর্ম পালনে। ব্রিটিশের হাতে বাংলার জনগণ শুধু স্বাধীনতাই হারায়নি, বরং পরিণত হয়েছে দুর্ভিক্ষের দেশে। ব্রিটিশগণ শাসক হিসাবে আসেনি; এসেছিল ডাকাত রূপে। অধিকৃত দেশে শোষণ, লুন্ঠন ও নির্যাতন চালনা ছিল ব্রিটিশ দস্যুদের মূল নীতি। ভারতে মুসলিম বিজয়ের সাথে ইংরেজদের বিজয়ের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই। মুসলিম শাসকগণ তাদের নিজেদের ভাগ্যকে বাংলা বা ভারতের জনগণের ভাগ্যের সাথে একাত্ম করেছিল। ইংরেজ দস্যুদের মত তারা কখনোই এদেশের লুণ্ঠন করে মধ্য এশিয়ার পৈত্রিক ভূমিতে নিয়ে প্রাসাদ গড়েনি। নিজেদের জন্য যা কিছু গড়ার তা তারা বাংলা বা ভারতেই গড়েছে।

বাংলার ভাণ্ডার থেকে স্বর্ণ, রোপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী বিলেতে নিতে ইংরেজ দস্যুদের শত শত জাহাজের প্রয়োজন পড়েছিল। কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে তারা হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের কাছে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা কামাই করেছিল। আর কৃষকদের পরিণত করে ভূমিহীন প্রজাতে। জমিদারকে উচ্চহারে খাজনা দিয়ে কৃষকগণ জমির উপর চাষের অধিকার লাভ করতে হতো। প্রজাদের উপর ছিল শোষণ ও নির্যাতনের দুটি ভারী জোয়াল: একটি ব্রিটিশদের, অপরটি জমিদারদের। জমিদারগণ ছিল ইংরেজদের লাঠিয়াল। উভয়ের সীমাহীন শোষণ, লুণ্ঠন ও ব্যর্থ বাজার ব্যবস্থার ফলে ১৭৬৯-৭০য়ের সালে বাংলার বুকে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ -যাতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ইতিহাসে সেটি ছিয়াত্তরের মনন্তর রূপে পরিচিত। তবে সে দুর্ভিক্ষই একমাত্র দুর্ভিক্ষ ছিল না, ছোট বড় দুর্ভিক্ষ বাংলার মানুষের জীবনে প্রায়ই লেগে থাকতো। ১৯৪৩ সালে সৃষ্টি করা হয় আরেক ভয়নাক দুর্ভিক্ষ। বাংলার জন্য বরাদ্দ খাদ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিলের হুকুমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয রণাঙ্গণ পাঠানো হয়। বলা হয়ে থাকে সে দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।  

বাংলার বস্ত্র শিল্প ধ্বংসে দস্যু ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁতিদের আঙ্গুল কেটেছিল। বাংলার শিল্প ধ্বংসের লক্ষ্যে সে কাজটি তারা করেছিল নিজেদের অচল পণ্যের পসার বাড়ানোর লক্ষ্যে। বাণিজ্যিক মুনাফার স্বার্থে কৃষকদের বাধ্য করা হতো নীল চাষে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের নীল রংয়ের ব্যবসাকে শক্তিশালী করা এবং বাংলার বুকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ ছিল তাদের এক কুটিল কৌশল। কারণ, ব্রিটিশ ডাকাত শাসকগণ জানতো, জনগণের উপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিলে তাদের আর প্রতিরোধের সামর্থ্য থাকে না; এবং আগ্রহও গড়ে উঠে না। জনগণ তখন ব্যস্ত থাকে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। দুর্ভিক্ষকে এভাবে শত্রু শাসক পক্ষ হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতো। সে অভিন্ন কৌশলটি এখন ইসরাইল প্রয়োগ করছে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে।

মানুষ শিক্ষিত হলে তার মাঝে স্বাধীনতায় আগ্রহ জাগে। দখলদার ডাকাতগণ চায় জনগণকে নিরক্ষর রাখতে। সে লক্ষ্যে ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রকল্পটি ছিল সুপরিকল্পিত। মুসলিম শাসনামলে দেশের শতকরা ২০ ভাগের বেশী কৃষি জমি বরাদ্দ ছিল মসজিদ-মাদ্রাসার নামে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যাশিক্ষা ফ্রি ছিল। কিন্তু মসজিদ-মাদ্রাসার সে জমি কেড়ে নিয়ে জমিদারদের নামে বরাদ্দ হয়। এতে সরকারের বিপুল অর্থলাভ হয়। এবং অর্থাভাবে মাদ্রাসা-মকতবগুলি বন্ধ হয়ে যায়; এভাবে সফল হয় অর্থ লাভের সাথে জনগণকে নিরক্ষর বানানোর প্রকল্প। শিক্ষার নামে ব্রিটিশ বেনিয়ারা সামান্য যা কিছু করেছে তার মূল লক্ষ্য ছিল স্রেফ ব্রিটিশদের প্রশাসনের কাজে অনুগত চাকর-বাকর তৈরী করা। সেরূপ বৈরী শিক্ষা নীতির ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায় কালে স্বাক্ষরতার হার ভারতে শতকরা ১০ ভাগেরও কম ছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমদের নিজেদের ব্যর্থতাটিও কম নয়। তারা ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিপ্লবের ন্যায় ফরজ ইবাদত পালনে। সে ব্যর্থতার কারণে তাদেরকে ১৯০ বছর ব্রিটিশের গোলামীর ঘানি টানতে হয়েছে। 

 

বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় বিপ্লব

১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিম জীবনে আসে দ্বিতীয় রাজনৈতিক বিপ্লব। সেটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ইখিতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ঘটনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঙালি মুসলিমগণ। ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা পায় ঢাকাতে। বাংলা পরিণত হয় মুসলিম লীগের মূল ঘাঁটিতে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটির রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলার সুযোগই শুধু পায়নি, বরং সে সাথে পেয়েছিল ব্রিটিশ আমলে হারানো কৃষি জমির উপর মালিকানা। সেটি ১৯৫১ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে। ফলে জমির মালিকানা পেয়ে কৃষকের হাতে তখন অর্থের সঞ্চয় বাড়তে থাকে। ফলে কৃষক তার বাঁচার লড়াইয়ে সন্তানকে ব্রিটিশ আমলে কৃষিতে নামাতে যেরূপ বাধ্য হতো -তা থেকে মুক্তি পায়। সে একই কৃষক তার সন্তানকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো শুরু করে।  ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় শিক্ষার জোয়ার। আর শিক্ষা উন্নয়ন কখনো দেশে একাকী আসে না, সাথে আনে অর্থনৈতিক উন্নয়নও। শিক্ষার সাথে শুরু হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ ছিল সবচেয়ে বড় কল্যাণ।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কোন পাট কল ছিল না -যদিও পাট উৎপাদনে পূর্ব বাংলা ছিল বিশ্বে প্রথম।। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী পাট কল। স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী বস্ত্রকল। স্থাপিত হয় স্টিল মিল, কাগজের কল ও ঔষধ কারখানা। নির্মিত হয় অনেকগুলি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে উঠে অনেক গুলি ক্যাডেট কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। স্থাপিত হয় অস্ত্র কারখানা। পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের হার ভারত দূরে থাক, দক্ষিন কোরিয়ার চেয়েও ভাল ছিল। টাকার মূল্য ছিল ভারতীয় রুপীর চেয়ে অধিক। ষাটের দশকে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে পাকিস্তান চিত্রিত হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের মডেল রূপে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ আসতো উন্নয়নের সে পাকিস্তানী মডেল দেখতে। পাকিস্তানী সে মডেল অনুসরণ করে দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে গেছে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে অরাজকতা সৃষ্টির ফলে উন্নয়নের সে ধারা পাকিস্তান আর অব্যাহত রাখতে পারিনি। বাঙালি কম্যুনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী নেতাগণ অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের চিত্রিত করে জনগণের রক্তচোষা শত্রু রূপে। সে যুক্তি দেখিয়ে শুরু হয় শিল্পোন্নয়নের বিরুদ্ধে নাশকতা।

 

শত্রুর দ্বিতীয় বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়

ভারতের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীগণ পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর জনসংখ্যায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সে সাথে পারমানবিক শক্তিও। ফলে ভারতের ছিল প্রচণ্ড মুসলিম ভীতি এবং সে সাথে পাকিস্তান ভীতিও। ফলে দেশটির জন্মের পর থেকেই শুরু হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্র। আগ্রাসী ভারত দখল করে নেয় মুসলিম শাসিত হায়দারাবাদ, গোয়া ও মানভাদাড় রাজ্য। দখল করে নেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের বৃহ‌দাংশ। ভারতের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পাকিস্তান যোগ দেয় মার্কিন বলয়ে এবং শামিল হয় SEATO ও CENTO নামক নিরাপত্তা জোটে। এর ফলে পাকিস্তান পরিণত হয় সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের স্নায়ু যুদ্ধ, রাজনৈতিক যুদ্ধ ও সামরিক যুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গণে। ভারত যোগ দেয় সোভিয়েত শিবিরে ও সম্মিলিত ভাবে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙ্গার। ভারতীয় সে শিবিরে যোগ দেয় বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীগণ।

পাকিস্তানের বিনাশে শত্রুদের যুদ্ধটি ছিল ত্রিমুখী। সেক্যুলারিজম, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনজিমের পতাকাধারী দলগুলির আদর্শিক হামলাটি ছিল পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি প্যান-ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র শুরু হয় শিল্প ধ্বংসে। সে লক্ষ্যে এরা ট্রেড ইউনিয়নের নামে দুর্গ গড়ে প্রতিটি শিল্প করখানায়। দাবী আদায়ের নামে শ্রমিকদের উস্কে দেয় শিল্প কারখানা অচল করতে। ফলে নিরাপত্তা হারিয়ে পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে থাকে। অপরদিকে ভারতের সাথে কোয়ালিশন গড়ে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা। এ ষড়যন্ত্র প্রথম শুরু করে শেখ মুজিব -যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ষড়যন্ত্র করে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাগণ। সেসব ষড়যন্ত্র সফল না হওয়ায় শুরু হয়  ১৯৭১’য়ের সম্মিলিত সশস্ত্র যুদ্ধ। সোভিয়েত সাহায্যপ্রাপ্ত ভারত এ যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান অধিকৃত হয় ভারতের হাতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে প্রথম পরাজয়ের পর ১৯৭১’য়ে ঘটে বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়। ১৭৫৭’য়ে বিজয়ী হয়েছিল ইংরেজ বেনিয়াগণ। আর ১৯৭১’য়ে বিজয়ী হয় আগ্রাসী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। 

১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরের ভারতের বিজয়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে আবারো শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের ন্যায় শোষণ ও লুণ্ঠনের রাজত্ব। আবার ফিরে আসে ব্রিটিশ আমলের ন্যায় দুর্ভিক্ষ এবং ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন। যুদ্ধ শুরু হয় ইসলাম ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সে অধিকৃতির কারণে কবরে যেতে হয় গণতন্ত্র ও মৌলিক মানাধিকারকে। গড়ে উঠে বার বার গণহত্যা, পিল খানায় সেনা হত্যা, ফাঁসি, জেল-জুলুম ও আয়না ঘরের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। মুজিব আমলে বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি। ১৯৭৪’য়ে দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে দুর্বৃত্তিতে বাংলাদেশ ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। হাসিনা রেকর্ড গড়ে একদলীয় নির্বাচন ও ভোটডাকাতিতে।     

 

তৃতীয় বিপ্লব ও তৃতীয় স্বাধীনতা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবটি হলো ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয় এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের তৃতীয় বিজয়। এ বিজয় আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, RAB ও বিজিবি’র খুনিদের হাতে রক্ত দিয়েছে ১৪ শতের বেশী নিরপরাধ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ এবং আহত হয়েছে ২২ হাজারের বেশী। এ বিপ্লবের ফলে তৃতীয় বার স্বাধীনতা মিললো দেশবাসীর। আর স্বাধীনতা মানেই নতুন উদ্যোমে বেড়ে উঠার সুযোগ। এ বিপ্লব পুণরায় দোয়ার খুলে দিয়েছে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। তবে এ বিপ্লব শুধু মহা সুযোগই আনেনি; নতুন পরীক্ষাও এনেছে। বাঙালি মুসলিমের পুণরায় পরীক্ষা হবে তারা কতটুকু সমর্থ এ স্বাধীনতার সুরক্ষায়। স্বাধীনতার সুফল তো তারাই পায় যারা সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারে। মুসলিমের উপর ফরজ শুধু পরাধীনতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে স্বাধীনতা আনা নয়, বরং ফরজ হলো সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়া। 

বাঙালি মুসলিমে এবারের পরীক্ষাটি বিশাল। দুর্বৃত্ত হাসিনার শাসন বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ১৬ বছরের শাসন কালে সরকারের ভিতরে যে বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ে উঠেছিল -তা নির্মূল হয়নি। গলিত আবর্জনার মাঝে মশামাছি ও বিষাক্ত কীটগুলি যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি দুষ্ট রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের গভীরে বিপুল সংখ্যায় আজও বেঁচে আছে দুর্বৃত্তগণ। ৫ আগস্টের পর তারা গর্তে ঢুকেছে, কিন্তু তারা নির্মূল হয়নি। সুযোগ খুঁজছে বেরিয়ে আসার। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে শুধু দুর্বৃত্ত শাসককে নির্মূল করলে চলে না; নির্মূল করতে হয় ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের সকল দুর্বৃত্তদের। নইলে তারা আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়। এবং আবারো জন্ম দেয় ভোটডাকাতি, আয়না ঘর, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।

