০৪:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৫ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

জনপ্রতিনিধিরাও করছেন মাটি ব্যবসা’ সোনাইমুড়ীর ফসলি জমিতে মাটিখেকোদের থাবা

Reporter Name
  • Update Time : ০৫:৩৮:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫
  • / ১৬৪ Time View
মোহাম্মদ  হানিফ, (নোয়াখালী): প্রতিনিধি : রাতের আধারে উধাও হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমির মাটি (টপ সয়েল)। কোথাও তিন ফুট, কোথাও পাঁচ ফুট গভীর করে একরের পর একর ফসলি জমি কেটে নিয়ে যাচ্ছে মাটিখেকোরা। শীত মৌসুমের পর থেকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা জুড়ে চলছে মাটি ব্যবসায়ীদের এই মচ্ছব। ফলে একদিকে ভয়াবহ হুমকির মুখে আবাদি জমি অন্যদিকে মাটি পরিবহনের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীন সড়ক। এছাড়া পরিবহনের সময় রাস্তায় ছিটকে পড়া মাটি পিষ্ট হয়ে ধুলায় পরিনত হয়ে বাড়াচ্ছে বায়ুদূষণ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার আশঙ্কা, এভাবে ফসলি জমির মাটি বিক্রি চলমান থাকলে অদূর ভবিষ্যতে স্থানীয় কৃষিব্যবস্থা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইটের ভাটায় যাচ্ছে এসব মাটি। এই ব্যবসার সাথে যুক্ত রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। আর এই মাটি ব্যবসাকে কেন্দ করে ঘটছে চাঁদাবাজি, হামলা-মারধরের মত ঘটনা। গত ৫ ফেব্রুয়ারী মাটি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে জয়াগের আনন্দপুর এলাকায় ও ৮ তারিখ জয়াগ বাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। জয়াগ বাজারে হামলার ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এসকল  ঘটনায় গতকাল রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারী) রাতে সোনাইমুড়ী থানায় লিখিত অভিযোগ হয়েছে।
মাটি ব্যবসায় জনপ্রতিনিধিরা: সরেজমিনে দেখা যায়, বজরা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ আক্তারুজ্জামান ডিসেম্বরের শুরু থেকে ইউনিয়ন জুড়ে ফসিল জমির মাটির ব্যবসা করছেন। গত বছরেও সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মীরনর রশিদের সাথে যুক্ত থেকে এই ব্যবসা  করেছেন। বর্তমানে তিনি মুটবি মালেক মুন্সির পোলের উত্তর পাশ্বের ফসলী জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটছেন। অম্বরনগর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি ফসলি জমি থেকে মাটি কাটছেন অম্বরনগর ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুর নবী সুমন। গত ৬ ফেব্রুয়ারী তিনি বাইতুল মামুর মসজিদ সংলগ্ন নিচু জমি ভরাটে প্রতি ডিসিম ৪১ হাজার টাকা চুক্তিতে কাজ শেষ করেছেন। এখন হিলটেক্স এলাকার বিভিন্ন ফসলি জমির মাটি বিক্রি করছেন ইটের ভাটায়।
উপজেলা জুড়ে মাটিখেকোরা: গত এক সপ্তাহের অনুসন্ধানে উপজেলার বিভিন্ন স্পটের মাটি ব্যবসায়ীদের তথ্য উঠে এসেছে  প্রতিবেদকের হাতে। সেসব মাটি ব্যবসায়ীদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী নেতাদের ছত্রছায়ায় মাটি ব্যবসা করেছেন বর্তমানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ব্যবসা করছেন। এছাড়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর দেশের সংখ্যাগরিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয়ধারী নেতা-কর্মীরা যুক্ত হয়েছেন এই চক্রে।
উপজেলার ৪নং বারগাঁও ইউনিয়নের দৌলতপুর মেহেরআলী ব্যাপারি বাড়ী সংলগ্ন ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইটের ভাটায় দিচ্ছেন বেল্লাল হোসেন।
একই ইউনিয়নের দৌলতপুর উত্তরপাড়ার ভূইয়া বাড়ী সংলগ্ন নয়গন্ডা ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করছেন পেয়ারাপুর গ্রামের আব্দুস ছত্তারের ছেলে মোরশেদ।
