১০:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৬ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পিপলস টিভি ৬

মুজিব: বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধী — ফিরোজ মাহবুব কামাল

Reporter Name
  • Update Time : ০২:৫৪:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ৮ Time View

শয়তানের এজেন্ডাই মুজিবের এজেন্ডা

এ পৃথিবী পৃষ্ঠের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম ও যুদ্ধ-বিগ্রহে  মূলত দুটি এজেন্ডা কাজ করে: একটি মহান আল্লাহ তায়ালার, অপরটি শয়তানের। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা হলো, মানুষকে জান্নাতে নেয়া; আর শয়তানের ঘোষিত এজেন্ডা হলো জাহান্নামে নেয়া। আল্লাহ তায়ালা চান ঈমানদারদের মাঝে একতা ও শরিয়ার প্রতিষ্ঠা; অপর দিকে শয়তান চায় বিভক্তি ও শরিয়ার বিলুপ্তি। চায় মুসলিম রাষ্ট্রের খণ্ডিতকরণ। কারো কোন এজেন্ডা থাকলে, সে এজেন্ডাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে রাজনীতির ময়দানে অবশ্যই বিশ্বস্ত খলিফা চাই। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে যারাই যুদ্ধ করে, তারাই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা। আর যারা শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করে তারাই হলো শয়তানের খলিফা। যারা শয়তানের খলিফা তারা নানা বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল ও শ্রেণীতে বিভক্ত। আর যারা আল্লাহর খলিফা তাদের বন্ধনটি ঈমানের। তারা প্যান-ইসলামী।

মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা হলো প্রতিটি ঈমানদার। আর শয়তানের খলিফা হলো প্রতিটি বেঈমান। শয়তানের খলিফাদের কাজ যেমন মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত রাখা, তেমনি মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়াকে বিলুপ্ত রাখা। শয়তানের সে এজেন্ডা নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবির্ভুত হয়েছিল বহু বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার রাজনৈতিক দল। ষাটের দশকে মুজিব আবির্ভুত হয়েছিল বাঙালি ফাসিস্টদের প্রধান নেতা রূপে। এজেন্ডা অভিন্ন হওয়ায় মুজিব ও তার অনুসারীদের সখ্যতা গড়ে উঠে শয়তানের পৌত্তলিক খলিফা ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক চক্রের সাথে। শুরু থেকেই তাদের মধ্য কোয়ালিশন গড়ে উঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিনাশে।

শয়তানের দলই ছিল মুজিবের দল

পবিত্র কুর’আনের বর্ণনায় মানব জাতির বিভাজন মাত্র দু’টি দলে। একটি হলো আল্লাহর দল (হিজবুল্লাহ); এবং অপরটি হলো শয়তানের দল (হিজবুশ শায়তান)। সর্বজ্ঞানী মহান রব’য়ের বিচারে তৃতীয় কোন দল নাই। তাই পবিত্র কুর’আনে হিজবুল্লাহ ও হিজবুশ শায়তান ব্যতীত তৃতীয় কোন দলের উল্লেখ। প্রতিটি মানব সন্তান এ দুটি দলের কোন একটির সদস্য। অতএব হিসাবটি সহজ; যারাই আল্লাহর দলে নেই, তারাই হলো শয়তানের দলে। আল্লাহর দলের পরিচয়টিও অতি সহজ। সে পরিচয়টি নিহিত রয়েছে সে দলের সদস্যদের দর্শন, আক্বিদা-বিশ্বাস, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও লড়াইয়ের মাঝে। আল্লাহর দলের সদস্যদের চেনা যায় শুধু তাদের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দেখে নয়, বরং আল্লাহর পথে যুদ্ধ তথা জিহাদ দেখে। জিহাদই হলো ঈমানের সবচেয়ে নির্ভর যোগ্য দৃশ্যমান রূপ।  অপর দিকে শয়তানের দলের সদস্যদের চেনা যায় তাদের জীবনে দল, মতবাদ, বর্ণ, গোত্র, ভাষা  ও অঞ্চল ভিত্তিক রাজনীতি দেখে। ঈমানদার ও বেঈমান -এই উভয় দলের যুদ্ধের চিত্রটি মহান আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন এভাবে:

“ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱلطَّـٰغُوتِ فَقَـٰتِلُوٓا۟ أَوْلِيَآءَ ٱلشَّيْطَـٰنِ ۖ إِنَّ كَيْدَ ٱلشَّيْطَـٰنِ كَانَ ضَعِيفًا

অর্থ: “যারা ঈমান এনেছে তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায় এবং যারা কাফির তারা যুদ্ধ করে শয়তানের তথা তাগুতের পথে। অতঃপর হে ঈমানদারগণ তোমরা যুদ্ধ করো শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই শয়তানের ষড়যন্ত্র দুর্বল।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৬)। 

উপরিউক্ত আয়াতের শেষাংশে মুসলিমদের উপর আল্লাহর পথে যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে -যেমন ফরজ করা হয়েছে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত। তাই ঈমানদারকে শুধু নামাজ-রোজার পালন নিয়ে বাঁচলে চলে না, বাঁচতে হয় জিহাদ নিয়েও। যুদ্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে নিচের আয়াতে। বলা হয়েছে:

۞ فَلْيُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يَشْرُونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا بِٱلْـَٔاخِرَةِ ۚ وَمَن يُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا

عَظِيمًۭا

অর্থ: “আর যারা আখেরাতের বিনিময়ে এ পার্থিব জীবনকে বিক্রয় করেছে তারা যেন অবশ্যই যুদ্ধ করে আল্লাহ পথে তথা আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার পথে। এবং যারা আল্লাহ পথে যুদ্ধ করে অতঃপর সে যুদ্ধে নিহত হয় অথবা বিজয়ী হয় -তাদেরকে দিব বিশাল প্রতিদান।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৪)

নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করলেই কেউ মুসলিম হয় না। তাকে মুসলিমের দায়িত্ব নিয়ে বাঁচতে হয়। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে নিজ জীবনের এজেন্ডা বানিয়ে নিতে হয়। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার যুদ্ধটি তার নিজের যুদ্ধ হতে হয়। মহান রব’য়ের সে ঘোষিত এজেন্ডাটি হলো, তাঁর নিজ সার্বভৌমত্ব ও নিজ শরিয়া’র প্রতিষ্ঠা।  সে সাথে মিথ্যাচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচারের  প্রতিষ্ঠা। মুসলিমের নিজের দল, নিজের রাজনীতি ও নিজের যুদ্ধ বলে কিছু নাই। তার দলকে যেমন আল্লাহর দল তথা হিজবুল্লাহ হতে হয়, তেমন তার রাজনীতি হতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় রাজনীতি। তেমনি তার যুদ্ধকে হতে হয় আল্লাহর দ্বীন ও মুসলিম দেশের স্বাধীনতাকে প্রতিরক্ষা দেয়ার যুদ্ধ। যার দল, দলীয় রাজনীতি ও যুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করা এজেন্ডা নয়, তার রাজনীতি কখনোই হালাল হতে পারে না। ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলার রাজনীতিতে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর পরাজয় আনে, তাই এ রাজনীতি হারাম। আর এই হারাম রাজনীতির নেতা-কর্মীরা  কখনো মুসলিম হতে পারে না। মুজিব ও তার অনুসারীদের রাজনীতিতে ইসলামের কোন স্থান ছিল না। তার রাজনৈতিক যুদ্ধ ছিল স্রেফ তার নিজের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। তই তার রাজনীতিতে যেমন পাকিস্তানের অখণ্ডতা বাঁচেনি, তেমনি বাঁচেনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র।

তাছাড়া মুজিব নিজেও কখনো নিজেকে এবং তার দলকে ইসলামপন্থী দল রূপে দাবী করেনি। মুজিব ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের প্রবক্তা। অথচ মুসলিমের জন্য ইসলামপন্থী হওয়া ছাড়া অন্য কোন মতবাদপন্থী হওয়ার রাস্তা খোলা রাখা হয়নি। যে দল ইসলামপন্থী নয়, সে দল অবশ্যই শয়তানপন্থী হয়। সেটিই তো স্বাভাবিক। কারণ চেতনার ভূমি কখনোই শূণ্য থাকে না, ইসলাম স্থান না পেলে সেখানে অন্য মতবাদ জায়গা করে নেয়। তাই যারা ইসলামপন্থী নয় তারাই জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী, ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী, সমাজবাদী, পুঁজিবাদী, হিন্দুত্ববাদী তথা নানা মতবাদী হয়। এরা সবাই শয়তানপন্থী। এ জন্যই শয়তানপন্থী দলের মৈত্রী কখনোই ইসলামপন্থীদের সাথে হয় না, তারা বরং বন্ধু রূপে গ্রহণ করে শয়তানের অন্য খলিফাদের। কারণ, উভয়েই পরস্পরের আদর্শিক কাজিন। এজন্য শয়তানের ভারতীয় পৌত্তলিক খলিফাদের সাথে মুজিব ও তার দলের সম্পর্ক ছিল এতো অটুট। এজন্যই ভারত ১৯৭১’য়ে একটি প্রকাণ্ড যুদ্ধ করে মুজিবকে ক্ষমতায় বসায়।

ক্ষমতালোভী মুজিব

মুখে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বল্লেও মুজিব ও তার অনুসারীগণ সে লক্ষ্যে একাত্তরে যুদ্ধ করেনি। মুজিব ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী। ক্ষমতা হাতে পেতে মুজিব ভারতের সাহায্য চেয়েছে। বিনিময়ে একাত্তরের যুদ্ধে পৌত্তলিক ভারতকে বিজয়ী করতে মুজিবের অনুসারীরা যুদ্ধ করেছে। মুজিবের ভাবনা ও তাড়নায় বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতার কোন স্থান ছিল না। সেটি থাকলে গণতন্ত্রকে কেন কবরে পাঠাবে? কেন একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দিবে? কেন কেড়ে নিবে জনগণের রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা? ক্ষমতালোভী মুজিবের লড়াইটি ছিল নিছক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পাওয়ার স্বার্থান্বেষী লড়াই। ক্ষমতা পেতে মুজিব যে কোন পথ বেছে নিতে রাজী ছিল -এমনকি বিদেশী শক্তির কাঁধে চড়ে হলেও । সে কাজটি সহজ করতেই মুজিব ভারতীয় বাহিনীকে নিজ ভূমিতে ডেকে এনে এবং নিজ দেশ পাকিস্তানকে খণ্ডিত করে। মুজিবের যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলনা, ছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধেও। কারণ পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীদেরকে মুজিব নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করতো।

যারা বলে পূর্ব পাকিস্তানীদের ক্ষমতার মসনদ থেকে দূরে রাখার জন্যই মুজিবের হাতে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা দেয়া হয়নি -তারা সত্য বলেনা। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনের আগেও পাকিস্তানের ৩ জন প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানী তথা বাঙালি হয়েছে। ১৯৭১’য়ের শেষ দিকে নুরুল আমীন সাহেবও প্রধানমন্ত্রী হন। দুইজন রাষ্ট্রপ্রধানও হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের ক্ষমতার বাইরে রাখা পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য হলে কেন এতো আয়োজন করে নির্বাচন দিবে? নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের সামনে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী রূপে ঘোষণা দেন।