 

বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখায় জনগণের দায়

বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত সরকার পতনের কাজ বহুবার হয়েছে। কিন্তু পতিত দুর্বৃত্ত শাসক শক্তি বার বার পুরনো দুর্বৃত্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। ফলে ফিরে এসেছে শত্রু শক্তির নতুন অধিকৃতি। কারণ সরকারের গভীরে বসে থাকা দুর্বৃত্তির বীজ সরানোর কাজটি কোন বারই পূর্ণ ভাবে হয়নি। প্রতিটি বিপ্লবের পর ভিতরে রয়ে যায় প্রতি বিপ্লবের বীজ। সে সাথে নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নামার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরের শত্রুদের সাথে তাদের প্রভু বিদেশী শত্রু ভারত। কারণ শত্রুর যুদ্ধ কখনো শেষ হয়না, শুধু কৌশল ও রণাঙ্গণ পাল্টায় মাত্র।  

এজন্যই বিপ্লব সফল করতে হলে বিপ্লবের চেতনাকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয় এবং বাঁচিয়ে রাখতে হয় বিপ্লবের শত্রুদের নির্মূলের ধারাও। বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়ার নাম; একবার শুরু হলে সেটি যুগ যুগ চলে। সে প্রক্রিয়া থেমে গেলে সে বিপ্লবের মৃত্যু শুরু হয়। তাই নবীজী (সা:) যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা মক্কা বিজয়ের পর শেষ হয়নি। বরং মক্কা বিজয় সে বিপ্লবকে আরো বেগবান করেছিল। প্রকৃত বিপ্লব কখনোই কোন মৌসুমী বিষয় নয়, এটি আমৃত্য ধারণ করে বাঁচার বিষয়। সত্যিকার বিপ্লবীকে তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। সে চরিত্র ধারণ করতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সৈনিকদেরও। নইলে এ বিপ্লব সত্বর মারা যাবে।

 

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল সেটি ব্যর্থ হওয়ার কারণ, সে বিপ্লব অনেকের কাছেই মৌসুমী বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের কর্মীরা পাকিস্তানের সে প্যাান ইসলামী ধারণাকে ধরে রাখতে পারিনি। তারা নিজেদের কেবলা পাল্টিয়েছে। কেউ কম্যুনিস্ট, কেউ সেক্যুলারিস্ট এবং কেউ ফ্যাসিস্ট হয়েছে। যেমন মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা ভাষানীর মত অনেক মুসলিম লীগ নেতাই ইসলামের পতাকা দূরে ফেলে দিয়ে বাম ধারার লাল পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে। মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিব হাতে নিয়েছে বাঙালি ফ্যাসিবাদের পতাকা। একাত্তরে এদের সবাইকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে ময়দানে দেখা গেছে। ইসলামে বিভক্তি হারাম এবং একতা ফরজ। তারা বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। তাদের গাদ্দারীটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে। শয়তানকে খুশি করা এবং শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয় করাই তাদের রাজনীতিতে পরিণত হয়। ক্ষমতায় গিয়ে মুজিব তার গণতন্ত্রের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিলে আসল রূপে হাজির হয়। সে ভারতে কোলে গিয়ে উঠে। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দেয় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

প্রশ্ন হলো,বাংলাদেশে আজ কতজন রয়েছে এমন বিপ্লবী যারা আজীবন বাঁচতে চায় বিপ্লবের ভিশন ও মিশনকে ধারণ করে? যারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তা নেমেছিল তারা প্রকৃত বিপ্লবী নয়, তারা বরং স্বার্থান্বেষী। সেসব স্বার্থান্বেষীরা হাসিনার বিদায় ও কোটা বিলুপ্তির পর ঘুমিয়ে পড়বে বা বিদায় নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃত বিপ্লবী তো তারাই যারা রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তির পুরা অবকাঠামোকে আমূল পাল্টাতে বদ্ধপরিকর। সেরূপ আমূল পাল্টানোর কাজকে আরবীতে বলে ইনকিলাব। প্রকৃত বিপ্লবীদের মনে দর্শন কাজ করে, স্বার্থপরতা নয়। এবং যারা ঈমানদার তাদের সে দর্শনটি হলো পবিত্র কুর’আনের। পবিত্র কুর’আন হলো বস্তুত ইনকিলাবের টেক্সট বুক। কুর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঈমানদারগণ তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। এখানে কোন পার্থিব স্বার্থপরতা কাজ করে না। বরং কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে সে মহান রবকে খুশি করার তাড়না। একমাত্র এমন বিপ্লবীদের কাছেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অর্জনকে বাঁচিয়ে রাখা পবিত্র জিহাদ গণ্য হবে। সে জিহাদ নিয়ে না বাঁচলে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লবের ন্যায় বাঙালি মুসলিমের এ তৃতীয় বিপ্লবও নিশ্চিত ব্যর্থ হয়ে যাবে।  যারা বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত, তাদের মূল শঙ্কাটি এখানেই।   

 রাজনৈতিক বিপ্লব থেকেই জন্ম সকল বিপ্লবের

সকল বিপ্লবের শুরু রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে। রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে লাগাতর বিপ্লব শুরু হয় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভূ-রাজনৈতিক, শিল্প ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে। এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সে রাজনৈতিক বিপ্লব -যা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করে। ঈমানদারের সে পবিত্র লড়াইকে ইসলামে জিহাদ বলা হয়। ব্যক্তি, সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে বদলিয়ে দেয়ার এটিই হলো মূল হাতিয়ার। যেখানে রাজনৈতিক বিপ্লবের সে প্রক্রিয়া তথা জিহাদ নাই, সেখানে চেপে বসে পর্বতের ন্যায় অনড় স্থবিরতা। তখন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করা হোক না কেন তাতে সে স্থবিরতা দূর হয় না; সমাজে বিপ্লবও আসে না। বিপ্লবের বিপরীতে যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বিপর্যয়টি হলো রাজনৈতিক বিপর্যয়। তখন সে বিপর্যয় থেকে জন্ম নেয় নানা রূপ ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।  তখন শুরু হয় দ্রুত নিচে নামা। এটি এক লাগাতর পতন প্রক্রিয়া। কোন জাতি কখনো মহামারি, খড়া, প্লাবন ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়না, বরং ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয় রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে। সে বিপর্যয় জাতীয় জীবনে জন্ম দেয় বিভক্তি, পরাজয়, পরাধীনতা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য।

সেক্যুলারিস্টদের কাছে রাজনীতি পেশা, সেবা বা কল্যাণ মূলক কাজ হলেও ইসলামে রয়েছে এর অতি উচ্চতর মর্যাদা। এটি শয়তান শক্তির এজেন্ডার বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার চুড়ান্ত লড়াই। মুসলিম উম্মাহর জীবনে এ রাজনৈতিক জিহাদ মুমিনের জীবনে চুড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। এ জিহাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, যার জীবনে জিহাদ নাই, নবীজী (সা:)’র যুগে তাকে মুনাফিক বলা হয়েছে। তখন সে মুনাফিকের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত কোন কাজ দেয় না, তার স্থান হয় জাহান্নামে। জিহাদে যোগ না দেয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই রোজা রেখে এবং নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েও মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচেনি। 

যে জনগোষ্ঠি ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে, তাদের শত শত বছর বাঁচতে হয় কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই। আরবগণ বহু হাজার বছর বেঁচেছে একই রূপ জাহিলিয়াত, গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও এবং রক্তাক্ত লড়াই নিয়ে। তাদের ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় পরিচয়। ছিল না কোন ভূ-রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। কিন্তু সেই বিভক্ত আরবগণ রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন যুগের দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে সর্ববৃহৎ বিশ্ব শক্তি আবির্ভুত হয়। নানা নামে ও নানা ভাবে ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচার তো অনেক দেশেই হয়; আরবদের এ বিস্ময়কর সাফল্যের মূলে শুধু ধর্ম বিপ্লব ছিল না, ছিল নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সফল রাজনৈতিক বিপ্লব এবং সে বিপ্লবের শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে কাজ করে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র। নবীজী (সা:) যদি তাঁর মিশনকে শুধু ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারে সীমিত রাখতেন তবে কখনোই আরব ভূমিতে সেরূপ একটি সফল বিপ্লব কখনোই সম্ভব হতো না।

নবীজী (সা:) তাঁর জীবনের বেশী ভাগ সময় কাটিয়েছেন মক্কাতে। ধর্ম প্রচারে সেখানে তিনি ১৩টি বছর কাটিয়েছেন; কিন্তু সেখানে কোন রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে পারেননি এবং প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি ইসলামী রাষ্ট্র। ফলে নির্মাণ করতে পারেননি ইসলামী বিপ্লবের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। সে দীর্ঘ ১৩ বছরে নবীজী (সা:) মাত্র কয়েক শত কাফিরকে মুসলিম বানাতে পেরেছিলেন। কিন্তু মদিনায় হিজরতে পর ইতিহাস পাল্টে যায়। সে কাঙ্খিত রাজনৈতিক বিপ্লবটি তখন সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র । রাষ্ট্র তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে ইসলামের দ্রুত প্রসারে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। মুসলিম ইতিহাসে নবীজী (সা:)‌’র সে হিজরত এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত থেকেই শুরু হয়েছে নতুন যুগের সূচনা। শুরু হয়েছে ইসলামী সভ্যতা নির্মাণের কাজ। সাহাবাগণ হিজরতের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই হিজরত থেকে শুরু হয়েছে হিজরী সাল গণনার সূচনা। 

 

প্রতিটি বিপ্লবের পিছনে রাজনৈতিক দর্শন ও এজেন্ডা কাজ করে। নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে সংঘটিত সে রাজনৈতিক বিপ্লবের মূলে  ছিল কুর’আনী জ্ঞান ও দর্শন; এবং সে বিপ্লবের মূল এজেন্ডাটি ছিল মহান রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। সেদিন সে বিপ্লব সাধিত না হলে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়া বিধান এবং দুর্বৃত্তি নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কুর’আনী এজেন্ডা কিতাবেই থেকে যেত।  ইসলামের সে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে অব্যাহত রাখার কাজে হাতিয়ার রূপে কাজ করে ইসলামী রাষ্ট্র।  নবীজী (সা:) ১০টি বছর যে রাষ্ট্রের চালকে আসনে বসে ইসলামকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে যান। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর সে শাসনে বসেন তার হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ। পরবর্তীতে সে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর জন্ম নেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা -যা ইতিহাসের পরিচিতি পায় ইসলামী সভ্যতা রূপে।  

প্রতিটি বিপ্লবেরই পরই প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা শুরু হয়। তাই বিপ্লবকে শুধু শুরু করলে চলে না, বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও প্রতিটি ঈমানদারকে নিতে হয়। এ কাজটিও জিহাদ। বিপ্লব করা যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন হলো সে বিপ্লব বাঁচিয়ে রাখা। বিপ্লব করতে যেমন রক্ত দিতে হয়, তেমনি বিপ্লব বাঁচাতেও রক্ত দিতে হয়। ইসলামের ইতিহাসে বিপ্লব বাঁচতে বরং বেশী রক্ত দিতে হয়েছে। বিপ্লব সংঘটিত করতে ও বাঁচাতে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর রাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয় বিশাল আকারের বিদ্রোহ। আবির্ভাব হয় বহু মিথ্যা নবীর। বিদ্রোহ হয় যাকাতের ন্যায় ইসলামের মৌলিক বিধানের বিরুদ্ধে। হযরত আবু বকর (রা:) অতি সফল ভাবে সে প্রতিবিপ্লব নির্মূল করতে সফল হয়েছিলেন; ফলে অব্যাহত থাকে ইসলামের বিপ্লবের ধারা। কিন্তু ইয়াজিদের নেতৃত্বে যে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়, সে প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধে মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাঁচেনি নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত বিশুদ্ধ ইসলাম। প্রতিষ্ঠা পায় জাহিলী যুগের রাজতন্ত্র।  

 

বাঙালি মুসলিমের প্রথম বিপ্লব এবং প্রথম পরাধীনতা

বাংলার বুকে ইসলামের পক্ষে প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লবটি ঘটে ত্রয়দশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের ফলে। সে মুসলিম বিজয় বাংলার বুকে শুধু শাসক পাল্টায়নি, বরং বিপ্লব এনেছিল বাঙালি জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও। বস্তুত সেটিই হলো বঙ্গীয় বদ্বীপে বসবাসকারী জনগণের জীবনে প্রথম বিপ্লব। এর আগে বাঙালিদের হাজারো বছর বাঁচতে হয়েছে পৌত্তলিকতার সনাতন অজ্ঞতা, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশাপ নিয়ে। সেটি ছিল এক দীর্ঘকালিন স্থবিরতা। বাংলার বুকে ইসলামের আগমন এবং মুসলিম শাসনের শুরু হওয়াতে বাংলার মেধাবী ও পরিশ্রমী জনগণ পায় নিজ সামর্থ্যের পূর্ণ বিনিয়োগের পক্ষে এক সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ। ফলে দ্রুত বিপ্লব আসে বাংলার কৃষি, কুঠির শিল্প ও বাণিজ্যে। বাংলা দ্রুত পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে। পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের হিসাব মতে ১৭০০ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামালে বিশ্বের মোট জিডিপির শতকরা ২৬ ভাগ জোগান দিত ভারতীয় উপমহাদেশ। আর সে ভারতীয় জিডিপির অর্ধেকের বেশী জোগান দিত সুবে বাংলা একাই। মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হতো সুবে বাংলা থেকে। তৎকালে বাংলা বিখ্যাত ছিল তার মসলিন, মখমল, রেশম ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য -যা সেদিন বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছিল।