কৃষ্ণপুর খালেক মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন ফসলি জমিতে পাঁচ থেকে সাত ফুট গভীর করে মাটি কাটছেন স্থানীয় আব্দুর রবের ছেলে রাজু। এছাড়া দৌলতপুর প্রাইমারী স্কুলের উত্তর পাশ্বের জমি থেকেও মাটি কাটছেন রাজু।
অম্বরনগর ২ নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের উত্তরপাশ্বের ফসলি জমি ইট ভাটায় বিক্রি করছেন মোঃ শহিদ। এই জমিতে মাছের খামার করা হবে বলে জানান তিনি।
নাটেশ্বর ইউনিয়নের নজরপুর মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশ্বের জমি থেকে মাটি কাটছেন মোঃ জয়নাল। গত ২ মাস থেকে তিনি মাটি কাটছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
একই ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সর্বহারা বাড়ির দক্ষিণ পাশ্বের ফসলি জমি থেকে মাটি নিচ্ছেন জলিল ও হারুন।
দেওটি ইউনিয়নের কালুয়াই এলাকার  গজারিয়া পোল সংলগ্ন জমির মাটি তিন থেকে পাঁচ ফুট গভীর করে কেটে নিচ্ছেন টুটুল নামের এক সিজনাল ব্যবসায়ী। এছাড়া একই ইউনিয়নের দুয়াড়িপাড়া এলাকার ফসলী জমি থেকেও মাটি কাটছেন তিনি। বছরের এই মৌসুমে মাটি ব্যবসা করেন বলেও প্রতিবেদককে জানান তিনি।
একই ইউনিয়নের শিবপুর বাজার সংলগ্ন মাদ্রাসার পেছনের জমি থেকে গভীর পুকুর কেটে মাটি নিচ্ছেন ডুমুরিয়া এলাকার মোহন ও রুবেল। গতবছরেও তারা একই স্পটে তিনটি পুকুর কেটে মাটি বিক্রি করেছেন।
অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ: উপজেলা প্রশাসনের চোখ এড়াতে মাটি ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টেছে। দিনের পরিবর্তে তারা রাতে কাজ করছেন। বিশালাকার ভেকু মেশিন (স্কাভেটর) দিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত মাটি কাটছেন ফসলি জমি থেকে। মাটি পরিবহনে ব্যবহার করছেন ট্রাক্টর ও পিকআপ। মাটি বোঝাই ভারী যানবাহন গুলোর বড় বড় চাকা নষ্ট করছে গ্রামীন সড়কগুলো। পিচের প্রলেপ উঠে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে রাস্তাগুলো। এছাড়া পরিবহনের সময় গাড়ি থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়া মাটির কারনে সড়কে ধুলোবালি বাড়ছে। সড়কের পাশের বসতবাড়ি ও দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা ধুলার কারনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।
এসমস্ত এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, পবিত্র রমজান মাসেও বন্ধ নেই মাটিখেকোদের তান্ডব। ইফতারের পর থেকে ভোর পর্যন্ত চলে মাটি পরিবহন। একেরপর এক গাড়ি চলাচলের শব্দে রাস্তার পাশের বসবাসকারী মানুষের নানা সমস্যায় পড়ছেন। দিনের বেলায় রাস্তার ধুলোবালিতে হাঁচি-কাশি সহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। তবে এসকল মাটি ব্যবসায়ীরা এলাকার উগ্র ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী হওয়ায় তাদেরকে কিছু বলার সাহস করেনা ভুক্তভোগী জনসাধারণ।
মাটি খেকোদের ফাঁদে অসহায় কৃষক: মাটি ব্যবসায়ীদের পাতানো ফাঁদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। একটি ফসলি জমিতে যদি একজন কৃষকের থেকে কোন ভাবে জমির এক অংশের মাটি ব্যবসায়ীরা কিনতে পারে তবে অন্য কৃষকেরা বাধ্য হন মাটি বিক্রি করতে। অনেক সময় দুই ফুট মাটির কথা বলে পাঁচ থেকে সাত ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষক জানান, ফসলের ক্ষেতের একটি অংশে গভীর করে মাটি খনন করলে সেই অংশটুকু নিচু হয়ে যায়। ওই ক্ষেতের বাকি উচু জমিতে ফসল ফলানোর জন্য পানি সেচ দিলেও সেটা নিচু অংশে চলে যায়। বারেবারে পানি দিলেও জমিতে পানি থাকেনা। যে কারনে ফলন ভালো হয়না। ফলে কৃষকেরা বাধ্য হন জমির মাটি বিক্রি করতে।