অপর দিকে নিরংকুশ বিজয়ের পর মুজিব তার রাজনীতির গোল পোস্ট পাল্টিয়ে ফেলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনি বিজয়কে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানানোর পক্ষে রায় বলে পেশ করা হয়। সেটি পরিণত হয় ভারতীয় বয়ানে। তাই একাত্তরের সেপ্টম্বরে ইসলামাবাদস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার মিস্টার জয় কুমার অটালের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশ্নে গণভোটের প্রস্তাব পেশ করেন, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দাবী করেন, ১৯৭ ০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হলো স্বাধীনতার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানীদের রায়। অথচ ইন্দিরা গান্ধীর সে দাবীর মধ্যে কোন সত্যতা ছিল না। কারণ ১৯৭০’য়ের নির্বাচনটি হয়েছিল স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে, স্বাধীনতার দাবীতে নয়।

পাকিস্তান ভাঙাটি ছিল শেখ মুজিবের ষাটের দশকের পরিকল্পনা -যা সফল করতে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW’য়ের সাথে মিলে রচিত হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের কাছে আগরতলা ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে, ফলে তকা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জুলফিকার আলী ভূট্টোর দল পিপলস পার্টির পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয় এবং শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ বিজয় পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত করে ফেলে। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক বিভক্তি মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার মূল প্রকল্পকে বহুগুণ সহজ করে দেয়।

শেখ মুজিব পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের মাঝে মাত্র একটি মাত্র প্রদেশে নির্বাচনে জিতেছিল। অন্য প্রদেশের বিজয়ীদের সাথে সমাঝোতা না করে তার পক্ষে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অসম্ভব ছিল। এরূপ অবস্থায় যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক সমাঝোতার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে সেরূপ সমঝোতা বার বার হয়ে এসেছে।  অথচ মুজিব সেরূপ কোন সমঝোতায় রাজী ছিল না, বরং জিদ ধরে, একমাত্র তার হাতেই ক্ষমতা দিতে হবে। মুজিবের যুক্তি, পার্লামেন্টের অর্ধেকের বেশী নির্বাচিত সদস্য তার দলের। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য বিষয়টি অনেক জটিল ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অংশগ্রহণ ছাড়া মুজিবের হাতে ক্ষমতা দিলে সেটি হতো অবাঙালিদের উপর বাঙালির শাসন। সেটি পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল। অপর দিকে পাকিস্তানের কোন সরকার যদি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিয়ে গঠিত হলে সেটিও কোন বাঙালি মেনে নিতনা।  ১৯৭০’য়ে নির্বাচনে পাঞ্জাব ও সিন্ধু -এ দুটি প্রদেশে বিজয়ী হয়েছিল জুলফিকার আলী ভূ্ট্টোর দল পাকিস্তান পিপল’স পার্টি। ভূট্টোর পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া মুজিব সরকার গঠনে সমাঝোতায় রাজী না হলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশনে তার দলের পক্ষ থেকে কেউ যোগ দিবে না। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বা সংসদকে জাতীয় পরিষদ বলা হয়।

মুজিব ভেবেছিল, একক ভাবে ক্ষমতায় গেলে বিনা যুদ্ধে পাকিস্তান ভাঙার কাজটি সহজ হবে। পরবর্তীতে প্রকাশ পায়, নির্বাচনি বিজয়ের পর পাকিস্তান ভাঙাই ছিল মুজিবে রাজনীতির মূল এজেন্ডা, পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়া নয়। তাজুদ্দীন আহমেদ ও ছাত্র লীগের সিরাজুল আলমসহ কট্টোর পাকিস্তান বিরোধীরাই সেটিই চাচ্ছিল। সে কথাটি মুজিব বলেছিল ১০ জানুয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায়। উক্ত জনসভায় মুজিব দাবী করে, স্বাধীন বাংলাদেশ বানানোর লক্ষ্যে তার লড়াইয়ের শুরু ১৯৭১ থেকে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে। মুজিবের সেদিনের সে বক্তৃতা এ গ্রন্থের লেখকের নিজ কানে শোনার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনি বিজয়ের পর মুজিবের জন্য তার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা সহজ হয়ে যায়।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নেয়া যখন অসম্ভব হয়, তখন মুজিব দাবী তোলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন ও সামরিক বাহিনী তুলে নিয়ে তার হাতে ক্ষমতা দেয়ার। সেটিও অসম্ভব ছিল। কারণ, দেশে তখন কোন সংবিধান ছিল না, দেশ চলছিল সামরিক আইনে। সামরিক আইন তুলে নিলে শাসকের হাতে আর কোন বিধি নিষেধ থাকেনা। সামরিক আইন তুলে নেয়ার অর্থ হতো, মুজিবকে ইচ্ছামত দেশ চালানোর সুযোগসহ পূর্ব পাকিস্তানকে বিনা যুদ্ধে স্বাধীন করার পথ খুলে দেয়া। পাকিস্তান সরকার মুজিবের সে পথও বন্ধ করে দেয়। ফলে মুজিবের অনুসারীরা যুদ্ধে পথ বেছে। সেরূপ একটি যুদ্ধে জন্য মার্চের শুরু থেকেই রীতিমত প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজও শুরু হয়েছিল। ইতিমধ্যে বহু হাজার ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW’য়ের এজেন্টও পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। শুরু হয় বিহারী নিধন ও তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের উপর লুটপাট।