সম্পদ বাড়লে চোর-ডাকাতদের উপদ্রবও বাড়ে। বাংলার সে সম্পদের প্রাচুর্যে আকর্ষিত হয় সূদুর ইউরোপীয় বণিক ও ডাকাতগণ। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজদের বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলি। আসে ডাকাতগণও। বাংলার বুকে তখন নিয়মিত ডাকাতি করতো পর্তুগিজ, মারাঠী ও মগ ডাকাতগণ। তখন বাংলার মুসলিম শাসকদের বেশীর ভাগ সময় ব্যয় হতো এই বিদেশী ডাকাত তাড়াতে। আর সবচেয়ে বড় ডাকাতি হয়ে যায় ইংরেজ ডাকাতদের হাতে। সেটি ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর প্রান্তরে; সেদিন পুরা দেশই ডাকাতি হয়ে যায়।

 

তাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, দেশের অর্থনীতিকে শুধু সমৃদ্ধ করলে চলে না, দেশের স্বাধীনতা ও সম্পদকে সুরক্ষিত করার যথাযথ সামরিক ব্যবস্থাও নিতে হয়। শক্তিশালী করতে হয় সেনাবাহিনীকে। নইলে সম্পদের প্রাচুর্য বিপদের কারণ হয়। বাংলার ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী হওয়ার কারণে সমগ্র এশিয়ার বুকে ব্রিটিশদের হাতে প্রথম অধিকৃত হয় সুবে বাংলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাবাহিনী এতোই দুর্বল ও এতোই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার ছিল যে, তার বাহিনী  ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয় রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর মাত্র ৪ হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে। সে পরাজয়ের ফলে ১৯০ বছরের জন্য নেমে আসে ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে নির্মম পরাধীনতা। বাংলার সে সম্পদে বলবান হয়ে বিস্তর সাম্রাজ্য বাড়াতে পেরেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি।

স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়ার জিহাদে ব্যর্থ হওয়ার আযাবটি অতি গুরুতর। সে আযাব আসে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি ও গোলামীর শিকল নিয়ে। দূষণ ঘটায় ধর্ম পালনে। ব্রিটিশের হাতে বাংলার জনগণ শুধু স্বাধীনতাই হারায়নি, বরং পরিণত হয়েছে দুর্ভিক্ষের দেশে। ব্রিটিশগণ শাসক হিসাবে আসেনি; এসেছিল ডাকাত রূপে। অধিকৃত দেশে শোষণ, লুন্ঠন ও নির্যাতন চালনা ছিল ব্রিটিশ দস্যুদের মূল নীতি। ভারতে মুসলিম বিজয়ের সাথে ইংরেজদের বিজয়ের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই। মুসলিম শাসকগণ তাদের নিজেদের ভাগ্যকে বাংলা বা ভারতের জনগণের ভাগ্যের সাথে একাত্ম করেছিল। ইংরেজ দস্যুদের মত তারা কখনোই এদেশের লুণ্ঠন করে মধ্য এশিয়ার পৈত্রিক ভূমিতে নিয়ে প্রাসাদ গড়েনি। নিজেদের জন্য যা কিছু গড়ার তা তারা বাংলা বা ভারতেই গড়েছে।

বাংলার ভাণ্ডার থেকে স্বর্ণ, রোপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী বিলেতে নিতে ইংরেজ দস্যুদের শত শত জাহাজের প্রয়োজন পড়েছিল। কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে তারা হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের কাছে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা কামাই করেছিল। আর কৃষকদের পরিণত করে ভূমিহীন প্রজাতে। জমিদারকে উচ্চহারে খাজনা দিয়ে কৃষকগণ জমির উপর চাষের অধিকার লাভ করতে হতো। প্রজাদের উপর ছিল শোষণ ও নির্যাতনের দুটি ভারী জোয়াল: একটি ব্রিটিশদের, অপরটি জমিদারদের। জমিদারগণ ছিল ইংরেজদের লাঠিয়াল। উভয়ের সীমাহীন শোষণ, লুণ্ঠন ও ব্যর্থ বাজার ব্যবস্থার ফলে ১৭৬৯-৭০য়ের সালে বাংলার বুকে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ -যাতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ইতিহাসে সেটি ছিয়াত্তরের মনন্তর রূপে পরিচিত। তবে সে দুর্ভিক্ষই একমাত্র দুর্ভিক্ষ ছিল না, ছোট বড় দুর্ভিক্ষ বাংলার মানুষের জীবনে প্রায়ই লেগে থাকতো। ১৯৪৩ সালে সৃষ্টি করা হয় আরেক ভয়নাক দুর্ভিক্ষ। বাংলার জন্য বরাদ্দ খাদ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিলের হুকুমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয রণাঙ্গণ পাঠানো হয়। বলা হয়ে থাকে সে দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।  

বাংলার বস্ত্র শিল্প ধ্বংসে দস্যু ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁতিদের আঙ্গুল কেটেছিল। বাংলার শিল্প ধ্বংসের লক্ষ্যে সে কাজটি তারা করেছিল নিজেদের অচল পণ্যের পসার বাড়ানোর লক্ষ্যে। বাণিজ্যিক মুনাফার স্বার্থে কৃষকদের বাধ্য করা হতো নীল চাষে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের নীল রংয়ের ব্যবসাকে শক্তিশালী করা এবং বাংলার বুকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ ছিল তাদের এক কুটিল কৌশল। কারণ, ব্রিটিশ ডাকাত শাসকগণ জানতো, জনগণের উপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিলে তাদের আর প্রতিরোধের সামর্থ্য থাকে না; এবং আগ্রহও গড়ে উঠে না। জনগণ তখন ব্যস্ত থাকে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। দুর্ভিক্ষকে এভাবে শত্রু শাসক পক্ষ হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতো। সে অভিন্ন কৌশলটি এখন ইসরাইল প্রয়োগ করছে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে।

মানুষ শিক্ষিত হলে তার মাঝে স্বাধীনতায় আগ্রহ জাগে। দখলদার ডাকাতগণ চায় জনগণকে নিরক্ষর রাখতে। সে লক্ষ্যে ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রকল্পটি ছিল সুপরিকল্পিত। মুসলিম শাসনামলে দেশের শতকরা ২০ ভাগের বেশী কৃষি জমি বরাদ্দ ছিল মসজিদ-মাদ্রাসার নামে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যাশিক্ষা ফ্রি ছিল। কিন্তু মসজিদ-মাদ্রাসার সে জমি কেড়ে নিয়ে জমিদারদের নামে বরাদ্দ হয়। এতে সরকারের বিপুল অর্থলাভ হয়। এবং অর্থাভাবে মাদ্রাসা-মকতবগুলি বন্ধ হয়ে যায়; এভাবে সফল হয় অর্থ লাভের সাথে জনগণকে নিরক্ষর বানানোর প্রকল্প। শিক্ষার নামে ব্রিটিশ বেনিয়ারা সামান্য যা কিছু করেছে তার মূল লক্ষ্য ছিল স্রেফ ব্রিটিশদের প্রশাসনের কাজে অনুগত চাকর-বাকর তৈরী করা। সেরূপ বৈরী শিক্ষা নীতির ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায় কালে স্বাক্ষরতার হার ভারতে শতকরা ১০ ভাগেরও কম ছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমদের নিজেদের ব্যর্থতাটিও কম নয়। তারা ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিপ্লবের ন্যায় ফরজ ইবাদত পালনে। সে ব্যর্থতার কারণে তাদেরকে ১৯০ বছর ব্রিটিশের গোলামীর ঘানি টানতে হয়েছে। 

 

বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় বিপ্লব

১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিম জীবনে আসে দ্বিতীয় রাজনৈতিক বিপ্লব। সেটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ইখিতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ঘটনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঙালি মুসলিমগণ। ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা পায় ঢাকাতে। বাংলা পরিণত হয় মুসলিম লীগের মূল ঘাঁটিতে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটির রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলার সুযোগই শুধু পায়নি, বরং সে সাথে পেয়েছিল ব্রিটিশ আমলে হারানো কৃষি জমির উপর মালিকানা। সেটি ১৯৫১ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে। ফলে জমির মালিকানা পেয়ে কৃষকের হাতে তখন অর্থের সঞ্চয় বাড়তে থাকে। ফলে কৃষক তার বাঁচার লড়াইয়ে সন্তানকে ব্রিটিশ আমলে কৃষিতে নামাতে যেরূপ বাধ্য হতো -তা থেকে মুক্তি পায়। সে একই কৃষক তার সন্তানকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো শুরু করে।  ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় শিক্ষার জোয়ার। আর শিক্ষা উন্নয়ন কখনো দেশে একাকী আসে না, সাথে আনে অর্থনৈতিক উন্নয়নও। শিক্ষার সাথে শুরু হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ ছিল সবচেয়ে বড় কল্যাণ।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কোন পাট কল ছিল না -যদিও পাট উৎপাদনে পূর্ব বাংলা ছিল বিশ্বে প্রথম।। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী পাট কল। স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী বস্ত্রকল। স্থাপিত হয় স্টিল মিল, কাগজের কল ও ঔষধ কারখানা। নির্মিত হয় অনেকগুলি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে উঠে অনেক গুলি ক্যাডেট কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। স্থাপিত হয় অস্ত্র কারখানা। পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের হার ভারত দূরে থাক, দক্ষিন কোরিয়ার চেয়েও ভাল ছিল। টাকার মূল্য ছিল ভারতীয় রুপীর চেয়ে অধিক। ষাটের দশকে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে পাকিস্তান চিত্রিত হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের মডেল রূপে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ আসতো উন্নয়নের সে পাকিস্তানী মডেল দেখতে। পাকিস্তানী সে মডেল অনুসরণ করে দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে গেছে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে অরাজকতা সৃষ্টির ফলে উন্নয়নের সে ধারা পাকিস্তান আর অব্যাহত রাখতে পারিনি। বাঙালি কম্যুনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী নেতাগণ অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের চিত্রিত করে জনগণের রক্তচোষা শত্রু রূপে। সে যুক্তি দেখিয়ে শুরু হয় শিল্পোন্নয়নের বিরুদ্ধে নাশকতা।

 

শত্রুর দ্বিতীয় বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়

ভারতের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীগণ পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর জনসংখ্যায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সে সাথে পারমানবিক শক্তিও। ফলে ভারতের ছিল প্রচণ্ড মুসলিম ভীতি এবং সে সাথে পাকিস্তান ভীতিও। ফলে দেশটির জন্মের পর থেকেই শুরু হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্র। আগ্রাসী ভারত দখল করে নেয় মুসলিম শাসিত হায়দারাবাদ, গোয়া ও মানভাদাড় রাজ্য। দখল করে নেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের বৃহ‌দাংশ। ভারতের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পাকিস্তান যোগ দেয় মার্কিন বলয়ে এবং শামিল হয় SEATO ও CENTO নামক নিরাপত্তা জোটে। এর ফলে পাকিস্তান পরিণত হয় সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের স্নায়ু যুদ্ধ, রাজনৈতিক যুদ্ধ ও সামরিক যুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গণে। ভারত যোগ দেয় সোভিয়েত শিবিরে ও সম্মিলিত ভাবে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙ্গার। ভারতীয় সে শিবিরে যোগ দেয় বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীগণ।

পাকিস্তানের বিনাশে শত্রুদের যুদ্ধটি ছিল ত্রিমুখী। সেক্যুলারিজম, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনজিমের পতাকাধারী দলগুলির আদর্শিক হামলাটি ছিল পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি প্যান-ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র শুরু হয় শিল্প ধ্বংসে। সে লক্ষ্যে এরা ট্রেড ইউনিয়নের নামে দুর্গ গড়ে প্রতিটি শিল্প করখানায়। দাবী আদায়ের নামে শ্রমিকদের উস্কে দেয় শিল্প কারখানা অচল করতে। ফলে নিরাপত্তা হারিয়ে পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে থাকে। অপরদিকে ভারতের সাথে কোয়ালিশন গড়ে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা। এ ষড়যন্ত্র প্রথম শুরু করে শেখ মুজিব -যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ষড়যন্ত্র করে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাগণ। সেসব ষড়যন্ত্র সফল না হওয়ায় শুরু হয়  ১৯৭১’য়ের সম্মিলিত সশস্ত্র যুদ্ধ। সোভিয়েত সাহায্যপ্রাপ্ত ভারত এ যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান অধিকৃত হয় ভারতের হাতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে প্রথম পরাজয়ের পর ১৯৭১’য়ে ঘটে বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়। ১৭৫৭’য়ে বিজয়ী হয়েছিল ইংরেজ বেনিয়াগণ। আর ১৯৭১’য়ে বিজয়ী হয় আগ্রাসী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। 

১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরের ভারতের বিজয়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে আবারো শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের ন্যায় শোষণ ও লুণ্ঠনের রাজত্ব। আবার ফিরে আসে ব্রিটিশ আমলের ন্যায় দুর্ভিক্ষ এবং ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন। যুদ্ধ শুরু হয় ইসলাম ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সে অধিকৃতির কারণে কবরে যেতে হয় গণতন্ত্র ও মৌলিক মানাধিকারকে। গড়ে উঠে বার বার গণহত্যা, পিল খানায় সেনা হত্যা, ফাঁসি, জেল-জুলুম ও আয়না ঘরের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। মুজিব আমলে বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি। ১৯৭৪’য়ে দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে দুর্বৃত্তিতে বাংলাদেশ ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। হাসিনা রেকর্ড গড়ে একদলীয় নির্বাচন ও ভোটডাকাতিতে।     