কৃষকেরা আরো জানান, মাটি বিক্রি করলে ওই জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্ট হওয়ায় তিন ফসলী জমিতেও একবারের বেশি ফসল উৎপাদন করা যায় না। আর একবার জমির টপ সয়েল বিক্রি করলে দীর্ঘ সময় আশানুরূপ ফসল উৎপাদন হয় না। আর আশানুরূপ ফসল না পাওয়ায় অনেক কৃষক আবারো মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীদের কাছে।
প্রতিবেদকের কাছে ভয়াবহ আশঙ্কার কথা জানালেন সোনাইমুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী। তিন জানান, সোনাইমুড়ী উপজেলায় মোট ১২ হাজার ৪০০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। একসময় এসব জমিতে তিন বার ফসল পাওয়া যেতো। তবে তা কমতে কমতে ১৭২ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। মাটি খেকোদের অপতৎপরতায় কৃষি জমি কমছে আর জলাবদ্ধতা বাড়ছে। এভাবে ফসলী জমির টপ সয়েল বিক্রি হতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে কৃষিখাত। তবে ইটভাটায় মাটি বিক্রি রোধে কৃষকদের বিভিন্ন ভাবে সচেতন করা হচ্ছে বলেও যুক্ত করেন মোহাম্মদ নূরে আলম।
এদিকে এসকল মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করছে উপজেলা প্রশাসন। গত ফেব্রুয়ারী থেকে এপর্যন্ত তিনটি স্পটে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেছেন সহকারী কমিশনার ভূমি। তিন ব্যবসায়ীকে এসময় এক লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমান করা হয়। তবে এর পরেও থেকে নেই মাটিখেকো চক্র। তারা দিনের পরিবর্তে রাতে মাটি কাটছেন। যে কারনে অধিকাংশ মাটি ব্যবসায়ী রয়ে যাচ্ছেন ধরা ছোয়ার বাইরে। এবিষয়ে সোনাইমুড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দ্বীন আল জান্নাত জানান, মাটি বিক্রেতাদের তথ্য পেলেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে। চক্রটির অনেকে রাতে মাটি কাটায় অনেকসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে নিদ্রিষ্ট স্পটের তথ্য পেলে রাতে টহল পুলিশর টিমের সহায়তায় মাটি কাটা চক্রকে নিবৃত্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

জনপ্রতিনিধিরাও করছেন মাটি ব্যবসা’ সোনাইমুড়ীর ফসলি জমিতে মাটিখেকোদের থাবা

Update Time : ০৫:৩৮:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫
মোহাম্মদ  হানিফ, (নোয়াখালী): প্রতিনিধি : রাতের আধারে উধাও হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমির মাটি (টপ সয়েল)। কোথাও তিন ফুট, কোথাও পাঁচ ফুট গভীর করে একরের পর একর ফসলি জমি কেটে নিয়ে যাচ্ছে মাটিখেকোরা। শীত মৌসুমের পর থেকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা জুড়ে চলছে মাটি ব্যবসায়ীদের এই মচ্ছব। ফলে একদিকে ভয়াবহ হুমকির মুখে আবাদি জমি অন্যদিকে মাটি পরিবহনের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীন সড়ক। এছাড়া পরিবহনের সময় রাস্তায় ছিটকে পড়া মাটি পিষ্ট হয়ে ধুলায় পরিনত হয়ে বাড়াচ্ছে বায়ুদূষণ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার আশঙ্কা, এভাবে ফসলি জমির মাটি বিক্রি চলমান থাকলে অদূর ভবিষ্যতে স্থানীয় কৃষিব্যবস্থা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইটের ভাটায় যাচ্ছে এসব মাটি। এই ব্যবসার সাথে যুক্ত রয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। আর এই মাটি ব্যবসাকে কেন্দ করে ঘটছে চাঁদাবাজি, হামলা-মারধরের মত ঘটনা। গত ৫ ফেব্রুয়ারী মাটি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে জয়াগের আনন্দপুর এলাকায় ও ৮ তারিখ জয়াগ বাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। জয়াগ বাজারে হামলার ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এসকল  ঘটনায় গতকাল রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারী) রাতে সোনাইমুড়ী থানায় লিখিত অভিযোগ হয়েছে।