 

যুদ্ধ শুরু হলো এবং সুযোগ করে দেয়া হলো ভারতীয় আগ্রাসনের

১৯৭০ নির্বাচনের অংশ নেয়ার শর্ত রূপে প্রতিটি দলকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষিত Legal Frame Work স্বাক্ষর করতে হয়। তাতে ৮ দফা শর্ত ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, পাকিস্তানের একতা ও সংহতির প্রতি অঙ্গীকার থাকতে হবে। এবং শর্ত ছিল,  নির্বাচনের পর নির্বাচিত সদস্যগণ সর্বপ্রথম পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করবে -যা হবে আগামীতে সরকার পরিচালনা ও দেশ শাসনের রোডম্যাপ। সংবিধান রচনার পর গঠিত হবে নতুন সরকার এবং সে সরকার পাবে নতুন সংবিধান অনুযায়ী দেশ চালানোর অধিকার। কিন্তু বিশাল নির্বাচনী বিজয়ের পর মুজিব তার নিজের স্বাক্ষরিত দায়বদ্ধতার কথাই ভুলে যায়। মুজিব দাবী তোলে, তার দল যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

শাসনতন্ত্র রচনার বিষয়টি ইচ্ছা করেই চাপা দেয়া হয়। কারণ সংবিধান রচিত হলে তো পাকিস্তান বেঁচে যেত। তাই মুজিবের সেদিকে আগ্রহ ছিল  না; বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী নিয়ে দেশ জুড়ে মুজিব অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এবং ১৯৭১’য়ের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় হাতের কাছে যার যা আছে তা দিয়ে সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দেয়। সিভিল প্রশাসন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দেশকে পুরোপুরি অচল করা হয়। রাজস্ব দেয়া বন্ধসহ দেশে এক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা হয়; ফলে অনিবার্য হয়ে উঠে আরেকটি সামরিক হস্তক্ষেপ।  ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুজিব, ভূ্ট্রো ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মাঝে ২১-২৩ মার্চ সমাঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হয়;  ২৫ মার্চ শুরু হয় আরেক সামরিক এ্যাকশন।

মুজিবের অনুসারীগণ দেশজুড়ে প্রতিরোধ খাড়া করে; হাজার হাজার বিহারী হত্যা ও তাদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠনে সফল হলেও সামরিক বাহিনীর প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে মুজিবের অনুসারীগণ দেশের মফস্বলের ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুন্টন করে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্রের পার্টনার ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য ভিক্ষা করে। ভারত সে আহবানে সাড়া দেয় এবং গড়ে তোলে ভারতীয় অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণে মুক্তি বাহিনী। মুক্তি বাহিনী যখন সমগ্র দেশ স্বাধীন করা দূরে থাকে একটি জেলা বা থানাও স্বাধীন করতে ব্যর্থ তখন আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারত নিজে যুদ্ধ নামে। হামলা শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার প্রকল্প এভাবেই সেদিন সফল হয়। এবং মুসলিম উম্মাহ হারায় তাদের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তান। পৌত্তলিক কাফিরগণ পায় তাদের সমগ্র ইতিহাসে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিজয়টি।

মীর জাফরের পর সবচেয়ে বড় মীর জাফর

ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতিতে শয়তানের প্রধান খলিফা রূপে আবির্ভুত হয় শেখ মুজিব; এবং শয়তানের প্রধান দল রূপ হাজির হয় আওয়ামী লীগ। মুজিবের রাজনীতিতে ইসলামের কোন অঙ্গীকার ছিল না, অঙ্গীকার ছিল না পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি। বরং তার গভীর একাত্মতা ছিল ভারতের এজেন্ডার সাথে। বাঙালি পৌত্তালিকরা সেটি টের পায়; ফলে দলে দলে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। এবং দলে দলে মুজিবের সাথে কোয়ালিশন গড়ে সকল বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও বাঙালি কম্যুনিস্ট। কারণ, ইসলামের এ শত্রুগণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক।

শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় এবং ইসলামের ক্ষতিসাধনে শেখ মুজিব ও তার দলের সাফল্যটি বিশাল। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে মীর জাফেরর পর আর কোন ব্যক্তিই মুসলিম উম্মাহর এতো বড় ক্ষতি করেনি -যা করেছে শেখ মুজিব। শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে মুজিবের বড় বড় দুটি অবদান হলো: এক). পাকিস্তানের বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করে মুজিব মুসলিম উম্মাহর কোমর ভেঙ্গে দিতে পেরেছে। দুই). ভারতের ন্যায় শয়তানের সর্ববৃহৎ পৌত্তলিক খেলাফতকে একাত্তরের যুদ্ধে বিজয়ী করে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে দেশটিকে প্রধান শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং পরিণত করেছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে। ভারতীয় হিন্দুত্বাবাদীদের কাছে মুজিব ও তার পরিবার এজন্যই এতো আদরণীয়। তাই পলাতক হাসিনাকে বিশ্বের কেউ আশ্রয় না দিলেও আশ্রয় দিয়েছে ভারত। তাই মুজিবের মূর্তি ভেঙে বাঙালি মুসলিমগণ যখন উল্লাস করেছে এবং সে মূর্তির উপর পেশাব করেছে তখন মাতম উঠেছে ভারতীয় মিডিয়ায়।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

2 thoughts on “মুজিব: বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধী — ফিরোজ মাহবুব কামাল