 

তৃতীয় বিপ্লব ও তৃতীয় স্বাধীনতা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবটি হলো ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয় এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের তৃতীয় বিজয়। এ বিজয় আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, RAB ও বিজিবি’র খুনিদের হাতে রক্ত দিয়েছে ১৪ শতের বেশী নিরপরাধ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ এবং আহত হয়েছে ২২ হাজারের বেশী। এ বিপ্লবের ফলে তৃতীয় বার স্বাধীনতা মিললো দেশবাসীর। আর স্বাধীনতা মানেই নতুন উদ্যোমে বেড়ে উঠার সুযোগ। এ বিপ্লব পুণরায় দোয়ার খুলে দিয়েছে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। তবে এ বিপ্লব শুধু মহা সুযোগই আনেনি; নতুন পরীক্ষাও এনেছে। বাঙালি মুসলিমের পুণরায় পরীক্ষা হবে তারা কতটুকু সমর্থ এ স্বাধীনতার সুরক্ষায়। স্বাধীনতার সুফল তো তারাই পায় যারা সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারে। মুসলিমের উপর ফরজ শুধু পরাধীনতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে স্বাধীনতা আনা নয়, বরং ফরজ হলো সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়া। 

বাঙালি মুসলিমে এবারের পরীক্ষাটি বিশাল। দুর্বৃত্ত হাসিনার শাসন বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ১৬ বছরের শাসন কালে সরকারের ভিতরে যে বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ে উঠেছিল -তা নির্মূল হয়নি। গলিত আবর্জনার মাঝে মশামাছি ও বিষাক্ত কীটগুলি যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি দুষ্ট রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের গভীরে বিপুল সংখ্যায় আজও বেঁচে আছে দুর্বৃত্তগণ। ৫ আগস্টের পর তারা গর্তে ঢুকেছে, কিন্তু তারা নির্মূল হয়নি। সুযোগ খুঁজছে বেরিয়ে আসার। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে শুধু দুর্বৃত্ত শাসককে নির্মূল করলে চলে না; নির্মূল করতে হয় ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের সকল দুর্বৃত্তদের। নইলে তারা আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়। এবং আবারো জন্ম দেয় ভোটডাকাতি, আয়না ঘর, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।

 

বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখায় জনগণের দায়

বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত সরকার পতনের কাজ বহুবার হয়েছে। কিন্তু পতিত দুর্বৃত্ত শাসক শক্তি বার বার পুরনো দুর্বৃত্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। ফলে ফিরে এসেছে শত্রু শক্তির নতুন অধিকৃতি। কারণ সরকারের গভীরে বসে থাকা দুর্বৃত্তির বীজ সরানোর কাজটি কোন বারই পূর্ণ ভাবে হয়নি। প্রতিটি বিপ্লবের পর ভিতরে রয়ে যায় প্রতি বিপ্লবের বীজ। সে সাথে নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নামার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরের শত্রুদের সাথে তাদের প্রভু বিদেশী শত্রু ভারত। কারণ শত্রুর যুদ্ধ কখনো শেষ হয়না, শুধু কৌশল ও রণাঙ্গণ পাল্টায় মাত্র।  

এজন্যই বিপ্লব সফল করতে হলে বিপ্লবের চেতনাকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয় এবং বাঁচিয়ে রাখতে হয় বিপ্লবের শত্রুদের নির্মূলের ধারাও। বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়ার নাম; একবার শুরু হলে সেটি যুগ যুগ চলে। সে প্রক্রিয়া থেমে গেলে সে বিপ্লবের মৃত্যু শুরু হয়। তাই নবীজী (সা:) যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা মক্কা বিজয়ের পর শেষ হয়নি। বরং মক্কা বিজয় সে বিপ্লবকে আরো বেগবান করেছিল। প্রকৃত বিপ্লব কখনোই কোন মৌসুমী বিষয় নয়, এটি আমৃত্য ধারণ করে বাঁচার বিষয়। সত্যিকার বিপ্লবীকে তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। সে চরিত্র ধারণ করতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সৈনিকদেরও। নইলে এ বিপ্লব সত্বর মারা যাবে।

 

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল সেটি ব্যর্থ হওয়ার কারণ, সে বিপ্লব অনেকের কাছেই মৌসুমী বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের কর্মীরা পাকিস্তানের সে প্যাান ইসলামী ধারণাকে ধরে রাখতে পারিনি। তারা নিজেদের কেবলা পাল্টিয়েছে। কেউ কম্যুনিস্ট, কেউ সেক্যুলারিস্ট এবং কেউ ফ্যাসিস্ট হয়েছে। যেমন মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা ভাষানীর মত অনেক মুসলিম লীগ নেতাই ইসলামের পতাকা দূরে ফেলে দিয়ে বাম ধারার লাল পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে। মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিব হাতে নিয়েছে বাঙালি ফ্যাসিবাদের পতাকা। একাত্তরে এদের সবাইকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে ময়দানে দেখা গেছে। ইসলামে বিভক্তি হারাম এবং একতা ফরজ। তারা বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। তাদের গাদ্দারীটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে। শয়তানকে খুশি করা এবং শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয় করাই তাদের রাজনীতিতে পরিণত হয়। ক্ষমতায় গিয়ে মুজিব তার গণতন্ত্রের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিলে আসল রূপে হাজির হয়। সে ভারতে কোলে গিয়ে উঠে। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দেয় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

প্রশ্ন হলো,বাংলাদেশে আজ কতজন রয়েছে এমন বিপ্লবী যারা আজীবন বাঁচতে চায় বিপ্লবের ভিশন ও মিশনকে ধারণ করে? যারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তা নেমেছিল তারা প্রকৃত বিপ্লবী নয়, তারা বরং স্বার্থান্বেষী। সেসব স্বার্থান্বেষীরা হাসিনার বিদায় ও কোটা বিলুপ্তির পর ঘুমিয়ে পড়বে বা বিদায় নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃত বিপ্লবী তো তারাই যারা রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তির পুরা অবকাঠামোকে আমূল পাল্টাতে বদ্ধপরিকর। সেরূপ আমূল পাল্টানোর কাজকে আরবীতে বলে ইনকিলাব। প্রকৃত বিপ্লবীদের মনে দর্শন কাজ করে, স্বার্থপরতা নয়। এবং যারা ঈমানদার তাদের সে দর্শনটি হলো পবিত্র কুর’আনের। পবিত্র কুর’আন হলো বস্তুত ইনকিলাবের টেক্সট বুক। কুর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঈমানদারগণ তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। এখানে কোন পার্থিব স্বার্থপরতা কাজ করে না। বরং কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে সে মহান রবকে খুশি করার তাড়না। একমাত্র এমন বিপ্লবীদের কাছেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অর্জনকে বাঁচিয়ে রাখা পবিত্র জিহাদ গণ্য হবে। সে জিহাদ নিয়ে না বাঁচলে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লবের ন্যায় বাঙালি মুসলিমের এ তৃতীয় বিপ্লবও নিশ্চিত ব্যর্থ হয়ে যাবে।  যারা বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত, তাদের মূল শঙ্কাটি এখানেই।   

 

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

বিপ্লব কি আবারো ব্যর্থ হয়ে যাবে? ফিরোজ মাহবুব কামাল

Update Time : ০৩:৫২:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫

 

এবিসি

রাজনৈতিক বিপ্লব থেকেই জন্ম সকল বিপ্লবের

সকল বিপ্লবের শুরু রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে। রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে লাগাতর বিপ্লব শুরু হয় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভূ-রাজনৈতিক, শিল্প ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে। এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সে রাজনৈতিক বিপ্লব -যা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করে। ঈমানদারের সে পবিত্র লড়াইকে ইসলামে জিহাদ বলা হয়। ব্যক্তি, সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে বদলিয়ে দেয়ার এটিই হলো মূল হাতিয়ার। যেখানে রাজনৈতিক বিপ্লবের সে প্রক্রিয়া তথা জিহাদ নাই, সেখানে চেপে বসে পর্বতের ন্যায় অনড় স্থবিরতা। তখন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করা হোক না কেন তাতে সে স্থবিরতা দূর হয় না; সমাজে বিপ্লবও আসে না। বিপ্লবের বিপরীতে যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বিপর্যয়টি হলো রাজনৈতিক বিপর্যয়। তখন সে বিপর্যয় থেকে জন্ম নেয় নানা রূপ ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।  তখন শুরু হয় দ্রুত নিচে নামা। এটি এক লাগাতর পতন প্রক্রিয়া। কোন জাতি কখনো মহামারি, খড়া, প্লাবন ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়না, বরং ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয় রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে। সে বিপর্যয় জাতীয় জীবনে জন্ম দেয় বিভক্তি, পরাজয়, পরাধীনতা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য।

সেক্যুলারিস্টদের কাছে রাজনীতি পেশা, সেবা বা কল্যাণ মূলক কাজ হলেও ইসলামে রয়েছে এর অতি উচ্চতর মর্যাদা। এটি শয়তান শক্তির এজেন্ডার বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার চুড়ান্ত লড়াই। মুসলিম উম্মাহর জীবনে এ রাজনৈতিক জিহাদ মুমিনের জীবনে চুড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। এ জিহাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, যার জীবনে জিহাদ নাই, নবীজী (সা:)’র যুগে তাকে মুনাফিক বলা হয়েছে। তখন সে মুনাফিকের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত কোন কাজ দেয় না, তার স্থান হয় জাহান্নামে। জিহাদে যোগ না দেয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই রোজা রেখে এবং নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েও মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচেনি। 

যে জনগোষ্ঠি ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে, তাদের শত শত বছর বাঁচতে হয় কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই। আরবগণ বহু হাজার বছর বেঁচেছে একই রূপ জাহিলিয়াত, গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও এবং রক্তাক্ত লড়াই নিয়ে। তাদের ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় পরিচয়। ছিল না কোন ভূ-রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। কিন্তু সেই বিভক্ত আরবগণ রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন যুগের দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে সর্ববৃহৎ বিশ্ব শক্তি আবির্ভুত হয়। নানা নামে ও নানা ভাবে ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচার তো অনেক দেশেই হয়; আরবদের এ বিস্ময়কর সাফল্যের মূলে শুধু ধর্ম বিপ্লব ছিল না, ছিল নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সফল রাজনৈতিক বিপ্লব এবং সে বিপ্লবের শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে কাজ করে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র। নবীজী (সা:) যদি তাঁর মিশনকে শুধু ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারে সীমিত রাখতেন তবে কখনোই আরব ভূমিতে সেরূপ একটি সফল বিপ্লব কখনোই সম্ভব হতো না।

নবীজী (সা:) তাঁর জীবনের বেশী ভাগ সময় কাটিয়েছেন মক্কাতে। ধর্ম প্রচারে সেখানে তিনি ১৩টি বছর কাটিয়েছেন; কিন্তু সেখানে কোন রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে পারেননি এবং প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি ইসলামী রাষ্ট্র। ফলে নির্মাণ করতে পারেননি ইসলামী বিপ্লবের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। সে দীর্ঘ ১৩ বছরে নবীজী (সা:) মাত্র কয়েক শত কাফিরকে মুসলিম বানাতে পেরেছিলেন। কিন্তু মদিনায় হিজরতে পর ইতিহাস পাল্টে যায়। সে কাঙ্খিত রাজনৈতিক বিপ্লবটি তখন সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র । রাষ্ট্র তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে ইসলামের দ্রুত প্রসারে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। মুসলিম ইতিহাসে নবীজী (সা:)‌’র সে হিজরত এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত থেকেই শুরু হয়েছে নতুন যুগের সূচনা। শুরু হয়েছে ইসলামী সভ্যতা নির্মাণের কাজ। সাহাবাগণ হিজরতের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই হিজরত থেকে শুরু হয়েছে হিজরী সাল গণনার সূচনা। 

 

প্রতিটি বিপ্লবের পিছনে রাজনৈতিক দর্শন ও এজেন্ডা কাজ করে। নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে সংঘটিত সে রাজনৈতিক বিপ্লবের মূলে  ছিল কুর’আনী জ্ঞান ও দর্শন; এবং সে বিপ্লবের মূল এজেন্ডাটি ছিল মহান রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। সেদিন সে বিপ্লব সাধিত না হলে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়া বিধান এবং দুর্বৃত্তি নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কুর’আনী এজেন্ডা কিতাবেই থেকে যেত।  ইসলামের সে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে অব্যাহত রাখার কাজে হাতিয়ার রূপে কাজ করে ইসলামী রাষ্ট্র।  নবীজী (সা:) ১০টি বছর যে রাষ্ট্রের চালকে আসনে বসে ইসলামকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে যান। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর সে শাসনে বসেন তার হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ। পরবর্তীতে সে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর জন্ম নেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা -যা ইতিহাসের পরিচিতি পায় ইসলামী সভ্যতা রূপে।  