মাটি ব্যবসায় জনপ্রতিনিধিরা: সরেজমিনে দেখা যায়, বজরা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ আক্তারুজ্জামান ডিসেম্বরের শুরু থেকে ইউনিয়ন জুড়ে ফসিল জমির মাটির ব্যবসা করছেন। গত বছরেও সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মীরনর রশিদের সাথে যুক্ত থেকে এই ব্যবসা  করেছেন। বর্তমানে তিনি মুটবি মালেক মুন্সির পোলের উত্তর পাশ্বের ফসলী জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কাটছেন। অম্বরনগর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি ফসলি জমি থেকে মাটি কাটছেন অম্বরনগর ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুর নবী সুমন। গত ৬ ফেব্রুয়ারী তিনি বাইতুল মামুর মসজিদ সংলগ্ন নিচু জমি ভরাটে প্রতি ডিসিম ৪১ হাজার টাকা চুক্তিতে কাজ শেষ করেছেন। এখন হিলটেক্স এলাকার বিভিন্ন ফসলি জমির মাটি বিক্রি করছেন ইটের ভাটায়।
উপজেলা জুড়ে মাটিখেকোরা: গত এক সপ্তাহের অনুসন্ধানে উপজেলার বিভিন্ন স্পটের মাটি ব্যবসায়ীদের তথ্য উঠে এসেছে  প্রতিবেদকের হাতে। সেসব মাটি ব্যবসায়ীদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী নেতাদের ছত্রছায়ায় মাটি ব্যবসা করেছেন বর্তমানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ব্যবসা করছেন। এছাড়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর দেশের সংখ্যাগরিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয়ধারী নেতা-কর্মীরা যুক্ত হয়েছেন এই চক্রে।
উপজেলার ৪নং বারগাঁও ইউনিয়নের দৌলতপুর মেহেরআলী ব্যাপারি বাড়ী সংলগ্ন ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইটের ভাটায় দিচ্ছেন বেল্লাল হোসেন।
একই ইউনিয়নের দৌলতপুর উত্তরপাড়ার ভূইয়া বাড়ী সংলগ্ন নয়গন্ডা ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে মাটি বিক্রি করছেন পেয়ারাপুর গ্রামের আব্দুস ছত্তারের ছেলে মোরশেদ।
কৃষ্ণপুর খালেক মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন ফসলি জমিতে পাঁচ থেকে সাত ফুট গভীর করে মাটি কাটছেন স্থানীয় আব্দুর রবের ছেলে রাজু। এছাড়া দৌলতপুর প্রাইমারী স্কুলের উত্তর পাশ্বের জমি থেকেও মাটি কাটছেন রাজু।
অম্বরনগর ২ নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের উত্তরপাশ্বের ফসলি জমি ইট ভাটায় বিক্রি করছেন মোঃ শহিদ। এই জমিতে মাছের খামার করা হবে বলে জানান তিনি।
নাটেশ্বর ইউনিয়নের নজরপুর মাদ্রাসার দক্ষিণ পাশ্বের জমি থেকে মাটি কাটছেন মোঃ জয়নাল। গত ২ মাস থেকে তিনি মাটি কাটছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
একই ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সর্বহারা বাড়ির দক্ষিণ পাশ্বের ফসলি জমি থেকে মাটি নিচ্ছেন জলিল ও হারুন।
দেওটি ইউনিয়নের কালুয়াই এলাকার  গজারিয়া পোল সংলগ্ন জমির মাটি তিন থেকে পাঁচ ফুট গভীর করে কেটে নিচ্ছেন টুটুল নামের এক সিজনাল ব্যবসায়ী। এছাড়া একই ইউনিয়নের দুয়াড়িপাড়া এলাকার ফসলী জমি থেকেও মাটি কাটছেন তিনি। বছরের এই মৌসুমে মাটি ব্যবসা করেন বলেও প্রতিবেদককে জানান তিনি।
একই ইউনিয়নের শিবপুর বাজার সংলগ্ন মাদ্রাসার পেছনের জমি থেকে গভীর পুকুর কেটে মাটি নিচ্ছেন ডুমুরিয়া এলাকার মোহন ও রুবেল। গতবছরেও তারা একই স্পটে তিনটি পুকুর কেটে মাটি বিক্রি করেছেন।
অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ: উপজেলা প্রশাসনের চোখ এড়াতে মাটি ব্যবসায়ীরা কৌশল পাল্টেছে। দিনের পরিবর্তে তারা রাতে কাজ করছেন। বিশালাকার ভেকু মেশিন (স্কাভেটর) দিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত মাটি কাটছেন ফসলি জমি থেকে। মাটি পরিবহনে ব্যবহার করছেন ট্রাক্টর ও পিকআপ। মাটি বোঝাই ভারী যানবাহন গুলোর বড় বড় চাকা নষ্ট করছে গ্রামীন সড়কগুলো। পিচের প্রলেপ উঠে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে রাস্তাগুলো। এছাড়া পরিবহনের সময় গাড়ি থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়া মাটির কারনে সড়কে ধুলোবালি বাড়ছে। সড়কের পাশের বসতবাড়ি ও দোকানপাটের ব্যবসায়ীরা ধুলার কারনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।