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thedailysarkar@gmail.com

About Author Information

মুজিব: বাঙালি মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধী — ফিরোজ মাহবুব কামাল

Update Time : ০২:৫৪:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শয়তানের এজেন্ডাই মুজিবের এজেন্ডা

এ পৃথিবী পৃষ্ঠের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্ম ও যুদ্ধ-বিগ্রহে  মূলত দুটি এজেন্ডা কাজ করে: একটি মহান আল্লাহ তায়ালার, অপরটি শয়তানের। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা হলো, মানুষকে জান্নাতে নেয়া; আর শয়তানের ঘোষিত এজেন্ডা হলো জাহান্নামে নেয়া। আল্লাহ তায়ালা চান ঈমানদারদের মাঝে একতা ও শরিয়ার প্রতিষ্ঠা; অপর দিকে শয়তান চায় বিভক্তি ও শরিয়ার বিলুপ্তি। চায় মুসলিম রাষ্ট্রের খণ্ডিতকরণ। কারো কোন এজেন্ডা থাকলে, সে এজেন্ডাকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজে রাজনীতির ময়দানে অবশ্যই বিশ্বস্ত খলিফা চাই। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে যারাই যুদ্ধ করে, তারাই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা। আর যারা শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করে তারাই হলো শয়তানের খলিফা। যারা শয়তানের খলিফা তারা নানা বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল ও শ্রেণীতে বিভক্ত। আর যারা আল্লাহর খলিফা তাদের বন্ধনটি ঈমানের। তারা প্যান-ইসলামী।

মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা হলো প্রতিটি ঈমানদার। আর শয়তানের খলিফা হলো প্রতিটি বেঈমান। শয়তানের খলিফাদের কাজ যেমন মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত রাখা, তেমনি মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়াকে বিলুপ্ত রাখা। শয়তানের সে এজেন্ডা নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবির্ভুত হয়েছিল বহু বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার রাজনৈতিক দল। ষাটের দশকে মুজিব আবির্ভুত হয়েছিল বাঙালি ফাসিস্টদের প্রধান নেতা রূপে। এজেন্ডা অভিন্ন হওয়ায় মুজিব ও তার অনুসারীদের সখ্যতা গড়ে উঠে শয়তানের পৌত্তলিক খলিফা ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক চক্রের সাথে। শুরু থেকেই তাদের মধ্য কোয়ালিশন গড়ে উঠে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিনাশে।

শয়তানের দলই ছিল মুজিবের দল

পবিত্র কুর’আনের বর্ণনায় মানব জাতির বিভাজন মাত্র দু’টি দলে। একটি হলো আল্লাহর দল (হিজবুল্লাহ); এবং অপরটি হলো শয়তানের দল (হিজবুশ শায়তান)। সর্বজ্ঞানী মহান রব’য়ের বিচারে তৃতীয় কোন দল নাই। তাই পবিত্র কুর’আনে হিজবুল্লাহ ও হিজবুশ শায়তান ব্যতীত তৃতীয় কোন দলের উল্লেখ। প্রতিটি মানব সন্তান এ দুটি দলের কোন একটির সদস্য। অতএব হিসাবটি সহজ; যারাই আল্লাহর দলে নেই, তারাই হলো শয়তানের দলে। আল্লাহর দলের পরিচয়টিও অতি সহজ। সে পরিচয়টি নিহিত রয়েছে সে দলের সদস্যদের দর্শন, আক্বিদা-বিশ্বাস, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও লড়াইয়ের মাঝে। আল্লাহর দলের সদস্যদের চেনা যায় শুধু তাদের নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দেখে নয়, বরং আল্লাহর পথে যুদ্ধ তথা জিহাদ দেখে। জিহাদই হলো ঈমানের সবচেয়ে নির্ভর যোগ্য দৃশ্যমান রূপ।  অপর দিকে শয়তানের দলের সদস্যদের চেনা যায় তাদের জীবনে দল, মতবাদ, বর্ণ, গোত্র, ভাষা  ও অঞ্চল ভিত্তিক রাজনীতি দেখে। ঈমানদার ও বেঈমান -এই উভয় দলের যুদ্ধের চিত্রটি মহান আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন এভাবে:

“ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱلطَّـٰغُوتِ فَقَـٰتِلُوٓا۟ أَوْلِيَآءَ ٱلشَّيْطَـٰنِ ۖ إِنَّ كَيْدَ ٱلشَّيْطَـٰنِ كَانَ ضَعِيفًا

অর্থ: “যারা ঈমান এনেছে তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায় এবং যারা কাফির তারা যুদ্ধ করে শয়তানের তথা তাগুতের পথে। অতঃপর হে ঈমানদারগণ তোমরা যুদ্ধ করো শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই শয়তানের ষড়যন্ত্র দুর্বল।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৬)। 

উপরিউক্ত আয়াতের শেষাংশে মুসলিমদের উপর আল্লাহর পথে যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে -যেমন ফরজ করা হয়েছে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত। তাই ঈমানদারকে শুধু নামাজ-রোজার পালন নিয়ে বাঁচলে চলে না, বাঁচতে হয় জিহাদ নিয়েও। যুদ্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে নিচের আয়াতে। বলা হয়েছে:

۞ فَلْيُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يَشْرُونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا بِٱلْـَٔاخِرَةِ ۚ وَمَن يُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا

عَظِيمًۭا

অর্থ: “আর যারা আখেরাতের বিনিময়ে এ পার্থিব জীবনকে বিক্রয় করেছে তারা যেন অবশ্যই যুদ্ধ করে আল্লাহ পথে তথা আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার পথে। এবং যারা আল্লাহ পথে যুদ্ধ করে অতঃপর সে যুদ্ধে নিহত হয় অথবা বিজয়ী হয় -তাদেরকে দিব বিশাল প্রতিদান।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৪)

নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করলেই কেউ মুসলিম হয় না। তাকে মুসলিমের দায়িত্ব নিয়ে বাঁচতে হয়। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে নিজ জীবনের এজেন্ডা বানিয়ে নিতে হয়। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার যুদ্ধটি তার নিজের যুদ্ধ হতে হয়। মহান রব’য়ের সে ঘোষিত এজেন্ডাটি হলো, তাঁর নিজ সার্বভৌমত্ব ও নিজ শরিয়া’র প্রতিষ্ঠা।  সে সাথে মিথ্যাচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচারের  প্রতিষ্ঠা। মুসলিমের নিজের দল, নিজের রাজনীতি ও নিজের যুদ্ধ বলে কিছু নাই। তার দলকে যেমন আল্লাহর দল তথা হিজবুল্লাহ হতে হয়, তেমন তার রাজনীতি হতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় রাজনীতি। তেমনি তার যুদ্ধকে হতে হয় আল্লাহর দ্বীন ও মুসলিম দেশের স্বাধীনতাকে প্রতিরক্ষা দেয়ার যুদ্ধ। যার দল, দলীয় রাজনীতি ও যুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করা এজেন্ডা নয়, তার রাজনীতি কখনোই হালাল হতে পারে না। ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলার রাজনীতিতে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর পরাজয় আনে, তাই এ রাজনীতি হারাম। আর এই হারাম রাজনীতির নেতা-কর্মীরা  কখনো মুসলিম হতে পারে না। মুজিব ও তার অনুসারীদের রাজনীতিতে ইসলামের কোন স্থান ছিল না। তার রাজনৈতিক যুদ্ধ ছিল স্রেফ তার নিজের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। তই তার রাজনীতিতে যেমন পাকিস্তানের অখণ্ডতা বাঁচেনি, তেমনি বাঁচেনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র।

তাছাড়া মুজিব নিজেও কখনো নিজেকে এবং তার দলকে ইসলামপন্থী দল রূপে দাবী করেনি। মুজিব ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের প্রবক্তা। অথচ মুসলিমের জন্য ইসলামপন্থী হওয়া ছাড়া অন্য কোন মতবাদপন্থী হওয়ার রাস্তা খোলা রাখা হয়নি। যে দল ইসলামপন্থী নয়, সে দল অবশ্যই শয়তানপন্থী হয়। সেটিই তো স্বাভাবিক। কারণ চেতনার ভূমি কখনোই শূণ্য থাকে না, ইসলাম স্থান না পেলে সেখানে অন্য মতবাদ জায়গা করে নেয়। তাই যারা ইসলামপন্থী নয় তারাই জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী, ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী, সমাজবাদী, পুঁজিবাদী, হিন্দুত্ববাদী তথা নানা মতবাদী হয়। এরা সবাই শয়তানপন্থী। এ জন্যই শয়তানপন্থী দলের মৈত্রী কখনোই ইসলামপন্থীদের সাথে হয় না, তারা বরং বন্ধু রূপে গ্রহণ করে শয়তানের অন্য খলিফাদের। কারণ, উভয়েই পরস্পরের আদর্শিক কাজিন। এজন্য শয়তানের ভারতীয় পৌত্তলিক খলিফাদের সাথে মুজিব ও তার দলের সম্পর্ক ছিল এতো অটুট। এজন্যই ভারত ১৯৭১’য়ে একটি প্রকাণ্ড যুদ্ধ করে মুজিবকে ক্ষমতায় বসায়।

ক্ষমতালোভী মুজিব

মুখে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বল্লেও মুজিব ও তার অনুসারীগণ সে লক্ষ্যে একাত্তরে যুদ্ধ করেনি। মুজিব ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী। ক্ষমতা হাতে পেতে মুজিব ভারতের সাহায্য চেয়েছে। বিনিময়ে একাত্তরের যুদ্ধে পৌত্তলিক ভারতকে বিজয়ী করতে মুজিবের অনুসারীরা যুদ্ধ করেছে। মুজিবের ভাবনা ও তাড়নায় বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতার কোন স্থান ছিল না। সেটি থাকলে গণতন্ত্রকে কেন কবরে পাঠাবে? কেন একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা দিবে? কেন কেড়ে নিবে জনগণের রাজনৈতিক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা? ক্ষমতালোভী মুজিবের লড়াইটি ছিল নিছক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে পাওয়ার স্বার্থান্বেষী লড়াই। ক্ষমতা পেতে মুজিব যে কোন পথ বেছে নিতে রাজী ছিল -এমনকি বিদেশী শক্তির কাঁধে চড়ে হলেও । সে কাজটি সহজ করতেই মুজিব ভারতীয় বাহিনীকে নিজ ভূমিতে ডেকে এনে এবং নিজ দেশ পাকিস্তানকে খণ্ডিত করে। মুজিবের যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিলনা, ছিল ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধেও। কারণ পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীদেরকে মুজিব নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করতো।

যারা বলে পূর্ব পাকিস্তানীদের ক্ষমতার মসনদ থেকে দূরে রাখার জন্যই মুজিবের হাতে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা দেয়া হয়নি -তারা সত্য বলেনা। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনের আগেও পাকিস্তানের ৩ জন প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানী তথা বাঙালি হয়েছে। ১৯৭১’য়ের শেষ দিকে নুরুল আমীন সাহেবও প্রধানমন্ত্রী হন। দুইজন রাষ্ট্রপ্রধানও হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের ক্ষমতার বাইরে রাখা পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য হলে কেন এতো আয়োজন করে নির্বাচন দিবে? নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের সামনে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী রূপে ঘোষণা দেন।