প্রতিটি বিপ্লবেরই পরই প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা শুরু হয়। তাই বিপ্লবকে শুধু শুরু করলে চলে না, বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও প্রতিটি ঈমানদারকে নিতে হয়। এ কাজটিও জিহাদ। বিপ্লব করা যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন হলো সে বিপ্লব বাঁচিয়ে রাখা। বিপ্লব করতে যেমন রক্ত দিতে হয়, তেমনি বিপ্লব বাঁচাতেও রক্ত দিতে হয়। ইসলামের ইতিহাসে বিপ্লব বাঁচতে বরং বেশী রক্ত দিতে হয়েছে। বিপ্লব সংঘটিত করতে ও বাঁচাতে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর রাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয় বিশাল আকারের বিদ্রোহ। আবির্ভাব হয় বহু মিথ্যা নবীর। বিদ্রোহ হয় যাকাতের ন্যায় ইসলামের মৌলিক বিধানের বিরুদ্ধে। হযরত আবু বকর (রা:) অতি সফল ভাবে সে প্রতিবিপ্লব নির্মূল করতে সফল হয়েছিলেন; ফলে অব্যাহত থাকে ইসলামের বিপ্লবের ধারা। কিন্তু ইয়াজিদের নেতৃত্বে যে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়, সে প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধে মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাঁচেনি নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত বিশুদ্ধ ইসলাম। প্রতিষ্ঠা পায় জাহিলী যুগের রাজতন্ত্র।  

 

বাঙালি মুসলিমের প্রথম বিপ্লব এবং প্রথম পরাধীনতা

বাংলার বুকে ইসলামের পক্ষে প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লবটি ঘটে ত্রয়দশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের ফলে। সে মুসলিম বিজয় বাংলার বুকে শুধু শাসক পাল্টায়নি, বরং বিপ্লব এনেছিল বাঙালি জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও। বস্তুত সেটিই হলো বঙ্গীয় বদ্বীপে বসবাসকারী জনগণের জীবনে প্রথম বিপ্লব। এর আগে বাঙালিদের হাজারো বছর বাঁচতে হয়েছে পৌত্তলিকতার সনাতন অজ্ঞতা, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশাপ নিয়ে। সেটি ছিল এক দীর্ঘকালিন স্থবিরতা। বাংলার বুকে ইসলামের আগমন এবং মুসলিম শাসনের শুরু হওয়াতে বাংলার মেধাবী ও পরিশ্রমী জনগণ পায় নিজ সামর্থ্যের পূর্ণ বিনিয়োগের পক্ষে এক সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ। ফলে দ্রুত বিপ্লব আসে বাংলার কৃষি, কুঠির শিল্প ও বাণিজ্যে। বাংলা দ্রুত পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে। পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের হিসাব মতে ১৭০০ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামালে বিশ্বের মোট জিডিপির শতকরা ২৬ ভাগ জোগান দিত ভারতীয় উপমহাদেশ। আর সে ভারতীয় জিডিপির অর্ধেকের বেশী জোগান দিত সুবে বাংলা একাই। মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হতো সুবে বাংলা থেকে। তৎকালে বাংলা বিখ্যাত ছিল তার মসলিন, মখমল, রেশম ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য -যা সেদিন বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছিল।

সম্পদ বাড়লে চোর-ডাকাতদের উপদ্রবও বাড়ে। বাংলার সে সম্পদের প্রাচুর্যে আকর্ষিত হয় সূদুর ইউরোপীয় বণিক ও ডাকাতগণ। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজদের বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলি। আসে ডাকাতগণও। বাংলার বুকে তখন নিয়মিত ডাকাতি করতো পর্তুগিজ, মারাঠী ও মগ ডাকাতগণ। তখন বাংলার মুসলিম শাসকদের বেশীর ভাগ সময় ব্যয় হতো এই বিদেশী ডাকাত তাড়াতে। আর সবচেয়ে বড় ডাকাতি হয়ে যায় ইংরেজ ডাকাতদের হাতে। সেটি ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর প্রান্তরে; সেদিন পুরা দেশই ডাকাতি হয়ে যায়।

 

তাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, দেশের অর্থনীতিকে শুধু সমৃদ্ধ করলে চলে না, দেশের স্বাধীনতা ও সম্পদকে সুরক্ষিত করার যথাযথ সামরিক ব্যবস্থাও নিতে হয়। শক্তিশালী করতে হয় সেনাবাহিনীকে। নইলে সম্পদের প্রাচুর্য বিপদের কারণ হয়। বাংলার ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী হওয়ার কারণে সমগ্র এশিয়ার বুকে ব্রিটিশদের হাতে প্রথম অধিকৃত হয় সুবে বাংলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাবাহিনী এতোই দুর্বল ও এতোই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার ছিল যে, তার বাহিনী  ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয় রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর মাত্র ৪ হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে। সে পরাজয়ের ফলে ১৯০ বছরের জন্য নেমে আসে ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে নির্মম পরাধীনতা। বাংলার সে সম্পদে বলবান হয়ে বিস্তর সাম্রাজ্য বাড়াতে পেরেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি।

স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়ার জিহাদে ব্যর্থ হওয়ার আযাবটি অতি গুরুতর। সে আযাব আসে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি ও গোলামীর শিকল নিয়ে। দূষণ ঘটায় ধর্ম পালনে। ব্রিটিশের হাতে বাংলার জনগণ শুধু স্বাধীনতাই হারায়নি, বরং পরিণত হয়েছে দুর্ভিক্ষের দেশে। ব্রিটিশগণ শাসক হিসাবে আসেনি; এসেছিল ডাকাত রূপে। অধিকৃত দেশে শোষণ, লুন্ঠন ও নির্যাতন চালনা ছিল ব্রিটিশ দস্যুদের মূল নীতি। ভারতে মুসলিম বিজয়ের সাথে ইংরেজদের বিজয়ের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই। মুসলিম শাসকগণ তাদের নিজেদের ভাগ্যকে বাংলা বা ভারতের জনগণের ভাগ্যের সাথে একাত্ম করেছিল। ইংরেজ দস্যুদের মত তারা কখনোই এদেশের লুণ্ঠন করে মধ্য এশিয়ার পৈত্রিক ভূমিতে নিয়ে প্রাসাদ গড়েনি। নিজেদের জন্য যা কিছু গড়ার তা তারা বাংলা বা ভারতেই গড়েছে।

বাংলার ভাণ্ডার থেকে স্বর্ণ, রোপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী বিলেতে নিতে ইংরেজ দস্যুদের শত শত জাহাজের প্রয়োজন পড়েছিল। কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে তারা হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের কাছে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা কামাই করেছিল। আর কৃষকদের পরিণত করে ভূমিহীন প্রজাতে। জমিদারকে উচ্চহারে খাজনা দিয়ে কৃষকগণ জমির উপর চাষের অধিকার লাভ করতে হতো। প্রজাদের উপর ছিল শোষণ ও নির্যাতনের দুটি ভারী জোয়াল: একটি ব্রিটিশদের, অপরটি জমিদারদের। জমিদারগণ ছিল ইংরেজদের লাঠিয়াল। উভয়ের সীমাহীন শোষণ, লুণ্ঠন ও ব্যর্থ বাজার ব্যবস্থার ফলে ১৭৬৯-৭০য়ের সালে বাংলার বুকে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ -যাতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ইতিহাসে সেটি ছিয়াত্তরের মনন্তর রূপে পরিচিত। তবে সে দুর্ভিক্ষই একমাত্র দুর্ভিক্ষ ছিল না, ছোট বড় দুর্ভিক্ষ বাংলার মানুষের জীবনে প্রায়ই লেগে থাকতো। ১৯৪৩ সালে সৃষ্টি করা হয় আরেক ভয়নাক দুর্ভিক্ষ। বাংলার জন্য বরাদ্দ খাদ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিলের হুকুমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয রণাঙ্গণ পাঠানো হয়। বলা হয়ে থাকে সে দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।  

বাংলার বস্ত্র শিল্প ধ্বংসে দস্যু ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁতিদের আঙ্গুল কেটেছিল। বাংলার শিল্প ধ্বংসের লক্ষ্যে সে কাজটি তারা করেছিল নিজেদের অচল পণ্যের পসার বাড়ানোর লক্ষ্যে। বাণিজ্যিক মুনাফার স্বার্থে কৃষকদের বাধ্য করা হতো নীল চাষে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের নীল রংয়ের ব্যবসাকে শক্তিশালী করা এবং বাংলার বুকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ ছিল তাদের এক কুটিল কৌশল। কারণ, ব্রিটিশ ডাকাত শাসকগণ জানতো, জনগণের উপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিলে তাদের আর প্রতিরোধের সামর্থ্য থাকে না; এবং আগ্রহও গড়ে উঠে না। জনগণ তখন ব্যস্ত থাকে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। দুর্ভিক্ষকে এভাবে শত্রু শাসক পক্ষ হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতো। সে অভিন্ন কৌশলটি এখন ইসরাইল প্রয়োগ করছে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে।

মানুষ শিক্ষিত হলে তার মাঝে স্বাধীনতায় আগ্রহ জাগে। দখলদার ডাকাতগণ চায় জনগণকে নিরক্ষর রাখতে। সে লক্ষ্যে ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রকল্পটি ছিল সুপরিকল্পিত। মুসলিম শাসনামলে দেশের শতকরা ২০ ভাগের বেশী কৃষি জমি বরাদ্দ ছিল মসজিদ-মাদ্রাসার নামে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যাশিক্ষা ফ্রি ছিল। কিন্তু মসজিদ-মাদ্রাসার সে জমি কেড়ে নিয়ে জমিদারদের নামে বরাদ্দ হয়। এতে সরকারের বিপুল অর্থলাভ হয়। এবং অর্থাভাবে মাদ্রাসা-মকতবগুলি বন্ধ হয়ে যায়; এভাবে সফল হয় অর্থ লাভের সাথে জনগণকে নিরক্ষর বানানোর প্রকল্প। শিক্ষার নামে ব্রিটিশ বেনিয়ারা সামান্য যা কিছু করেছে তার মূল লক্ষ্য ছিল স্রেফ ব্রিটিশদের প্রশাসনের কাজে অনুগত চাকর-বাকর তৈরী করা। সেরূপ বৈরী শিক্ষা নীতির ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায় কালে স্বাক্ষরতার হার ভারতে শতকরা ১০ ভাগেরও কম ছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমদের নিজেদের ব্যর্থতাটিও কম নয়। তারা ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিপ্লবের ন্যায় ফরজ ইবাদত পালনে। সে ব্যর্থতার কারণে তাদেরকে ১৯০ বছর ব্রিটিশের গোলামীর ঘানি টানতে হয়েছে। 

 

বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় বিপ্লব

১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিম জীবনে আসে দ্বিতীয় রাজনৈতিক বিপ্লব। সেটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ইখিতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ঘটনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঙালি মুসলিমগণ। ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা পায় ঢাকাতে। বাংলা পরিণত হয় মুসলিম লীগের মূল ঘাঁটিতে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটির রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলার সুযোগই শুধু পায়নি, বরং সে সাথে পেয়েছিল ব্রিটিশ আমলে হারানো কৃষি জমির উপর মালিকানা। সেটি ১৯৫১ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে। ফলে জমির মালিকানা পেয়ে কৃষকের হাতে তখন অর্থের সঞ্চয় বাড়তে থাকে। ফলে কৃষক তার বাঁচার লড়াইয়ে সন্তানকে ব্রিটিশ আমলে কৃষিতে নামাতে যেরূপ বাধ্য হতো -তা থেকে মুক্তি পায়। সে একই কৃষক তার সন্তানকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো শুরু করে।  ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় শিক্ষার জোয়ার। আর শিক্ষা উন্নয়ন কখনো দেশে একাকী আসে না, সাথে আনে অর্থনৈতিক উন্নয়নও। শিক্ষার সাথে শুরু হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ ছিল সবচেয়ে বড় কল্যাণ।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কোন পাট কল ছিল না -যদিও পাট উৎপাদনে পূর্ব বাংলা ছিল বিশ্বে প্রথম।। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী পাট কল। স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী বস্ত্রকল। স্থাপিত হয় স্টিল মিল, কাগজের কল ও ঔষধ কারখানা। নির্মিত হয় অনেকগুলি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে উঠে অনেক গুলি ক্যাডেট কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। স্থাপিত হয় অস্ত্র কারখানা। পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের হার ভারত দূরে থাক, দক্ষিন কোরিয়ার চেয়েও ভাল ছিল। টাকার মূল্য ছিল ভারতীয় রুপীর চেয়ে অধিক। ষাটের দশকে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে পাকিস্তান চিত্রিত হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের মডেল রূপে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ আসতো উন্নয়নের সে পাকিস্তানী মডেল দেখতে। পাকিস্তানী সে মডেল অনুসরণ করে দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে গেছে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে অরাজকতা সৃষ্টির ফলে উন্নয়নের সে ধারা পাকিস্তান আর অব্যাহত রাখতে পারিনি। বাঙালি কম্যুনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী নেতাগণ অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের চিত্রিত করে জনগণের রক্তচোষা শত্রু রূপে। সে যুক্তি দেখিয়ে শুরু হয় শিল্পোন্নয়নের বিরুদ্ধে নাশকতা।

 

