প্রসঙ্গ – নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন

- Update Time : ০১:৪৪:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৮ জুন ২০২৫
- / ১৬১ Time View
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের কাছে নারী অধিকার রক্ষায় বিশদ
সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য
বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের পথে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নারীবিষয়ক সংস্কার
কমিশনে যা যা সুপারিশ করেছে, তা নিঃসন্দেহে নারীর অগ্রযাত্রার পথে সহায়ক। অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে
সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ
জারি করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এছাড়া আছে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ
হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা। শ্রম
আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা। সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি
দেওয়ার সুপারিশ। আমরা জানি “ইসলাম ধর্মে ইনসাফ খুব গুরুত্বপূর্ন শব্দ "। এই সত্যটি সকলকে মানতেই হবে। শুধু
মুসলমানদের জন্য না, এই আইন সকল ধর্মের মানুষের জন্য হওয়া দরকার। বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই সিভিল ল’
আছে, আবার শরীয়া আইনও আছে। যে পরিবার, যেভাবে সুবিধা পাবেন, তারা সেভাবেই সম্পত্তি ভাগ করবেন। সংবিধান ও
আইনগত কাঠামো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সুপারিশের মধ্যে আরও কয়েকটি ইতিবাচক প্রসঙ্গ তুলে আনা
হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন এবং
মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০ ভাগ নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ
নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে
জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করাসহ আরো কিছু সুপারিশমালা পেশ করা
হয়েছ। আমাদের দেশে ২০২০ সাল থেকে বাল্যবিবাহ প্রকটভাবে বাড়ছে। গত নয় মাসে প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে
বাল্যবিবাহ অনেক বেড়ে গেছে। গ্রামেগঞ্জে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিয়ে ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার
হার বেশি। সরকার ভোটদানের বয়স ১৬ করার কথা ভাবছেন, সেখানে বাল্যবিয়ের বয়স ১৮ থাকে কীভাবে ?এগুলোই
সংস্কারের বিষয়। ৩/৪ বছর আগে টাঙ্গাইলে ১৩ বছরের একজন কিশোরী মধ্যবয়স্ক স্বামীর সহবাসের বলি হয়ে নিহত
হয়েছিল। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, যেখানে মেয়েরা স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ
পরিবার, সমাজ কর্তারা একথা মানতেই চায় না। তারা মনে করেন, স্বামী তার স্ত্রীকে যখন যেমন ইচ্ছা তেমন ভোগ
করবে। স্বামী আবার ধর্ষণ করে কীভাবে? এটা অপরাধ হতেই পারে না। এই ভুল ধারণা থেকে পরিবার ও সমাজকে
সরিয়ে আনা খুব কঠিন। ধর্মভিত্তিক দলগুলো মনে করছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোয় ইসলামি
শরিয়াহভিত্তিক পারিবারিক বিধানকে চরমভাবে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করা হয়েছে। সুপারিশে থাকা ‘অভিন্ন পারিবারিক
আইন’ এর মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার নামে
ইসলামের বিধানকে বাতিল করে পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা বলেও মনে করছে। অভিন্ন
পারিবারিক আইন তৈরির প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
অন্যদিকে এই সরকারের উপর ভরসা রেখে নারী সংস্কার কমিশন সুপারিশ পেশ করেছে, দেখা যাক সরকার কার কথা
শোনে। যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে দেড় দশকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একনায়ক শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী
সরকারের পতন, তার অন্যতম কুশীলব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার
দাম্ভিক উক্তি– ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাবে, নাকি রাজাকারের সন্তানরা পাবে?’ এই কথার উত্তরে
মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে হাজার হাজার ছাত্রীর বজ্রকণ্ঠ উচ্চারণ স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে তোলে– ‘তুমি কে
আমি কে?/ রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে?/ স্বৈরাচার/ স্বৈরাচার।’ সেই প্রথম দুঃশাসককে সরাসরি
‘স্বৈরাচার’ হিসেবে শনাক্ত করবার স্পর্ধা দেখায় এ দেশের ছাত্রীরা; তথা নারীরা। তারপর ৫ আগস্ট পর্যন্ত
গণআন্দোলনে সম্মুখসারিতে ছিলেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা; তখন কারও মনে বা মাথায় আসেনি,
কে হিজাব পরে মিছিলে আছে কিংবা কে টপস আর জিন্স পরে স্লোগান দিচ্ছে? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একাকার সেই
মিছিলে সকলে সম্মিলিত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর! কেবল ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এর
আগের পরের সকল গণআন্দোলনে নারীর ভূমিকা সবসময় অগ্রগণ্যই শুধু নয়, ত্যাগ ও মহত্ত্বে বরাবর তা অতুলনীয়।
দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে সব শ্রেণি-পেশার নারী শ্রম, সময় ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসামান্য
ভূমিকা রাখছেন। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়; সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নানা পরম্পরা আঁকড়ে
ধরে রাখে। যারা দায়িত্বে থাকেন, সংস্কার বাস্তবায়ন করতে চান; তাদের উচিত এগুলোকে সংবেদনশীলনতার সঙ্গে বুঝে
সকলের মধ্যে সম্মিলিত ‘স্পেস’ বা ‘নিঃশ্বাস নেবার জায়গা’ বের করা। চাপিয়ে না দিয়ে বরং আলোচনা ও যুক্তির
মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করতে হবে। এদিকে রাজু ভাস্কর্যের পাশে, হুজুরেরা নারীর কুশপুত্তলিকা তৈরী করে সেটাকে
ইচ্ছামতো পিটিয়েছে। এটা করা হয়েছে সরকারের নারী বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ এবং নারীর
ক্ষমতায়নের জন্য কমিশন যে সুপারিশগুলো করেছে তার প্রতিবাদ হিসেবে। হুজুরদের বক্তব্য, নারীদের কিছুতেই
পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া যাবেনা, তাদের ভাষ্য ইসলাম সেটার অনুমোদন দেয়না। নারীর কুশপুত্তিকার উপর
হুজুররা যেভাবে হামলা করেছে, এতটা হিংস্রতা মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের সময়ও লক্ষ করা যায়না। তাদের
কেউ ইচ্ছামতো লাত্থি, কিল, ঘুসি দিয়েছে, কেউ জুতা দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ভালো করে মেরেছে, কেউবা
লাঠি দিয়ে ঘরের বৌ মনেকরে পিটিয়ে গায়ের ঝাল মিটিয়েছে। পেটানো শেষ হলে কুশপুত্তলিকার গলায় দড়ি বেঁধে
ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জানি না এসব ঘটনা ইসলামে ও মানবিক দৃষ্টিতে কতটুকু শুদ্ধ হয়েছে। বিশেষভাবে শান্তিতে
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস– তাঁর দীর্ঘ ও সফল জীবনের বেশির ভাগ সময় দেশের তৃণমূলের নারীর জীবনমান
উন্নয়নে কাজ করেছেন, বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আশা করি দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় ও ইনসাফ মতে
ফায়সালা করবেন।