অপর দিকে নিরংকুশ বিজয়ের পর মুজিব তার রাজনীতির গোল পোস্ট পাল্টিয়ে ফেলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনি বিজয়কে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানানোর পক্ষে রায় বলে পেশ করা হয়। সেটি পরিণত হয় ভারতীয় বয়ানে। তাই একাত্তরের সেপ্টম্বরে ইসলামাবাদস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার মিস্টার জয় কুমার অটালের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশ্নে গণভোটের প্রস্তাব পেশ করেন, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দাবী করেন, ১৯৭ ০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হলো স্বাধীনতার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানীদের রায়। অথচ ইন্দিরা গান্ধীর সে দাবীর মধ্যে কোন সত্যতা ছিল না। কারণ ১৯৭০’য়ের নির্বাচনটি হয়েছিল স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে, স্বাধীনতার দাবীতে নয়।

পাকিস্তান ভাঙাটি ছিল শেখ মুজিবের ষাটের দশকের পরিকল্পনা -যা সফল করতে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW’য়ের সাথে মিলে রচিত হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের কাছে আগরতলা ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে, ফলে তকা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জুলফিকার আলী ভূট্টোর দল পিপলস পার্টির পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয় এবং শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ বিজয় পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত করে ফেলে। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক বিভক্তি মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার মূল প্রকল্পকে বহুগুণ সহজ করে দেয়।

শেখ মুজিব পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের মাঝে মাত্র একটি মাত্র প্রদেশে নির্বাচনে জিতেছিল। অন্য প্রদেশের বিজয়ীদের সাথে সমাঝোতা না করে তার পক্ষে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অসম্ভব ছিল। এরূপ অবস্থায় যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক সমাঝোতার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে সেরূপ সমঝোতা বার বার হয়ে এসেছে।  অথচ মুজিব সেরূপ কোন সমঝোতায় রাজী ছিল না, বরং জিদ ধরে, একমাত্র তার হাতেই ক্ষমতা দিতে হবে। মুজিবের যুক্তি, পার্লামেন্টের অর্ধেকের বেশী নির্বাচিত সদস্য তার দলের। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য বিষয়টি অনেক জটিল ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অংশগ্রহণ ছাড়া মুজিবের হাতে ক্ষমতা দিলে সেটি হতো অবাঙালিদের উপর বাঙালির শাসন। সেটি পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল। অপর দিকে পাকিস্তানের কোন সরকার যদি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিয়ে গঠিত হলে সেটিও কোন বাঙালি মেনে নিতনা।  ১৯৭০’য়ে নির্বাচনে পাঞ্জাব ও সিন্ধু -এ দুটি প্রদেশে বিজয়ী হয়েছিল জুলফিকার আলী ভূ্ট্টোর দল পাকিস্তান পিপল’স পার্টি। ভূট্টোর পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া মুজিব সরকার গঠনে সমাঝোতায় রাজী না হলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশনে তার দলের পক্ষ থেকে কেউ যোগ দিবে না। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বা সংসদকে জাতীয় পরিষদ বলা হয়।

মুজিব ভেবেছিল, একক ভাবে ক্ষমতায় গেলে বিনা যুদ্ধে পাকিস্তান ভাঙার কাজটি সহজ হবে। পরবর্তীতে প্রকাশ পায়, নির্বাচনি বিজয়ের পর পাকিস্তান ভাঙাই ছিল মুজিবে রাজনীতির মূল এজেন্ডা, পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়া নয়। তাজুদ্দীন আহমেদ ও ছাত্র লীগের সিরাজুল আলমসহ কট্টোর পাকিস্তান বিরোধীরাই সেটিই চাচ্ছিল। সে কথাটি মুজিব বলেছিল ১০ জানুয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায়। উক্ত জনসভায় মুজিব দাবী করে, স্বাধীন বাংলাদেশ বানানোর লক্ষ্যে তার লড়াইয়ের শুরু ১৯৭১ থেকে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে। মুজিবের সেদিনের সে বক্তৃতা এ গ্রন্থের লেখকের নিজ কানে শোনার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনি বিজয়ের পর মুজিবের জন্য তার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা সহজ হয়ে যায়।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নেয়া যখন অসম্ভব হয়, তখন মুজিব দাবী তোলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন ও সামরিক বাহিনী তুলে নিয়ে তার হাতে ক্ষমতা দেয়ার। সেটিও অসম্ভব ছিল। কারণ, দেশে তখন কোন সংবিধান ছিল না, দেশ চলছিল সামরিক আইনে। সামরিক আইন তুলে নিলে শাসকের হাতে আর কোন বিধি নিষেধ থাকেনা। সামরিক আইন তুলে নেয়ার অর্থ হতো, মুজিবকে ইচ্ছামত দেশ চালানোর সুযোগসহ পূর্ব পাকিস্তানকে বিনা যুদ্ধে স্বাধীন করার পথ খুলে দেয়া। পাকিস্তান সরকার মুজিবের সে পথও বন্ধ করে দেয়। ফলে মুজিবের অনুসারীরা যুদ্ধে পথ বেছে। সেরূপ একটি যুদ্ধে জন্য মার্চের শুরু থেকেই রীতিমত প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজও শুরু হয়েছিল। ইতিমধ্যে বহু হাজার ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW’য়ের এজেন্টও পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। শুরু হয় বিহারী নিধন ও তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের উপর লুটপাট।