শত্রুর দ্বিতীয় বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়

ভারতের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীগণ পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর জনসংখ্যায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সে সাথে পারমানবিক শক্তিও। ফলে ভারতের ছিল প্রচণ্ড মুসলিম ভীতি এবং সে সাথে পাকিস্তান ভীতিও। ফলে দেশটির জন্মের পর থেকেই শুরু হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্র। আগ্রাসী ভারত দখল করে নেয় মুসলিম শাসিত হায়দারাবাদ, গোয়া ও মানভাদাড় রাজ্য। দখল করে নেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের বৃহ‌দাংশ। ভারতের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পাকিস্তান যোগ দেয় মার্কিন বলয়ে এবং শামিল হয় SEATO ও CENTO নামক নিরাপত্তা জোটে। এর ফলে পাকিস্তান পরিণত হয় সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের স্নায়ু যুদ্ধ, রাজনৈতিক যুদ্ধ ও সামরিক যুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গণে। ভারত যোগ দেয় সোভিয়েত শিবিরে ও সম্মিলিত ভাবে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙ্গার। ভারতীয় সে শিবিরে যোগ দেয় বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীগণ।

পাকিস্তানের বিনাশে শত্রুদের যুদ্ধটি ছিল ত্রিমুখী। সেক্যুলারিজম, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনজিমের পতাকাধারী দলগুলির আদর্শিক হামলাটি ছিল পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি প্যান-ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র শুরু হয় শিল্প ধ্বংসে। সে লক্ষ্যে এরা ট্রেড ইউনিয়নের নামে দুর্গ গড়ে প্রতিটি শিল্প করখানায়। দাবী আদায়ের নামে শ্রমিকদের উস্কে দেয় শিল্প কারখানা অচল করতে। ফলে নিরাপত্তা হারিয়ে পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে থাকে। অপরদিকে ভারতের সাথে কোয়ালিশন গড়ে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা। এ ষড়যন্ত্র প্রথম শুরু করে শেখ মুজিব -যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ষড়যন্ত্র করে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাগণ। সেসব ষড়যন্ত্র সফল না হওয়ায় শুরু হয়  ১৯৭১’য়ের সম্মিলিত সশস্ত্র যুদ্ধ। সোভিয়েত সাহায্যপ্রাপ্ত ভারত এ যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান অধিকৃত হয় ভারতের হাতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে প্রথম পরাজয়ের পর ১৯৭১’য়ে ঘটে বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়। ১৭৫৭’য়ে বিজয়ী হয়েছিল ইংরেজ বেনিয়াগণ। আর ১৯৭১’য়ে বিজয়ী হয় আগ্রাসী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। 

১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরের ভারতের বিজয়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে আবারো শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের ন্যায় শোষণ ও লুণ্ঠনের রাজত্ব। আবার ফিরে আসে ব্রিটিশ আমলের ন্যায় দুর্ভিক্ষ এবং ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন। যুদ্ধ শুরু হয় ইসলাম ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সে অধিকৃতির কারণে কবরে যেতে হয় গণতন্ত্র ও মৌলিক মানাধিকারকে। গড়ে উঠে বার বার গণহত্যা, পিল খানায় সেনা হত্যা, ফাঁসি, জেল-জুলুম ও আয়না ঘরের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। মুজিব আমলে বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি। ১৯৭৪’য়ে দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে দুর্বৃত্তিতে বাংলাদেশ ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। হাসিনা রেকর্ড গড়ে একদলীয় নির্বাচন ও ভোটডাকাতিতে।     

 

তৃতীয় বিপ্লব ও তৃতীয় স্বাধীনতা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবটি হলো ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয় এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের তৃতীয় বিজয়। এ বিজয় আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, RAB ও বিজিবি’র খুনিদের হাতে রক্ত দিয়েছে ১৪ শতের বেশী নিরপরাধ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ এবং আহত হয়েছে ২২ হাজারের বেশী। এ বিপ্লবের ফলে তৃতীয় বার স্বাধীনতা মিললো দেশবাসীর। আর স্বাধীনতা মানেই নতুন উদ্যোমে বেড়ে উঠার সুযোগ। এ বিপ্লব পুণরায় দোয়ার খুলে দিয়েছে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। তবে এ বিপ্লব শুধু মহা সুযোগই আনেনি; নতুন পরীক্ষাও এনেছে। বাঙালি মুসলিমের পুণরায় পরীক্ষা হবে তারা কতটুকু সমর্থ এ স্বাধীনতার সুরক্ষায়। স্বাধীনতার সুফল তো তারাই পায় যারা সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারে। মুসলিমের উপর ফরজ শুধু পরাধীনতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে স্বাধীনতা আনা নয়, বরং ফরজ হলো সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়া। 

বাঙালি মুসলিমে এবারের পরীক্ষাটি বিশাল। দুর্বৃত্ত হাসিনার শাসন বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ১৬ বছরের শাসন কালে সরকারের ভিতরে যে বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ে উঠেছিল -তা নির্মূল হয়নি। গলিত আবর্জনার মাঝে মশামাছি ও বিষাক্ত কীটগুলি যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি দুষ্ট রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের গভীরে বিপুল সংখ্যায় আজও বেঁচে আছে দুর্বৃত্তগণ। ৫ আগস্টের পর তারা গর্তে ঢুকেছে, কিন্তু তারা নির্মূল হয়নি। সুযোগ খুঁজছে বেরিয়ে আসার। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে শুধু দুর্বৃত্ত শাসককে নির্মূল করলে চলে না; নির্মূল করতে হয় ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের সকল দুর্বৃত্তদের। নইলে তারা আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়। এবং আবারো জন্ম দেয় ভোটডাকাতি, আয়না ঘর, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।

 

বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখায় জনগণের দায়

বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত সরকার পতনের কাজ বহুবার হয়েছে। কিন্তু পতিত দুর্বৃত্ত শাসক শক্তি বার বার পুরনো দুর্বৃত্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। ফলে ফিরে এসেছে শত্রু শক্তির নতুন অধিকৃতি। কারণ সরকারের গভীরে বসে থাকা দুর্বৃত্তির বীজ সরানোর কাজটি কোন বারই পূর্ণ ভাবে হয়নি। প্রতিটি বিপ্লবের পর ভিতরে রয়ে যায় প্রতি বিপ্লবের বীজ। সে সাথে নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নামার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরের শত্রুদের সাথে তাদের প্রভু বিদেশী শত্রু ভারত। কারণ শত্রুর যুদ্ধ কখনো শেষ হয়না, শুধু কৌশল ও রণাঙ্গণ পাল্টায় মাত্র।  

এজন্যই বিপ্লব সফল করতে হলে বিপ্লবের চেতনাকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয় এবং বাঁচিয়ে রাখতে হয় বিপ্লবের শত্রুদের নির্মূলের ধারাও। বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়ার নাম; একবার শুরু হলে সেটি যুগ যুগ চলে। সে প্রক্রিয়া থেমে গেলে সে বিপ্লবের মৃত্যু শুরু হয়। তাই নবীজী (সা:) যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা মক্কা বিজয়ের পর শেষ হয়নি। বরং মক্কা বিজয় সে বিপ্লবকে আরো বেগবান করেছিল। প্রকৃত বিপ্লব কখনোই কোন মৌসুমী বিষয় নয়, এটি আমৃত্য ধারণ করে বাঁচার বিষয়। সত্যিকার বিপ্লবীকে তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। সে চরিত্র ধারণ করতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সৈনিকদেরও। নইলে এ বিপ্লব সত্বর মারা যাবে।

 

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল সেটি ব্যর্থ হওয়ার কারণ, সে বিপ্লব অনেকের কাছেই মৌসুমী বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের কর্মীরা পাকিস্তানের সে প্যাান ইসলামী ধারণাকে ধরে রাখতে পারিনি। তারা নিজেদের কেবলা পাল্টিয়েছে। কেউ কম্যুনিস্ট, কেউ সেক্যুলারিস্ট এবং কেউ ফ্যাসিস্ট হয়েছে। যেমন মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা ভাষানীর মত অনেক মুসলিম লীগ নেতাই ইসলামের পতাকা দূরে ফেলে দিয়ে বাম ধারার লাল পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে। মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিব হাতে নিয়েছে বাঙালি ফ্যাসিবাদের পতাকা। একাত্তরে এদের সবাইকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে ময়দানে দেখা গেছে। ইসলামে বিভক্তি হারাম এবং একতা ফরজ। তারা বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। তাদের গাদ্দারীটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে। শয়তানকে খুশি করা এবং শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয় করাই তাদের রাজনীতিতে পরিণত হয়। ক্ষমতায় গিয়ে মুজিব তার গণতন্ত্রের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিলে আসল রূপে হাজির হয়। সে ভারতে কোলে গিয়ে উঠে। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দেয় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

প্রশ্ন হলো,বাংলাদেশে আজ কতজন রয়েছে এমন বিপ্লবী যারা আজীবন বাঁচতে চায় বিপ্লবের ভিশন ও মিশনকে ধারণ করে? যারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তা নেমেছিল তারা প্রকৃত বিপ্লবী নয়, তারা বরং স্বার্থান্বেষী। সেসব স্বার্থান্বেষীরা হাসিনার বিদায় ও কোটা বিলুপ্তির পর ঘুমিয়ে পড়বে বা বিদায় নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃত বিপ্লবী তো তারাই যারা রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তির পুরা অবকাঠামোকে আমূল পাল্টাতে বদ্ধপরিকর। সেরূপ আমূল পাল্টানোর কাজকে আরবীতে বলে ইনকিলাব। প্রকৃত বিপ্লবীদের মনে দর্শন কাজ করে, স্বার্থপরতা নয়। এবং যারা ঈমানদার তাদের সে দর্শনটি হলো পবিত্র কুর’আনের। পবিত্র কুর’আন হলো বস্তুত ইনকিলাবের টেক্সট বুক। কুর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঈমানদারগণ তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। এখানে কোন পার্থিব স্বার্থপরতা কাজ করে না। বরং কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে সে মহান রবকে খুশি করার তাড়না। একমাত্র এমন বিপ্লবীদের কাছেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অর্জনকে বাঁচিয়ে রাখা পবিত্র জিহাদ গণ্য হবে। সে জিহাদ নিয়ে না বাঁচলে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লবের ন্যায় বাঙালি মুসলিমের এ তৃতীয় বিপ্লবও নিশ্চিত ব্যর্থ হয়ে যাবে।  যারা বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত, তাদের মূল শঙ্কাটি এখানেই।   

 রাজনৈতিক বিপ্লব থেকেই জন্ম সকল বিপ্লবের

সকল বিপ্লবের শুরু রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে। রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে লাগাতর বিপ্লব শুরু হয় ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভূ-রাজনৈতিক, শিল্প ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে। এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সে রাজনৈতিক বিপ্লব -যা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করে। ঈমানদারের সে পবিত্র লড়াইকে ইসলামে জিহাদ বলা হয়। ব্যক্তি, সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে বদলিয়ে দেয়ার এটিই হলো মূল হাতিয়ার। যেখানে রাজনৈতিক বিপ্লবের সে প্রক্রিয়া তথা জিহাদ নাই, সেখানে চেপে বসে পর্বতের ন্যায় অনড় স্থবিরতা। তখন নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত যতই পালন করা হোক না কেন তাতে সে স্থবিরতা দূর হয় না; সমাজে বিপ্লবও আসে না। বিপ্লবের বিপরীতে যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বিপর্যয়টি হলো রাজনৈতিক বিপর্যয়। তখন সে বিপর্যয় থেকে জন্ম নেয় নানা রূপ ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।  তখন শুরু হয় দ্রুত নিচে নামা। এটি এক লাগাতর পতন প্রক্রিয়া। কোন জাতি কখনো মহামারি, খড়া, প্লাবন ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়না, বরং ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয় রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে। সে বিপর্যয় জাতীয় জীবনে জন্ম দেয় বিভক্তি, পরাজয়, পরাধীনতা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য।

সেক্যুলারিস্টদের কাছে রাজনীতি পেশা, সেবা বা কল্যাণ মূলক কাজ হলেও ইসলামে রয়েছে এর অতি উচ্চতর মর্যাদা। এটি শয়তান শক্তির এজেন্ডার বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার চুড়ান্ত লড়াই। মুসলিম উম্মাহর জীবনে এ রাজনৈতিক জিহাদ মুমিনের জীবনে চুড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। এ জিহাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, যার জীবনে জিহাদ নাই, নবীজী (সা:)’র যুগে তাকে মুনাফিক বলা হয়েছে। তখন সে মুনাফিকের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত কোন কাজ দেয় না, তার স্থান হয় জাহান্নামে। জিহাদে যোগ না দেয়াতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই রোজা রেখে এবং নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েও মুনাফিক হওয়া থেকে বাঁচেনি। 

যে জনগোষ্ঠি ব্যর্থ হয় রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে, তাদের শত শত বছর বাঁচতে হয় কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়াই। আরবগণ বহু হাজার বছর বেঁচেছে একই রূপ জাহিলিয়াত, গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও এবং রক্তাক্ত লড়াই নিয়ে। তাদের ছিল না কোন রাষ্ট্রীয় পরিচয়। ছিল না কোন ভূ-রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। কিন্তু সেই বিভক্ত আরবগণ রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় তৎকালীন যুগের দুটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করে সর্ববৃহৎ বিশ্ব শক্তি আবির্ভুত হয়। নানা নামে ও নানা ভাবে ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচার তো অনেক দেশেই হয়; আরবদের এ বিস্ময়কর সাফল্যের মূলে শুধু ধর্ম বিপ্লব ছিল না, ছিল নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সফল রাজনৈতিক বিপ্লব এবং সে বিপ্লবের শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে কাজ করে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র। নবীজী (সা:) যদি তাঁর মিশনকে শুধু ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারে সীমিত রাখতেন তবে কখনোই আরব ভূমিতে সেরূপ একটি সফল বিপ্লব কখনোই সম্ভব হতো না।

