১২:১৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ  
									 
                     
                     
                    
                 
                                         সংবাদ শিরোনাম :  
                                    
                            
                                রাজনীতি বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের খেলা, নাকি অতীত পুনরাবৃত্তির ব্যর্থ প্রচেষ্টা?
 
																
								
							
                                
                              							  Reporter Name									
								
                                
                                - Update Time : ১১:১৯:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১৫০ Time View

রাজনীতি যদি কেবল ক্ষমতার পালাবদলের খেলা হয়, তবে তা সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রতারণামূলক এক শিল্প। কিন্তু প্রকৃত রাজনীতি তো জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের কৌশল। সেখানে প্রয়োজন আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, জবাবদিহিতা, আর সর্বোপরি জনগণের প্রতি সম্মানবোধ। অথচ আমাদের ইতিহাস যেন হয়ে উঠেছে এক ক্লান্তিকর চক্র যেখানে একই ভুল, একই নাটক, শুধু মুখ ও মোড়ক বদলায়।
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের এক মহাকাব্য। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ২০০ বছরের সংগ্রাম, পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের প্রতিবাদ  ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যার প্রতিশ্রুতি ছিল ন্যায়ের সমাজ, জনগণের রাষ্ট্র।
কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়ই সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়। একদিকে দুর্নীতি ও অদক্ষতা, অন্যদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, সংবাদপত্র বন্ধ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন দলীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারের বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংবাদপত্র গণকণ্ঠ বন্ধ, বুদ্ধিজীবীদের দমন এসব ঘটনা গণতন্ত্রকে কফিনবন্দী করে। এমনকি কিছু প্রাজ্ঞ সাংবাদিক তখন শেখ মুজিবের শাসনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘দুঃশাসনের ১৩৩৮ দিন’ হিসেবে।
১৯৭৫ সালের আগস্টে রাজনৈতিক চরম পরিবর্তন আসে। এরপর ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ কথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ ঘটে। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেন। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর মতো নতুন রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। দেশের উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লব, প্রাথমিক শিক্ষা প্রসার, পল্লী উন্নয়নসহ নানা কাজে হাত দেন।
কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যার মাধ্যমে সেই ধারাও থেমে যায়। এরপর রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে সরিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনা শাসন কায়েম করেন। ৯ বছরের সেই স্বৈরশাসন শেষ হয় ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে।
প্রতিবারই আমরা নতুন আশায় বুক বাঁধি, কিন্তু ফলাফল প্রায় এক। ২০০৭ সালের এক-এগারোতে রাজনৈতিক সংস্কারের নামে সেনাসমর্থিত সরকার আসে। প্রথমে নৈতিকতার কথা বলা হলেও, পরে দেখা যায় স্বাধীন মতপ্রকাশ, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার হরণই হয় তাদের প্রধান কাজ।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, নির্বাচন কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিরোধী দল অংশ নিতে পারে না, ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে ভয় পায়, আর প্রশাসন ব্যবহৃত হয় ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হিসেবে।
বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গুম, খুন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এসব আমাদের রাজনীতিকে গণতন্ত্র থেকে ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তরুণরা বিশেষ করে যাদের আজ আমরা  বলি তারা আর এসব রাজনৈতিক চাতুরীতে আগ্রহী নয়। তাদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা বা সমর্থন এখন আর ভোটের বিবেচ্য বিষয় নয়। তারা চায় কর্মক্ষম, দূরদর্শী ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব।তারা ক্লান্ত এক মুখে আদর্শের কথা শুনে, আর অন্য মুখে দুর্নীতি দেখে। তারা বুঝে গেছে, নেতৃত্ব মানে কেবল ভাষণ নয়, বরং উদ্ভাবন, সমাধান এবং বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবায়ন।নেতৃত্বে মেধা, দূরদর্শিতা ও জবাবদিহিতা।রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নয়, পারফরম্যান্স।দলীয়করণ নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা।
দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এগুলোও স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ। কিন্তু তারা রাজনীতিকে জনগণের সেবা হিসেবে দেখেছে। লিকুয়ান ইউ-এর সিঙ্গাপুরে দুর্নীতি ছিল শূন্য সহনশীলতায়, দক্ষ নেতৃত্বে দেশটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে।
দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নেতৃত্বে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও শিল্প খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়েছে। আর বাংলাদেশে? আমাদের রাজনীতিকরা ব্যস্ত ছিলেন কাকে গুম করা হবে, কাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বানানো হবে, অথবা যে যেভাবে পারো ‘ভোটে জিতো’ নাটক মঞ্চস্থ করা।
রাজনীতি যদি সত্যিই বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের খেলা হয়, তবে আমাদের কৌশল আজ ব্যর্থ। আমরা ভবিষ্যতের কথা বলি না, অতীত নিয়েই লড়াই করি।সমাধান দেই না, বরং নতুন সংকট তৈরি করি।তরুণদের যুক্তিবোধকে শ্রদ্ধা করি না, শুধুই ভোট ব্যাংক হিসেবে দেখি।এমন রাজনীতি দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব নয়।
 অতীতের নামে বিভাজন নয়, ভবিষ্যতের লক্ষ্যে সংহতি।ক্ষমতার লোভ নয়, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা।বক্তৃতা নয়, বাস্তবায়নের রাজনীতি। মিথ্যা আশ্বাস নয়, স্বচ্ছ কর্মপরিকল্পনা।রাজনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনের দলীয়করণ বন্ধ, এবং প্রকৃত গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া।
রাজনীতি আজ যদি বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের খেলাই হয়, তবে সেই খেলার নিয়ম নতুন করে লিখতে হবে। মুখে গণতন্ত্র আর কাজে একনায়কতন্ত্র এই ছদ্মবেশী রাজনীতি তরুণ প্রজন্ম আর মানবে না। তারা নিজেরাই তৈরি করবে নতুন রাজনীতির ভাষ্য, নতুন নেতৃত্বের ধারা।
পুরনো নাটকের নতুন দৃশ্যপটে আর কেউ হাততালি দেবে না। সময় এসেছে বাস্তবতা মেনে নেয়ার। না হলে, নতুন বাংলাদেশ কেবলই শ্লোগান হয়ে থাকবে আর বাস্তবতা হবে সেই পুরনো রাজনীতিরই নতুন কায়দায় উপস্থাপন।
লেখক ও সাংবাদিক  মোহাম্মদ হানিফ (গোলজার  হানিফ) 
                            
                                 Tag : 
                                                            
                   
                        
                             
																			 
																		














