অমুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখানোর বেশ কিছু অভিযোগও উঠেছে। এসব ঘটনায় উল্লেখযোগ্য শাস্তি না হলেও কারো কারো সনদ বাতিল করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে নতুন করে অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তনসহ জামুকা আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাসিনা সরকার পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই গত ১৫ই আগস্ট সরকারি চাকরিতে ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির পদে এই পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া জনবলের পূর্ণাঙ্গ তথ্য চেয়ে সকল মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে প্রার্থীর নাম, পিতার নাম, নিয়োগপ্রাপ্ত পদ, শ্রেণি নম্বর ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা ও সনদ-গেজেট নম্বর চাওয়া হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, পরিদপ্তরসহ মোট ৬১টি প্রতিষ্ঠানে পৃথকভাবে এই চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চিঠি পেয়ে ওই বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল মন্ত্রণালয় ও তাদের আওতাধীন দপ্তরগুলো থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য ডাকযোগে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া উন্মুক্ত করা হয় মতামতের জন্য। খসড়া অধ্যাদেশে প্রস্তাবিত নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী দ্বারা নির্যাতিত নারী (বীরাঙ্গনা) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সহকারীরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) ও এমপি (আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য) যাঁরা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদের সদস্য হয়েছিলেন তাঁদেরসহ বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দূত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
রণাঙ্গনের যোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাদানকারীদের সঙ্গে মুজিবনগর সরকারও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। তবে অন্যরা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবেই থাকবেন।এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা প্রবাসী সরকারে ছিলেন (মুজিবনগর সরকার) তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই স্বীকৃত হবেন। তবে এমএনএ-এমপি তো সবাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁরা সহযোগী হিসেবেই থাকবেন। সরকারটাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হবে।
সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, সরকার তো থাকবেই।’এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, ‘স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চলছে, জাতির জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না। আমার বিবেচনায় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে যাঁরা জনমত তৈরি করেছেন, স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেছেন, মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনে যাঁরা ছিলেন, সাংবাদিকসহ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে বিভাজন করাটা উচিত হবে না। এটা করতে গিয়ে আমরা যেন কাউকে অসম্মান না করি। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী বলে মান নির্ণয় বা বিভাজনের পক্ষে নই আমি।’ অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান নিক। বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যায় অমুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আমি চাই এটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হোক। সরকার যদি এটি করতে পারে, আমি তাদের ধন্যবাদ জানাব।’
মাঠ পর্যায়ে বাছাই কাজে যুক্ত হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ : বর্তমানে জামুকার সদ্যদের নিয়ে গঠিত দুটি উপকমিটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আদালতের আদেশ ও রিটের বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করছে বলে জানিয়েছে জামুকা সূত্র। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ও সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৮৯ হাজার ২৩৫ জনের ডেটাবেইস ও তথ্য যাচাইয়ের কাজ করছে। এরই মধ্যে ৪০ হাজারের মতো তথ্য যাচাই করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা।
জামুকা অধ্যাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার পরেই বড় পরিসরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু করা হবে দেশজুড়ে। এই কাজে মাঠ পর্যায়ে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করা হবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে সক্রিয় ও সংসদের নির্বাচনের ধারাও সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া আছে জামুকার খসড়া অধ্যাদেশে। আগামী এপ্রিলের মধ্যেই অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চূড়ান্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে সক্রিয় করতে চাই। এর জন্য জামুকা অধ্যাদেশ পাস করতে হবে। এখন সংসদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে। প্রশাসকে কাজ হচ্ছে না। সংসদ গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন জায়গায় এই বাছাই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা রণাঙ্গনের সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁরাই তো এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের চেনেন জানেন।’
১০ থেকে ১২ জন অমুক্তিযোদ্ধা এরই মধ্যে নাম প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন বলে জানান উপদেষ্টা। এর আগে জামুকার ৯২তম সভায় যেসব অমুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছায় গেজেট ও সনদ বাতিল করতে ইচ্ছুক তাঁদের এ বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে পরে সেই সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা বলেছিলেন, কোনো অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নিলে তাঁকে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেওয়া হতে পারে। অন্যথায় তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।