নবীজী (সা:) তাঁর জীবনের বেশী ভাগ সময় কাটিয়েছেন মক্কাতে। ধর্ম প্রচারে সেখানে তিনি ১৩টি বছর কাটিয়েছেন; কিন্তু সেখানে কোন রাজনৈতিক বিপ্লব আনতে পারেননি এবং প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি ইসলামী রাষ্ট্র। ফলে নির্মাণ করতে পারেননি ইসলামী বিপ্লবের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। সে দীর্ঘ ১৩ বছরে নবীজী (সা:) মাত্র কয়েক শত কাফিরকে মুসলিম বানাতে পেরেছিলেন। কিন্তু মদিনায় হিজরতে পর ইতিহাস পাল্টে যায়। সে কাঙ্খিত রাজনৈতিক বিপ্লবটি তখন সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র । রাষ্ট্র তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে ইসলামের দ্রুত প্রসারে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। মুসলিম ইতিহাসে নবীজী (সা:)‌’র সে হিজরত এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত থেকেই শুরু হয়েছে নতুন যুগের সূচনা। শুরু হয়েছে ইসলামী সভ্যতা নির্মাণের কাজ। সাহাবাগণ হিজরতের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই হিজরত থেকে শুরু হয়েছে হিজরী সাল গণনার সূচনা। 

 

প্রতিটি বিপ্লবের পিছনে রাজনৈতিক দর্শন ও এজেন্ডা কাজ করে। নবীজী (সা:)’র নেতৃত্বে সংঘটিত সে রাজনৈতিক বিপ্লবের মূলে  ছিল কুর’আনী জ্ঞান ও দর্শন; এবং সে বিপ্লবের মূল এজেন্ডাটি ছিল মহান রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। সেদিন সে বিপ্লব সাধিত না হলে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়া বিধান এবং দুর্বৃত্তি নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কুর’আনী এজেন্ডা কিতাবেই থেকে যেত।  ইসলামের সে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে পৃথিবীর বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে অব্যাহত রাখার কাজে হাতিয়ার রূপে কাজ করে ইসলামী রাষ্ট্র।  নবীজী (সা:) ১০টি বছর যে রাষ্ট্রের চালকে আসনে বসে ইসলামকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে যান। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর সে শাসনে বসেন তার হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ। পরবর্তীতে সে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর জন্ম নেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা -যা ইতিহাসের পরিচিতি পায় ইসলামী সভ্যতা রূপে।  

প্রতিটি বিপ্লবেরই পরই প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা শুরু হয়। তাই বিপ্লবকে শুধু শুরু করলে চলে না, বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ও প্রতিটি ঈমানদারকে নিতে হয়। এ কাজটিও জিহাদ। বিপ্লব করা যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন হলো সে বিপ্লব বাঁচিয়ে রাখা। বিপ্লব করতে যেমন রক্ত দিতে হয়, তেমনি বিপ্লব বাঁচাতেও রক্ত দিতে হয়। ইসলামের ইতিহাসে বিপ্লব বাঁচতে বরং বেশী রক্ত দিতে হয়েছে। বিপ্লব সংঘটিত করতে ও বাঁচাতে অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর রাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয় বিশাল আকারের বিদ্রোহ। আবির্ভাব হয় বহু মিথ্যা নবীর। বিদ্রোহ হয় যাকাতের ন্যায় ইসলামের মৌলিক বিধানের বিরুদ্ধে। হযরত আবু বকর (রা:) অতি সফল ভাবে সে প্রতিবিপ্লব নির্মূল করতে সফল হয়েছিলেন; ফলে অব্যাহত থাকে ইসলামের বিপ্লবের ধারা। কিন্তু ইয়াজিদের নেতৃত্বে যে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়, সে প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধে মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাঁচেনি নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত বিশুদ্ধ ইসলাম। প্রতিষ্ঠা পায় জাহিলী যুগের রাজতন্ত্র।  

 

বাঙালি মুসলিমের প্রথম বিপ্লব এবং প্রথম পরাধীনতা

বাংলার বুকে ইসলামের পক্ষে প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লবটি ঘটে ত্রয়দশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের ফলে। সে মুসলিম বিজয় বাংলার বুকে শুধু শাসক পাল্টায়নি, বরং বিপ্লব এনেছিল বাঙালি জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও। বস্তুত সেটিই হলো বঙ্গীয় বদ্বীপে বসবাসকারী জনগণের জীবনে প্রথম বিপ্লব। এর আগে বাঙালিদের হাজারো বছর বাঁচতে হয়েছে পৌত্তলিকতার সনাতন অজ্ঞতা, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশাপ নিয়ে। সেটি ছিল এক দীর্ঘকালিন স্থবিরতা। বাংলার বুকে ইসলামের আগমন এবং মুসলিম শাসনের শুরু হওয়াতে বাংলার মেধাবী ও পরিশ্রমী জনগণ পায় নিজ সামর্থ্যের পূর্ণ বিনিয়োগের পক্ষে এক সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ। ফলে দ্রুত বিপ্লব আসে বাংলার কৃষি, কুঠির শিল্প ও বাণিজ্যে। বাংলা দ্রুত পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে। পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের হিসাব মতে ১৭০০ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামালে বিশ্বের মোট জিডিপির শতকরা ২৬ ভাগ জোগান দিত ভারতীয় উপমহাদেশ। আর সে ভারতীয় জিডিপির অর্ধেকের বেশী জোগান দিত সুবে বাংলা একাই। মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হতো সুবে বাংলা থেকে। তৎকালে বাংলা বিখ্যাত ছিল তার মসলিন, মখমল, রেশম ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য -যা সেদিন বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার পেয়েছিল।

সম্পদ বাড়লে চোর-ডাকাতদের উপদ্রবও বাড়ে। বাংলার সে সম্পদের প্রাচুর্যে আকর্ষিত হয় সূদুর ইউরোপীয় বণিক ও ডাকাতগণ। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজদের বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলি। আসে ডাকাতগণও। বাংলার বুকে তখন নিয়মিত ডাকাতি করতো পর্তুগিজ, মারাঠী ও মগ ডাকাতগণ। তখন বাংলার মুসলিম শাসকদের বেশীর ভাগ সময় ব্যয় হতো এই বিদেশী ডাকাত তাড়াতে। আর সবচেয়ে বড় ডাকাতি হয়ে যায় ইংরেজ ডাকাতদের হাতে। সেটি ১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর প্রান্তরে; সেদিন পুরা দেশই ডাকাতি হয়ে যায়।

 

তাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, দেশের অর্থনীতিকে শুধু সমৃদ্ধ করলে চলে না, দেশের স্বাধীনতা ও সম্পদকে সুরক্ষিত করার যথাযথ সামরিক ব্যবস্থাও নিতে হয়। শক্তিশালী করতে হয় সেনাবাহিনীকে। নইলে সম্পদের প্রাচুর্য বিপদের কারণ হয়। বাংলার ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী হওয়ার কারণে সমগ্র এশিয়ার বুকে ব্রিটিশদের হাতে প্রথম অধিকৃত হয় সুবে বাংলা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাবাহিনী এতোই দুর্বল ও এতোই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার ছিল যে, তার বাহিনী  ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয় রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানীর মাত্র ৪ হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে। সে পরাজয়ের ফলে ১৯০ বছরের জন্য নেমে আসে ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে নির্মম পরাধীনতা। বাংলার সে সম্পদে বলবান হয়ে বিস্তর সাম্রাজ্য বাড়াতে পেরেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি।

স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়ার জিহাদে ব্যর্থ হওয়ার আযাবটি অতি গুরুতর। সে আযাব আসে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি ও গোলামীর শিকল নিয়ে। দূষণ ঘটায় ধর্ম পালনে। ব্রিটিশের হাতে বাংলার জনগণ শুধু স্বাধীনতাই হারায়নি, বরং পরিণত হয়েছে দুর্ভিক্ষের দেশে। ব্রিটিশগণ শাসক হিসাবে আসেনি; এসেছিল ডাকাত রূপে। অধিকৃত দেশে শোষণ, লুন্ঠন ও নির্যাতন চালনা ছিল ব্রিটিশ দস্যুদের মূল নীতি। ভারতে মুসলিম বিজয়ের সাথে ইংরেজদের বিজয়ের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই। মুসলিম শাসকগণ তাদের নিজেদের ভাগ্যকে বাংলা বা ভারতের জনগণের ভাগ্যের সাথে একাত্ম করেছিল। ইংরেজ দস্যুদের মত তারা কখনোই এদেশের লুণ্ঠন করে মধ্য এশিয়ার পৈত্রিক ভূমিতে নিয়ে প্রাসাদ গড়েনি। নিজেদের জন্য যা কিছু গড়ার তা তারা বাংলা বা ভারতেই গড়েছে।

বাংলার ভাণ্ডার থেকে স্বর্ণ, রোপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী বিলেতে নিতে ইংরেজ দস্যুদের শত শত জাহাজের প্রয়োজন পড়েছিল। কৃষকদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে তারা হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের কাছে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা কামাই করেছিল। আর কৃষকদের পরিণত করে ভূমিহীন প্রজাতে। জমিদারকে উচ্চহারে খাজনা দিয়ে কৃষকগণ জমির উপর চাষের অধিকার লাভ করতে হতো। প্রজাদের উপর ছিল শোষণ ও নির্যাতনের দুটি ভারী জোয়াল: একটি ব্রিটিশদের, অপরটি জমিদারদের। জমিদারগণ ছিল ইংরেজদের লাঠিয়াল। উভয়ের সীমাহীন শোষণ, লুণ্ঠন ও ব্যর্থ বাজার ব্যবস্থার ফলে ১৭৬৯-৭০য়ের সালে বাংলার বুকে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ -যাতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ইতিহাসে সেটি ছিয়াত্তরের মনন্তর রূপে পরিচিত। তবে সে দুর্ভিক্ষই একমাত্র দুর্ভিক্ষ ছিল না, ছোট বড় দুর্ভিক্ষ বাংলার মানুষের জীবনে প্রায়ই লেগে থাকতো। ১৯৪৩ সালে সৃষ্টি করা হয় আরেক ভয়নাক দুর্ভিক্ষ। বাংলার জন্য বরাদ্দ খাদ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিলের হুকুমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয রণাঙ্গণ পাঠানো হয়। বলা হয়ে থাকে সে দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।  

বাংলার বস্ত্র শিল্প ধ্বংসে দস্যু ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁতিদের আঙ্গুল কেটেছিল। বাংলার শিল্প ধ্বংসের লক্ষ্যে সে কাজটি তারা করেছিল নিজেদের অচল পণ্যের পসার বাড়ানোর লক্ষ্যে। বাণিজ্যিক মুনাফার স্বার্থে কৃষকদের বাধ্য করা হতো নীল চাষে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের নীল রংয়ের ব্যবসাকে শক্তিশালী করা এবং বাংলার বুকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ ছিল তাদের এক কুটিল কৌশল। কারণ, ব্রিটিশ ডাকাত শাসকগণ জানতো, জনগণের উপর দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দিলে তাদের আর প্রতিরোধের সামর্থ্য থাকে না; এবং আগ্রহও গড়ে উঠে না। জনগণ তখন ব্যস্ত থাকে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। দুর্ভিক্ষকে এভাবে শত্রু শাসক পক্ষ হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতো। সে অভিন্ন কৌশলটি এখন ইসরাইল প্রয়োগ করছে ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে।

মানুষ শিক্ষিত হলে তার মাঝে স্বাধীনতায় আগ্রহ জাগে। দখলদার ডাকাতগণ চায় জনগণকে নিরক্ষর রাখতে। সে লক্ষ্যে ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রকল্পটি ছিল সুপরিকল্পিত। মুসলিম শাসনামলে দেশের শতকরা ২০ ভাগের বেশী কৃষি জমি বরাদ্দ ছিল মসজিদ-মাদ্রাসার নামে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যাশিক্ষা ফ্রি ছিল। কিন্তু মসজিদ-মাদ্রাসার সে জমি কেড়ে নিয়ে জমিদারদের নামে বরাদ্দ হয়। এতে সরকারের বিপুল অর্থলাভ হয়। এবং অর্থাভাবে মাদ্রাসা-মকতবগুলি বন্ধ হয়ে যায়; এভাবে সফল হয় অর্থ লাভের সাথে জনগণকে নিরক্ষর বানানোর প্রকল্প। শিক্ষার নামে ব্রিটিশ বেনিয়ারা সামান্য যা কিছু করেছে তার মূল লক্ষ্য ছিল স্রেফ ব্রিটিশদের প্রশাসনের কাজে অনুগত চাকর-বাকর তৈরী করা। সেরূপ বৈরী শিক্ষা নীতির ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায় কালে স্বাক্ষরতার হার ভারতে শতকরা ১০ ভাগেরও কম ছিল। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমদের নিজেদের ব্যর্থতাটিও কম নয়। তারা ব্যর্থ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিপ্লবের ন্যায় ফরজ ইবাদত পালনে। সে ব্যর্থতার কারণে তাদেরকে ১৯০ বছর ব্রিটিশের গোলামীর ঘানি টানতে হয়েছে। 

 

বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় বিপ্লব

১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিম জীবনে আসে দ্বিতীয় রাজনৈতিক বিপ্লব। সেটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ইখিতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ঘটনা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঙালি মুসলিমগণ। ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা পায় ঢাকাতে। বাংলা পরিণত হয় মুসলিম লীগের মূল ঘাঁটিতে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমগণ শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটির রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলার সুযোগই শুধু পায়নি, বরং সে সাথে পেয়েছিল ব্রিটিশ আমলে হারানো কৃষি জমির উপর মালিকানা। সেটি ১৯৫১ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে। ফলে জমির মালিকানা পেয়ে কৃষকের হাতে তখন অর্থের সঞ্চয় বাড়তে থাকে। ফলে কৃষক তার বাঁচার লড়াইয়ে সন্তানকে ব্রিটিশ আমলে কৃষিতে নামাতে যেরূপ বাধ্য হতো -তা থেকে মুক্তি পায়। সে একই কৃষক তার সন্তানকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো শুরু করে।  ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় শিক্ষার জোয়ার। আর শিক্ষা উন্নয়ন কখনো দেশে একাকী আসে না, সাথে আনে অর্থনৈতিক উন্নয়নও। শিক্ষার সাথে শুরু হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এ ছিল সবচেয়ে বড় কল্যাণ।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কোন পাট কল ছিল না -যদিও পাট উৎপাদনে পূর্ব বাংলা ছিল বিশ্বে প্রথম।। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী পাট কল। স্থাপিত হয় ৬০টির বেশী বস্ত্রকল। স্থাপিত হয় স্টিল মিল, কাগজের কল ও ঔষধ কারখানা। নির্মিত হয় অনেকগুলি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে উঠে অনেক গুলি ক্যাডেট কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। স্থাপিত হয় অস্ত্র কারখানা। পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের হার ভারত দূরে থাক, দক্ষিন কোরিয়ার চেয়েও ভাল ছিল। টাকার মূল্য ছিল ভারতীয় রুপীর চেয়ে অধিক। ষাটের দশকে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে পাকিস্তান চিত্রিত হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের মডেল রূপে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ আসতো উন্নয়নের সে পাকিস্তানী মডেল দেখতে। পাকিস্তানী সে মডেল অনুসরণ করে দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে গেছে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে অরাজকতা সৃষ্টির ফলে উন্নয়নের সে ধারা পাকিস্তান আর অব্যাহত রাখতে পারিনি। বাঙালি কম্যুনিস্ট ও ফ্যাসিবাদী নেতাগণ অবাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের চিত্রিত করে জনগণের রক্তচোষা শত্রু রূপে। সে যুক্তি দেখিয়ে শুরু হয় শিল্পোন্নয়নের বিরুদ্ধে নাশকতা।

 

শত্রুর দ্বিতীয় বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়

ভারতের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদীগণ পাকিস্তানের সৃষ্টি যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর জনসংখ্যায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সে সাথে পারমানবিক শক্তিও। ফলে ভারতের ছিল প্রচণ্ড মুসলিম ভীতি এবং সে সাথে পাকিস্তান ভীতিও। ফলে দেশটির জন্মের পর থেকেই শুরু হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্র। আগ্রাসী ভারত দখল করে নেয় মুসলিম শাসিত হায়দারাবাদ, গোয়া ও মানভাদাড় রাজ্য। দখল করে নেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের বৃহ‌দাংশ। ভারতের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পাকিস্তান যোগ দেয় মার্কিন বলয়ে এবং শামিল হয় SEATO ও CENTO নামক নিরাপত্তা জোটে। এর ফলে পাকিস্তান পরিণত হয় সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের স্নায়ু যুদ্ধ, রাজনৈতিক যুদ্ধ ও সামরিক যুদ্ধের উত্তপ্ত রণাঙ্গণে। ভারত যোগ দেয় সোভিয়েত শিবিরে ও সম্মিলিত ভাবে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভাঙ্গার। ভারতীয় সে শিবিরে যোগ দেয় বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীগণ।

পাকিস্তানের বিনাশে শত্রুদের যুদ্ধটি ছিল ত্রিমুখী। সেক্যুলারিজম, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনজিমের পতাকাধারী দলগুলির আদর্শিক হামলাটি ছিল পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি প্যান-ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র শুরু হয় শিল্প ধ্বংসে। সে লক্ষ্যে এরা ট্রেড ইউনিয়নের নামে দুর্গ গড়ে প্রতিটি শিল্প করখানায়। দাবী আদায়ের নামে শ্রমিকদের উস্কে দেয় শিল্প কারখানা অচল করতে। ফলে নিরাপত্তা হারিয়ে পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে থাকে। অপরদিকে ভারতের সাথে কোয়ালিশন গড়ে শুরু হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা। এ ষড়যন্ত্র প্রথম শুরু করে শেখ মুজিব -যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ষড়যন্ত্র করে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাগণ। সেসব ষড়যন্ত্র সফল না হওয়ায় শুরু হয়  ১৯৭১’য়ের সম্মিলিত সশস্ত্র যুদ্ধ। সোভিয়েত সাহায্যপ্রাপ্ত ভারত এ যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান অধিকৃত হয় ভারতের হাতে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে প্রথম পরাজয়ের পর ১৯৭১’য়ে ঘটে বাঙালি মুসলিমের দ্বিতীয় পরাজয়। ১৭৫৭’য়ে বিজয়ী হয়েছিল ইংরেজ বেনিয়াগণ। আর ১৯৭১’য়ে বিজয়ী হয় আগ্রাসী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা। 

১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বরের ভারতের বিজয়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে আবারো শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের ন্যায় শোষণ ও লুণ্ঠনের রাজত্ব। আবার ফিরে আসে ব্রিটিশ আমলের ন্যায় দুর্ভিক্ষ এবং ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন। যুদ্ধ শুরু হয় ইসলাম ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ভারতীয় সে অধিকৃতির কারণে কবরে যেতে হয় গণতন্ত্র ও মৌলিক মানাধিকারকে। গড়ে উঠে বার বার গণহত্যা, পিল খানায় সেনা হত্যা, ফাঁসি, জেল-জুলুম ও আয়না ঘরের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। মুজিব আমলে বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি। ১৯৭৪’য়ে দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে দুর্বৃত্তিতে বাংলাদেশ ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। হাসিনা রেকর্ড গড়ে একদলীয় নির্বাচন ও ভোটডাকাতিতে।     

 

তৃতীয় বিপ্লব ও তৃতীয় স্বাধীনতা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবটি হলো ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয় এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের তৃতীয় বিজয়। এ বিজয় আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, RAB ও বিজিবি’র খুনিদের হাতে রক্ত দিয়েছে ১৪ শতের বেশী নিরপরাধ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ এবং আহত হয়েছে ২২ হাজারের বেশী। এ বিপ্লবের ফলে তৃতীয় বার স্বাধীনতা মিললো দেশবাসীর। আর স্বাধীনতা মানেই নতুন উদ্যোমে বেড়ে উঠার সুযোগ। এ বিপ্লব পুণরায় দোয়ার খুলে দিয়েছে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের। তবে এ বিপ্লব শুধু মহা সুযোগই আনেনি; নতুন পরীক্ষাও এনেছে। বাঙালি মুসলিমের পুণরায় পরীক্ষা হবে তারা কতটুকু সমর্থ এ স্বাধীনতার সুরক্ষায়। স্বাধীনতার সুফল তো তারাই পায় যারা সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দিতে পারে। মুসলিমের উপর ফরজ শুধু পরাধীনতার বিলুপ্তি ঘটিয়ে স্বাধীনতা আনা নয়, বরং ফরজ হলো সে স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়া। 

বাঙালি মুসলিমে এবারের পরীক্ষাটি বিশাল। দুর্বৃত্ত হাসিনার শাসন বিলুপ্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার ১৬ বছরের শাসন কালে সরকারের ভিতরে যে বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ে উঠেছিল -তা নির্মূল হয়নি। গলিত আবর্জনার মাঝে মশামাছি ও বিষাক্ত কীটগুলি যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি দুষ্ট রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের গভীরে বিপুল সংখ্যায় আজও বেঁচে আছে দুর্বৃত্তগণ। ৫ আগস্টের পর তারা গর্তে ঢুকেছে, কিন্তু তারা নির্মূল হয়নি। সুযোগ খুঁজছে বেরিয়ে আসার। সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজে শুধু দুর্বৃত্ত শাসককে নির্মূল করলে চলে না; নির্মূল করতে হয় ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের সকল দুর্বৃত্তদের। নইলে তারা আরেক ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়। এবং আবারো জন্ম দেয় ভোটডাকাতি, আয়না ঘর, গুম, খুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের।

 

বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখায় জনগণের দায়

বাংলাদেশে দুর্বৃত্ত সরকার পতনের কাজ বহুবার হয়েছে। কিন্তু পতিত দুর্বৃত্ত শাসক শক্তি বার বার পুরনো দুর্বৃত্তি নিয়ে ফিরে এসেছে। ফলে ফিরে এসেছে শত্রু শক্তির নতুন অধিকৃতি। কারণ সরকারের গভীরে বসে থাকা দুর্বৃত্তির বীজ সরানোর কাজটি কোন বারই পূর্ণ ভাবে হয়নি। প্রতিটি বিপ্লবের পর ভিতরে রয়ে যায় প্রতি বিপ্লবের বীজ। সে সাথে নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নামার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘরের শত্রুদের সাথে তাদের প্রভু বিদেশী শত্রু ভারত। কারণ শত্রুর যুদ্ধ কখনো শেষ হয়না, শুধু কৌশল ও রণাঙ্গণ পাল্টায় মাত্র।  

এজন্যই বিপ্লব সফল করতে হলে বিপ্লবের চেতনাকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয় এবং বাঁচিয়ে রাখতে হয় বিপ্লবের শত্রুদের নির্মূলের ধারাও। বিপ্লব একটি চলমান প্রক্রিয়ার নাম; একবার শুরু হলে সেটি যুগ যুগ চলে। সে প্রক্রিয়া থেমে গেলে সে বিপ্লবের মৃত্যু শুরু হয়। তাই নবীজী (সা:) যে বিপ্লব শুরু করেছিলেন তা মক্কা বিজয়ের পর শেষ হয়নি। বরং মক্কা বিজয় সে বিপ্লবকে আরো বেগবান করেছিল। প্রকৃত বিপ্লব কখনোই কোন মৌসুমী বিষয় নয়, এটি আমৃত্য ধারণ করে বাঁচার বিষয়। সত্যিকার বিপ্লবীকে তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। সে চরিত্র ধারণ করতে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সৈনিকদেরও। নইলে এ বিপ্লব সত্বর মারা যাবে।

 

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল সেটি ব্যর্থ হওয়ার কারণ, সে বিপ্লব অনেকের কাছেই মৌসুমী বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের কর্মীরা পাকিস্তানের সে প্যাান ইসলামী ধারণাকে ধরে রাখতে পারিনি। তারা নিজেদের কেবলা পাল্টিয়েছে। কেউ কম্যুনিস্ট, কেউ সেক্যুলারিস্ট এবং কেউ ফ্যাসিস্ট হয়েছে। যেমন মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা ভাষানীর মত অনেক মুসলিম লীগ নেতাই ইসলামের পতাকা দূরে ফেলে দিয়ে বাম ধারার লাল পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে। মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিব হাতে নিয়েছে বাঙালি ফ্যাসিবাদের পতাকা। একাত্তরে এদের সবাইকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে ময়দানে দেখা গেছে। ইসলামে বিভক্তি হারাম এবং একতা ফরজ। তারা বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। তাদের গাদ্দারীটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে। শয়তানকে খুশি করা এবং শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয় করাই তাদের রাজনীতিতে পরিণত হয়। ক্ষমতায় গিয়ে মুজিব তার গণতন্ত্রের মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিলে আসল রূপে হাজির হয়। সে ভারতে কোলে গিয়ে উঠে। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দেয় এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।

প্রশ্ন হলো,বাংলাদেশে আজ কতজন রয়েছে এমন বিপ্লবী যারা আজীবন বাঁচতে চায় বিপ্লবের ভিশন ও মিশনকে ধারণ করে? যারা শুধু কোটা সংস্কারের দাবী নিয়ে রাস্তা নেমেছিল তারা প্রকৃত বিপ্লবী নয়, তারা বরং স্বার্থান্বেষী। সেসব স্বার্থান্বেষীরা হাসিনার বিদায় ও কোটা বিলুপ্তির পর ঘুমিয়ে পড়বে বা বিদায় নিবে -সেটিই স্বাভাবিক। প্রকৃত বিপ্লবী তো তারাই যারা রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তির পুরা অবকাঠামোকে আমূল পাল্টাতে বদ্ধপরিকর। সেরূপ আমূল পাল্টানোর কাজকে আরবীতে বলে ইনকিলাব। প্রকৃত বিপ্লবীদের মনে দর্শন কাজ করে, স্বার্থপরতা নয়। এবং যারা ঈমানদার তাদের সে দর্শনটি হলো পবিত্র কুর’আনের। পবিত্র কুর’আন হলো বস্তুত ইনকিলাবের টেক্সট বুক। কুর’আনী জ্ঞানে সমৃদ্ধ ঈমানদারগণ তাই আমৃত্যু বিপ্লবী। এখানে কোন পার্থিব স্বার্থপরতা কাজ করে না। বরং কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে সে মহান রবকে খুশি করার তাড়না। একমাত্র এমন বিপ্লবীদের কাছেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অর্জনকে বাঁচিয়ে রাখা পবিত্র জিহাদ গণ্য হবে। সে জিহাদ নিয়ে না বাঁচলে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লবের ন্যায় বাঙালি মুসলিমের এ তৃতীয় বিপ্লবও নিশ্চিত ব্যর্থ হয়ে যাবে।  যারা বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত, তাদের মূল শঙ্কাটি এখানেই।