 

যুদ্ধ শুরু হলো এবং সুযোগ করে দেয়া হলো ভারতীয় আগ্রাসনের

১৯৭০ নির্বাচনের অংশ নেয়ার শর্ত রূপে প্রতিটি দলকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষিত Legal Frame Work স্বাক্ষর করতে হয়। তাতে ৮ দফা শর্ত ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল, পাকিস্তানের একতা ও সংহতির প্রতি অঙ্গীকার থাকতে হবে। এবং শর্ত ছিল,  নির্বাচনের পর নির্বাচিত সদস্যগণ সর্বপ্রথম পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করবে -যা হবে আগামীতে সরকার পরিচালনা ও দেশ শাসনের রোডম্যাপ। সংবিধান রচনার পর গঠিত হবে নতুন সরকার এবং সে সরকার পাবে নতুন সংবিধান অনুযায়ী দেশ চালানোর অধিকার। কিন্তু বিশাল নির্বাচনী বিজয়ের পর মুজিব তার নিজের স্বাক্ষরিত দায়বদ্ধতার কথাই ভুলে যায়। মুজিব দাবী তোলে, তার দল যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

শাসনতন্ত্র রচনার বিষয়টি ইচ্ছা করেই চাপা দেয়া হয়। কারণ সংবিধান রচিত হলে তো পাকিস্তান বেঁচে যেত। তাই মুজিবের সেদিকে আগ্রহ ছিল  না; বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী নিয়ে দেশ জুড়ে মুজিব অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এবং ১৯৭১’য়ের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় হাতের কাছে যার যা আছে তা দিয়ে সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দেয়। সিভিল প্রশাসন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দেশকে পুরোপুরি অচল করা হয়। রাজস্ব দেয়া বন্ধসহ দেশে এক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা হয়; ফলে অনিবার্য হয়ে উঠে আরেকটি সামরিক হস্তক্ষেপ।  ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুজিব, ভূ্ট্রো ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মাঝে ২১-২৩ মার্চ সমাঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হয়;  ২৫ মার্চ শুরু হয় আরেক সামরিক এ্যাকশন।

মুজিবের অনুসারীগণ দেশজুড়ে প্রতিরোধ খাড়া করে; হাজার হাজার বিহারী হত্যা ও তাদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠনে সফল হলেও সামরিক বাহিনীর প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে মুজিবের অনুসারীগণ দেশের মফস্বলের ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুন্টন করে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্রের পার্টনার ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য ভিক্ষা করে। ভারত সে আহবানে সাড়া দেয় এবং গড়ে তোলে ভারতীয় অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণে মুক্তি বাহিনী। মুক্তি বাহিনী যখন সমগ্র দেশ স্বাধীন করা দূরে থাকে একটি জেলা বা থানাও স্বাধীন করতে ব্যর্থ তখন আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারত নিজে যুদ্ধ নামে। হামলা শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। মুজিবের পাকিস্তান ভাঙার প্রকল্প এভাবেই সেদিন সফল হয়। এবং মুসলিম উম্মাহ হারায় তাদের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তান। পৌত্তলিক কাফিরগণ পায় তাদের সমগ্র ইতিহাসে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিজয়টি।

মীর জাফরের পর সবচেয়ে বড় মীর জাফর

ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতিতে শয়তানের প্রধান খলিফা রূপে আবির্ভুত হয় শেখ মুজিব; এবং শয়তানের প্রধান দল রূপ হাজির হয় আওয়ামী লীগ। মুজিবের রাজনীতিতে ইসলামের কোন অঙ্গীকার ছিল না, অঙ্গীকার ছিল না পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি। বরং তার গভীর একাত্মতা ছিল ভারতের এজেন্ডার সাথে। বাঙালি পৌত্তালিকরা সেটি টের পায়; ফলে দলে দলে তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। এবং দলে দলে মুজিবের সাথে কোয়ালিশন গড়ে সকল বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও বাঙালি কম্যুনিস্ট। কারণ, ইসলামের এ শত্রুগণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন চায়নি, তেমনি চায়নি দেশটি বেঁচে থাকুক।

শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় এবং ইসলামের ক্ষতিসাধনে শেখ মুজিব ও তার দলের সাফল্যটি বিশাল। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে মীর জাফেরর পর আর কোন ব্যক্তিই মুসলিম উম্মাহর এতো বড় ক্ষতি করেনি -যা করেছে শেখ মুজিব। শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে মুজিবের বড় বড় দুটি অবদান হলো: এক). পাকিস্তানের বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করে মুজিব মুসলিম উম্মাহর কোমর ভেঙ্গে দিতে পেরেছে। দুই). ভারতের ন্যায় শয়তানের সর্ববৃহৎ পৌত্তলিক খেলাফতকে একাত্তরের যুদ্ধে বিজয়ী করে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে দেশটিকে প্রধান শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং পরিণত করেছে বিশ্বের অন্যতম শক্তিতে। ভারতীয় হিন্দুত্বাবাদীদের কাছে মুজিব ও তার পরিবার এজন্যই এতো আদরণীয়। তাই পলাতক হাসিনাকে বিশ্বের কেউ আশ্রয় না দিলেও আশ্রয় দিয়েছে ভারত। তাই মুজিবের মূর্তি ভেঙে বাঙালি মুসলিমগণ যখন উল্লাস করেছে এবং সে মূর্তির উপর পেশাব করেছে তখন মাতম উঠেছে ভারতীয় মিডিয়ায়।