এসমস্ত এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, পবিত্র রমজান মাসেও বন্ধ নেই মাটিখেকোদের তান্ডব। ইফতারের পর থেকে ভোর পর্যন্ত চলে মাটি পরিবহন। একেরপর এক গাড়ি চলাচলের শব্দে রাস্তার পাশের বসবাসকারী মানুষের নানা সমস্যায় পড়ছেন। দিনের বেলায় রাস্তার ধুলোবালিতে হাঁচি-কাশি সহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। তবে এসকল মাটি ব্যবসায়ীরা এলাকার উগ্র ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী হওয়ায় তাদেরকে কিছু বলার সাহস করেনা ভুক্তভোগী জনসাধারণ।
মাটি খেকোদের ফাঁদে অসহায় কৃষক: মাটি ব্যবসায়ীদের পাতানো ফাঁদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। একটি ফসলি জমিতে যদি একজন কৃষকের থেকে কোন ভাবে জমির এক অংশের মাটি ব্যবসায়ীরা কিনতে পারে তবে অন্য কৃষকেরা বাধ্য হন মাটি বিক্রি করতে। অনেক সময় দুই ফুট মাটির কথা বলে পাঁচ থেকে সাত ফুট গভীর করে মাটি কেটে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষক জানান, ফসলের ক্ষেতের একটি অংশে গভীর করে মাটি খনন করলে সেই অংশটুকু নিচু হয়ে যায়। ওই ক্ষেতের বাকি উচু জমিতে ফসল ফলানোর জন্য পানি সেচ দিলেও সেটা নিচু অংশে চলে যায়। বারেবারে পানি দিলেও জমিতে পানি থাকেনা। যে কারনে ফলন ভালো হয়না। ফলে কৃষকেরা বাধ্য হন জমির মাটি বিক্রি করতে।
কৃষকেরা আরো জানান, মাটি বিক্রি করলে ওই জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্ট হওয়ায় তিন ফসলী জমিতেও একবারের বেশি ফসল উৎপাদন করা যায় না। আর একবার জমির টপ সয়েল বিক্রি করলে দীর্ঘ সময় আশানুরূপ ফসল উৎপাদন হয় না। আর আশানুরূপ ফসল না পাওয়ায় অনেক কৃষক আবারো মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীদের কাছে।
প্রতিবেদকের কাছে ভয়াবহ আশঙ্কার কথা জানালেন সোনাইমুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী। তিন জানান, সোনাইমুড়ী উপজেলায় মোট ১২ হাজার ৪০০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। একসময় এসব জমিতে তিন বার ফসল পাওয়া যেতো। তবে তা কমতে কমতে ১৭২ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। মাটি খেকোদের অপতৎপরতায় কৃষি জমি কমছে আর জলাবদ্ধতা বাড়ছে। এভাবে ফসলী জমির টপ সয়েল বিক্রি হতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে কৃষিখাত। তবে ইটভাটায় মাটি বিক্রি রোধে কৃষকদের বিভিন্ন ভাবে সচেতন করা হচ্ছে বলেও যুক্ত করেন মোহাম্মদ নূরে আলম।
এদিকে এসকল মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করছে উপজেলা প্রশাসন। গত ফেব্রুয়ারী থেকে এপর্যন্ত তিনটি স্পটে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেছেন সহকারী কমিশনার ভূমি। তিন ব্যবসায়ীকে এসময় এক লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমান করা হয়। তবে এর পরেও থেকে নেই মাটিখেকো চক্র। তারা দিনের পরিবর্তে রাতে মাটি কাটছেন। যে কারনে অধিকাংশ মাটি ব্যবসায়ী রয়ে যাচ্ছেন ধরা ছোয়ার বাইরে। এবিষয়ে সোনাইমুড়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দ্বীন আল জান্নাত জানান, মাটি বিক্রেতাদের তথ্য পেলেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে। চক্রটির অনেকে রাতে মাটি কাটায় অনেকসময় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে নিদ্রিষ্ট স্পটের তথ্য পেলে রাতে টহল পুলিশর টিমের সহায়তায় মাটি কাটা চক্রকে নিবৃত্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।